• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
logo

বঙ্গবন্ধুর সহানুভূতি পাওয়া সেই পরিবারটি এখন

জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস, মানিকগঞ্জ, আরটিভি অনলাইন

  ০৬ এপ্রিল ২০২০, ১১:১৬
বঙ্গবন্ধু মানিকগঞ্জ শহিদ
ছবি: সংগৃহীত

শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজ উদ্দিন আহমেদের পরিবার জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, পাক হানাদার বাহিনী তাদের প্রিয়জনকে হত্যা করেছে। স্বাধীনতাকামী ও শেখ মুজিবের আদর্শের অনুসারী ছিলেন বলেই তিনি শহীদ হয়েছেন উল্লেখ করে তারা বলেন, তিনি শহীদ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ওই পরিবারকে পত্র দিয়ে সহানুভূতি জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ওই পরিবারকে আর্থিক সহায়তাও দিয়েছেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর, এই পরিবারটির খোঁজ নেয়নি কেউ। বিভিন্ন সরকার বদলের কারণে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকায়ও উঠেনি সিরাজ উদ্দিন আহমেদের নাম। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে যেই সহানুভূতি তার পরিবার পেয়েছে, বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও অনুরূপ সহানুভূতি পরিবারটি আশা করে।

শহীদ সিরাজ উদ্দিন আহমেদ কিভাবে শহীদ হলেন এমন প্রশ্নের পর কিছুক্ষণ নীরব রইলেন তার স্ত্রী রওশন আরা বেগম। তারপর বলতে শুরু করলেন। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের চার এপ্রিল। সময় সকাল ১১টা। সকালের খাওয়া শেষ করে এক বছরের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করছিলেন কলেজ শিক্ষক সিরাজ উদ্দিন আহমেদ। হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়লো পাকবাহিনীর সদস্যরা। ঘর থেকে টেনে-হিঁচরে তাকে নিয়ে গেল বাড়ির পাশের রাস্তার ধারে। পেছনে দুটি হাত আর চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। একইভাবে তার পাশে দাঁড় করানো হলো আরও ১১জনকে। এরপর তাদের ওপর একসঙ্গে গুলি চালায় পাকসেনারা। মুহূর্তের মধ্যে মটিতে লুটিয়ে পড়লো স্বাধীনতাকামী সন্তানেরা। এখানেই শেষ নয়। হত্যাকাণ্ডের পর লাশগুলো পুড়িয়ে ফেলে তারা।

তিনি বলেন, এক বছরের শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে ঘরের ভেতর থর থর করে কাঁপছিলেন তিনি।

মানিকগঞ্জ জেলা শহরের গঙ্গাধরপট্টি এলাকার মরহুম নৈমুদ্দিন আহমেদের কনিষ্ঠ সন্তান সিরাজ উদ্দিন আহমদ যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূধন কলেজের বাণিজ্য বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। স্ত্রী আর এক বছরের শিশু পুত্রকে নিয়ে তিনি যশোর শহরের ষষ্ঠীতলা পাড়ার ম্যাজিস্ট্রেট রহমত উল্লার বাসায় ভাড়া থাকতেন। দু’তলাবিশিষ্ট ভবনের দুতলায় থাকতেন তিনি। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেদিনের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর শিশুপুত্রটিকে নিয়ে পালিয়ে এক মাস সাত দিন পর যশোর থেকে মানিকগঞ্জে ফিরে আসেন রওশন আরা।

এদিকে, নয় মাসের দীর্ঘ সংগ্রামের পর, স্বাধীন দেশের হাল ধরেন জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নানা দৈন্য আর সংকটের মাঝেও বঙ্গবন্ধু খোঁজ নিতে ভুলেননি দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা এই শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবারের। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে দুই হাজার টাকার একটি চেক পাঠিয়েছিলেন তার স্ত্রী রওশন আরা বেগমের নামে। ১৯৭২ সালের ১৭ জুলাই, শেখ মুজিব স্বাক্ষরিত পত্রের মাধ্যমে ওই চেকের কথা জানানো হয়। সেই চেকটি পাঠানো হয়েছে তার পরিবারের সাহায্যার্থে তৎকালীন মানিকগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের নিকট।

ওই পত্রে শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী রওশন আরা বেগমকে শেখ মুজিব লিখেছিলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। আমার প্রাণভরা ভালবাসা ও শুভেচ্ছা নিন।’

সেই সময় সিরাজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তার কলেজের শিক্ষকসহ আরও যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের স্মরণে ওই কলেজ চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে খোদাই করে লেখা হয়েছে শহীদ সিরাজ উদ্দিনসহ অন্যান্যদের নাম।

