• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
logo

পাবনায় গরু নিয়ে শঙ্কায় খামারিরা

পাবনা প্রতিনিধি, আরটিভি নিউজ

  ২৩ জুলাই ২০২০, ১৪:০৩
গরু খামারি যত্ন
ফাইল ছবি

পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার গরু পালনকারীরা গরু বিক্রি ও দাম নিয়ে এবার চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে দুই উপজেলার প্রায় ছয় হাজার খামারি ও কৃষকরা এবার কুরবানির হাটে ও বাড়ি থেকে গরু বিক্রির ভরসা করতে পারছেন না।

এমন অবস্থায় এখন থেকেই অনেক যত্ন ও ধারদেনা করে বড় করা গরুগুলোকে বিক্রির চেষ্টা করছেন তারা। কিন্তু অন্যান্য বছরের মতো এবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে গরু কেনায় আগ্রহী ব্যাপারীদের দেখা নেই। এছাড়া ক্রেতার অভাবে হাটে নিয়েও গরু বিক্রি করা যাচ্ছে না বলে জানা যায়।

দুই উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় ও খামারিদের সূত্রে জানা যায়, বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলা দেশের অন্যতম গরু লালন-পালনকারী বিসেবে ব্যাপক পরিচিত রয়েছে সারা দেশে। দুই উপজেলার প্রায় পাঁচ হাজার খামারে, প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ হাজারেরও বেশি গরু কুরবানির হাটে বিক্রির জন্য পালন করা হয়েছে। প্রতিবছর কুরবানির হাট শুরুর মাস দেড়েক আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকার গরুর ব্যাপারীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গরু কেনা শুরু করেন। এছাড়া দুই উপজেলার পশুর হাটগুলো থেকেও ব্যাপারীরা গরু কিনে দেশের বিভিন্ন জেলার হাটে বিক্রি করে থাকেন। আরেকদিকে বেড়েছে গো খাদ্যের দাম আগাম বর্ষার পানি ও বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে ঘাসের খেত। জানা যায় গত তিন মাসে ভূষির বস্তা প্রতি দাম বেড়েছে তিন শত টাকা। অন্যান্য গো খাদ্যের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গেছে। এমন অবস্থায় গরু পালন ও বিক্রি নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছে খামারি ও সাধারণ কৃষকেরা।

বেড়া উপজেলার চাকলা গ্রামের খামারি মান্নান মাস্টার জানান, করোনার পরিস্থিতর কারণে এবার গরু কেনায় আগ্রহী ব্যাপারীদের দেখাই নেই। এমন পরিস্থিতিতে আমার মতো বহু খামারি চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাদের আশঙ্কা এবারের কুরবানির হাটে ক্রেতার অভাবে কম দামে গরু বিক্রি করতে হতে পারে। তাই কুরবানির হাট শুরু হতে মাসখানেক দেরি থাকলেও গরু পালনকারীরা এখনই তাঁদের গরু বিক্রির চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

বেড়া-সাঁথিয়ার অন্যতম গরু ব্যবসায়ী হলেন বেড়া পৌর এলাকার বৃশালিখা মহল্লার আব্দুল মোমিন। তিনি জানান, অন্যান্য বছরে গরুর ব্যাপারীরা এত দিনে ঢাকার কুরবানির হাটকে সামনে রেখে গরু খামারিদের কাছ থেকে গরু কেনা শুরু করে দেন। কিন্তু এবার বেশির ভাগ ব্যাপারী ভয়ে গরু কিনছেন না। গত বছরে তিনি এত দিনে ৬০টির মতো গরু কিনেছিলেন বলে জানান। কিন্তু এবার কেনেননি। তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে হাটে গরুর দাম কেমন হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণেই তিনি গরু কিনছেন না।

সাঁথিয়া উপজেলার আফড়া গ্রামের খামারি শাজাহান আলী জানান, এবার কপালে যে কি আছে তা বুঝবার পারতিচিনা। এহন পর্যন্ত একজন ব্যাপারিও গরু দেখবার আসে নাই হাটেও গরুর দাম নাই। গরু বেচবার পারবো কিনা হেই চিন্তায় ঘুম আসে না। গরুকে তো না খাইয়ে রাহা যায় না, ৩০ টি গরু পালতে কয়েক লাখ টাহা খরচ হচ্ছে। দুই মাস হইছে রাহালদের বেতনও দেই নাই। গরু বেচবার না পারলি খুব মুসকিলে পরে যাবো নে এবার।

সরেজমিনে সাঁথিয়ার করমজা চতুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচুর খামারি ও কৃষকরা গরু বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ক্রেতা নেই বললেই চলে।

হাঁটে গরু বিক্রি করতে আসা বেড়া কুশিয়ারা গ্রামের ছাত্তার আলী, জানান, সকাল দশটায় তিনটি গরু আনছি এহন বাজারে কোনও ব্যাপারী দামই কয় নাই। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গরু কিনেছি। দোকান বাঁকি করে গরু পালন করেছি, দোকানদারদের হালখাতা করতে হবে। এহন গরুর বিক্রি করতে না পারলি বিপদে পড়তে হবে। অন্য বছর এই সময়ে বাড়ি থেকেই গরু বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু এবার হাটে এনেও বিক্রি করা যাচ্ছে না। সামনের কুরবানির হাটে গরুর দাম নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।

