• ঢাকা শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১
logo
রেললাইনে পড়ে ছিল মাথাবিহীন মরদেহ
এমপি আনার হত্যা: মূলহোতা শাহীনের অবৈধ সাম্রাজ্যের সন্ধান
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় গিয়ে পরিকল্পিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তাকে কলকাতার নিউটাউনের অভিজাত আবাসন সঞ্জীবা গার্ডেনের বি-ইউ ব্লকের ৫৬ নম্বর ফ্ল্যাটে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর মরদেহ টুকরো টুকরো করেন হত্যাকারীরা। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে হত্যার মূলহোতা তারই বাল্যবন্ধু এবং ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন। জানা গেছে, শাহীন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র শহিদুজ্জামান সেলিমের ছোট ভাই ও যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী প্রবাসী বাংলাদেশি। সেই সঙ্গে বিদেশে বসে দেশে ঠিকাদারিও করেন তিনি। দেশের বিভিন্ন স্থানে তার শত শত কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলমান। একই সঙ্গে হুন্ডি ও স্বর্ণ চোরাচালান করে কোটচাঁদপুরে অবৈধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন শাহীন। আরও জানা গেছে, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামে চল্লিশ বিঘা জমির ওপর শাহীনের একটি রিসোর্ট আছে। ঠিকাদারি কাজে প্রতিবছর দেশে এসে ৬ মাস অবস্থান করেন তিনি, থাকেন এই রিসোর্টেই।  স্থানীয়রা জানান, হুন্ডি ও স্বর্ণ চোরাচালান করে শাহীন এই রিসোর্ট গড়ে তুলেছে। রিসোর্টের ভিতরে সুইমিং পুল, চা বাগান, গরু-ছাগলের ফার্ম, জার্মান শেফার্ড, গলফ কোর্স ও বিভিন্ন ফলের বাগান রয়েছে। আছে কঠোর নিরাপত্তা, সিসি ক্যামরাসহ তারকাঁটা বেষ্টনি। শাহীন দেশে অবস্থানকালে এই রিসোর্টে সুন্দরী নারীদের আনাগোনা দেখা যায়। এ সময় রিসোর্টে ভিআইপি ও ভিভিআইপিরা সময় কাটাতে আসেন। এই রিসোর্টে সাধারণ মানুষের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে এমন নৃশংসভাবে হত্যায় শাহীন জড়িত থাকলে তার ফাঁসির দাবি করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। শাহীনের বড় ভাই ও কোঁটচাদপুর পৌরসভার মেয়র শহিদুজ্জামান সেলিম বলেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যায় যদি শাহীন জড়িত থাকে তবে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবে প্রশাসন। হুন্ডি ও স্বর্ণ চোরাচালানের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান তিনি। কোঁটচাদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ সৈয়দ আল মামুন বলেন, সকল অভিযোগের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ মে দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট থেকে ১২টা ৫০ মিনিটের মধ্যে নিউটাউনের ওই ফ্লাটে আনারকে খুন করে লাশ টুকরো করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সময় নেওয়া হয় ১০ মিনিটেরও কম। কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেয় অন্তত পাঁচজন। এরপর ১৬ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত তিনদিন ধরে খণ্ডিত অংশ অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়। এ ছাড়া বি-ইউ ব্লকের ৫৬ নম্বর ফ্ল্যাটের ফ্রিজে ও প্লাস্টিক ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে মরদেহের কিছু টুকরো। প্লাস্টিক ব্যাগে ভরেই খণ্ডিত অংশ বিভিন্ন জায়গায় ফেলা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন। তিনি হত্যার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেন আরেক বন্ধু ও খুলনা অঞ্চলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়ার (আমানউল্লাহ আমান)। আনারকে হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। হত্যাকাণ্ডের আগে শিমুলকে কিছু টাকাও দেন। হত্যাকাণ্ডের পর বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল। জানা যায়, কলকাতায় বসে হত্যার চূড়ান্ত ছক এঁকে বাংলাদেশে চলে আসেন শাহীন। পরে আমানসহ ছয়জন মিলে এমপি আজীমকে সঞ্জীবা গার্ডেন নামের একটি ফ্ল্যাটে ট্র্যাপে ফেলে ডেকে আনেন। এরপর তাকে জিম্মি করে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। পরে মরদেহ কেটে টুকরো টুকরো করে ট্রলি ব্যাগে ভরে ফেলা হয় অজ্ঞাত স্থানে। মিশন সফল হওয়ার পর আনারের মরদেহের টুকরোগুলো গুম করার জন্য সিয়াম ও জিহাদ নামের দুজনকে দায়িত্ব দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন শিমুল। ঢাকায় এসে তিনি আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে দেখা করেন। তবে শাহীন পরবর্তীতে শিমুলকে কত টাকা দিয়েছেন সেটা জানা যায়নি। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে তিনজনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারী বিভাগ। তারা হলেন- হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া চরমপন্থী দল পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও খুলনা অঞ্চলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়া (আমানউল্লাহ আমান), মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শিমুল ভূঁইয়া জানিয়েছে, এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। হত্যাকাণ্ডের আগে তাকে কিছু টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল হত্যাকাণ্ডের পর।  ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরের বোনের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন শিমুল। সেখান থেকেই তাকে আটক করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি তার ভারতীয় ঘনিষ্ঠ বন্ধু পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বরানগর থানার মলপাড়া লেনের বাসিন্দা স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। পরদিন ১৩ মে দুপুরে চিকিৎসককে দেখানোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান। কিন্তু সন্ধ্যায় ফেরার কথা থাকলেও তিনি আর ফিরে আসেননি। উল্টো হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়ে জানান, তিনি একটি কাজে দিল্লিতে গিয়েছেন।  তাকে আর ফোন করতে হবে না। দরকার হলে তিনি তাকে (গোপাল বিশ্বাস) ফোন করবেন। এরপর থেকে আর কোনোভাবেই তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। স্বাভাবিকভাবে উৎকণ্ঠা ছড়ায় তার বাংলাদেশের বাসায়। পাশাপাশি গোপাল বিশ্বাসও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এরপরই কোনো উপায় না দেখে গত ১৮ মে শনিবার বরানগর থানায় একটি নিখোঁজের অভিযোগ দায়ের করেন গোপাল বিশ্বাস। জিডিতে গোপাল বিশ্বাস লিখেছেন, গত ১৩ মে দুপুর দেড়টার পর ডাক্তার দেখানোর কথা বলে আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান আনোয়ারুল আজিম আনার। যাওয়ার সময় বলে যান, দুপুরে খাবো না, সন্ধ্যায় ফিরে আসবো। যাওয়ার সময় নিজে গাড়ি ডেকে বরাহনগর বিধান পার্ক কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে গাড়িতে উঠে চলে যান। এরপর তিনি সন্ধ্যায় বরাহনগর থানার অন্তর্গত মণ্ডলপাড়া লেনে বাড়িতে না ফিরে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেন, আমি বিশেষ কাজে দিল্লি যাচ্ছি। গিয়ে ফোন করবো, তোমাদের ফোন করার দরকার নেই। গোপাল বিশ্বাস মিসিং ডায়েরিতে আরও লিখেছেন, গত ১৫ মে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে জানান, আমি দিল্লি পৌঁছালাম, আমার সঙ্গে ভিআইপিরা আছে, ফোন করার দরকার নেই। এদিকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করা হয়েছে। বুধবার (২২ মে) অপহরণের অভিযোগে মামলাটি করেন এমপি আনারের মেয়ে মুনতারিন ফেরদৌস ডরিন। তবে এতে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। সন্ধ্যায় শেরেবাংলা নগর থানায় মামলাটি নথিভুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আহাদ আলী।