রওশনারা বেগমের বয়স এখন ৬৫ বছর। আট বছর আগে তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করেছেন। আর এক বছরের শিশুপুত্র সাইদ আহমেদের বয়স এখন ৪৯ বছর। বাবার চেহারা একেবারেই মনে নেই তার। শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান হিসেবে গর্বিত তিনি।

সিরাজ উদ্দিন আহমেদের পরিবার বঙ্গবন্ধুর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। কেননা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পত্র দিয়ে তার পরিবারকে সহানুভূতি জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর, এই পরিবারটির খোঁজ নেয়নি কেউ।

সিরাজ উদ্দিন আহমেদের দীর্ঘদিনের কর্মস্থল যশোর এম এম কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রফেসর এস. এম. ইবাদুল হক বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে পাক হানাদারদের হাতে শহীদ হয়েছেন কলেজের দুইজন শিক্ষক ও ছয়জন শিক্ষার্থী। তাদের স্মরণে কলেজ প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ ‘মূর্তিহীন চেতনায় চিরঞ্জীব’ নির্মাণ করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। সেখানে লিপিবদ্ধ আছে প্রভাষক সিরাজ উদ্দিন ও প্রভাষক নবীন চন্দ্র ঘোষসহ কলেজের ছয়জন শিক্ষার্থীর নাম।

শহীদ সিরাজ উদ্দিন আহমদ ১৯৫৩ সালে ভিক্টোরিয়া স্কুল (বর্তমানে মানিকগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগে ঢাকা বোর্ডে নবম স্থান অধিকার করেছিলেন। একই কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করার পর ১৯৬৪ সালে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজে। চাকরি পাওয়ার তিন বছর পর, ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। প্রথম পর্যায়ে স্বামী-স্ত্রী এবং এরপর এক বছরের ছেলে সন্তানকে নিয়ে যশোর শহরের ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা।

শহীদ সিরাজ উদ্দিন আহমেদের বাবা ছিলেন মানিকগঞ্জ মুন্সেফ কোর্টের সেরেস্তাদার। বড় ভাই শফিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন ওই কোর্টের নাজির, মেঝ ভাই জালাল উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সেখানকার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আর সেজ ভাই নুর উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সহকারী রেজিস্টার। তৎকালীন সময়ে হাতেগোনা যে কয়েকটি শিক্ষিত পরিবার ছিল তার মধ্যে শহীদ সিরাজ উদ্দিন আহমেদ অন্যতম।

শহীদ সিরাজ উদ্দিন আহমেদের চার ভাই-বোনের মধ্যে একমাত্র জীবিত আছেন তার সেজ ভাই নুর উদ্দিন আহমেদ। ৮৪ বছর বয়সী এই সিনিয়র সিটিজেনের কাছ থেকে শুনছিলাম মেধাবী সিরাজ উদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে। তার মতে, তিনি ছিলেন স্বাধীনতাকামী এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি শহীদ হন। এক বছরের ছেলে সন্তান সাইদ আহমেদের বয়স এখন ৪৯ বছর। বাবার আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত সেই সন্তান এখন স্বাধীনতা সংগ্রামে তার পিতার আত্মোৎসর্গের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাক্ষরিত পত্র আছে। আছে, সেই সময়ে জাতীয় গণমাধ্যমে বর্বর এই হত্যাকাণ্ডের প্রকাশিত সংবাদের কপি। কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ যেখানে পাথরের ওপরে খোদাই করে লেখা আছে তার নাম। আছে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়ণপত্র। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদনপত্রের ওপর ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সুপারিশও রয়েছে। এতকিছুর পর আর কী কী থাকলে তার নাম শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় উঠবে-এমন প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৮৪ বছর বয়সী সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী রেজিস্টার নুর উদ্দিন আহমেদের দৃঢ় বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তামান প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বিষয়টি বিবেচনা করবেন।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মানিকগঞ্জ জেলা ইউনিটের কমান্ডার তোবারক হোসেন লুডু বলেন, তিনি মন্ত্রণালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজ উদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে জানিয়েছেন। তিনি সুপারিশও করেছেন, যাতে তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করেন।

জেবি

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
‘বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির প্রেরণার উৎস’
‘দেশকে ভালোবাসতে হলে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হবে’ 
‘বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু’
রেড ক্রিসেন্ট’র স্বাধীনতা দিবস উদযাপন
X
Fresh