ছাগলের হাঁট ঘুরে একই চিত্র দেখা যায়, ব্যাপারীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। অনেক ছাগল বিক্রেতাকে হাঁট থেকে ছাগল ফিরিয়ে আনতে দেখা গেছে।

করমজা চতুর হাটের পশুর হাট পরিচালনাকারীদের অন্যতম মিজানুর রহমান (উকিল) বলেন, আমাদের হাটে ক্রেতা বিক্রেতাসহ সর্বসাধারণের জন্য মাস্ক ছাড়া প্রবেশ নিষেধ ঘোষণা করেছি। হাটে বেচাকেনা একেবারেই নেই বললেই চলে। অন্য বছরের মতো ঢাকা, মানিকগঞ্জ, চিটাগংয়ের ব্যাপারীরা আসছে না। কমবেশি যা বিক্রি হচ্ছে তা স্থানীয় ব্যাপারী ও কৃষকদের কাছে।

আতাইকুলা থানার আজগার আলী জানান, ঢাকায় গরু নিলেই ‘তিনদিনে লাখপতি’হওয়া যায় এমন রঙিন স্বপ্নে অনেক আনাড়ি লোকজন এলাকা থেকে বেশি দামে গরু কিনে ঢাকায় নেয়। এতে অন্যসব ব্যাপারীও বেশি দামে এলাকা থেকে গরু কিনতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত ঢাকার চাহিদার তুলনায় বেশি সংখ্যক গরু সেখানে আমদানি হওয়ায় দাম পড়ে যায়। অনেক লোভী ফড়িয়া সর্বস্বান্ত হওয়ায় এবার তারা অনেকেই হাটে নেই বলে প্রতিষ্ঠিত গরু ব্যবসায়ীরা জানান।

তিনি আরও জানান, এবারের প্রেক্ষাপট আরও অন্যরকম। করোনা সংকটের জন্য গরু নিয়ে কোন হাটে যাবেন কিভাবে যাবেন এ নিয়েই তারা চিন্তাগ্রস্ত।

গরু ব্যবসায়ী জসীম উদ্দিন জানান, ঢাকায় গরু সরবরাহ করা ছিল লাভজনক। প্রতি বছর এতদিনে তারা খামারিদের বা চাষিদের বাড়ি বাড়ি থেকে গরু কিনে অস্থায়ী গোয়ালে রাখা শুরু করতেন। কিন্তু এবার তারা গরু নিয়ে ঢাকা যাবেন কিনা তা এখনও ঠিক করেননি।

এদিকে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পাবনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় শ’ শ’ গো-খামার গড়ে উঠেছে। এমন কোনও বাড়ি নেই যেখানে ২-৪টি গরু পালন হচ্ছে না। গরু পালন করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন অনেকেই। শুধু কুরবানি ঈদকে কেন্দ্র করেই বিগত এক দশকে গরু লালন পালন এবং কেনা বেচা করে বহু লোকজন নিজেদের ভাগ্য বদলে ফেলেছেন।

জেলায় এ বছর কুরবানির হাটে প্রায় দুইশ কোটি টাকার গরু-ছাগল কেনা-বেচার সম্ভাবনা ছিল। তবে প্রাণিসম্পদ বিভাগের আশঙ্কা ছিল করোনা সংকটের কারণে তা বেশ কম হতে পারে।

পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আল-মামুন হোসেন জানান, গত এক দশক ধরে পাবনায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গরু মোটাতাজাকরণ বেড়েছে।

তিনি আরও জানান, মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন ষাঁড় পালন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। কেউ পেশায়, কেউ বেকারত্বের অভিশাপ ঘোচাতে, কেউ সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে এসব খামার গড়ে তুলেছেন বলে তিনি জানান। এরা সাধারণত এক বছর পর পোষা গরু বিক্রি করে দেন। অনেকে দুই বছর পর্যন্ত লালন-পালন করে থাকেন। ষাঁড়গুলো পবিত্র ঈদুল আজহার সময়েই সাধারণত বিক্রি হয়।

প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আরও জানান, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জেলায় প্রায় ২১ হাজার খামারি রয়েছেন, যারা গাভি ও ষাঁড় পালন করেন। আরও অন্তত ২০-২৫ হাজার ক্ষুদ্র কৃষক নিজ উদ্যোগে গরু মোটাতাজাকরণ করছেন। এছাড়া জেলায় প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার হতদরিদ্র মহিলা এনজিওর টাকায় গরু পালন করে থাকেন। খামারি, ক্ষুদ্র কৃষক ও হতদরিদ্র গৃহিণীর পালন করা গরু মিলিয়ে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার গরু কুরবানির হাটে উঠবে।

এদিকে প্রায় ৪০ হাজার ক্ষুদ্রচাষির এক লাখ ১৫ হাজার হাজার ছাগল- ভেড়াও বাজারে উঠবে। সব মিলিয়ে দুই লাখ ৩৫ হাজার থেকে দুই লাখ ৪০ হাজার গরু-ছাগল- ভেড়া বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গড় দাম হিসেব করে পাবনা থেকে প্রায় দুইশ থেকে দুইশ বিশ কোটি টাকার গরু- ছাগল বিক্রির টার্গেট ছিল। তবে করোনা সংকটে কারণে দাম ২০-২৫ শতাংশ কমে যাওয়ায় এ লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে বলে প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানিয়েছে।

জেবি

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh