• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

নিঝুম দ্বীপের মায়াবিনীদের জীবন

মাজহার খন্দকার

  ০৩ জুলাই ২০১৬, ১৬:১৪

বঙ্গোপসাগরের ‍বুকে জেগে ওঠা এক চর, যেখানে কোনো জনবসতি না থাকায় পরিবেশ ছিল নিশ্চুপ। আর তা থেকেই এর নামকরণ হয় নিঝুম দ্বীপ। যাকে আইল্যান্ড অব সাইলেন্স বা নিঃশব্দের দ্বীপও বলা হয়।

প্রায় ৯১ বর্গ কিমি আয়তনের এই দ্বীপে এখন অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের বাস। তবে বনের সজীবতা আর সেখানকার মায়াবি চিত্রা হরিণগুলো বাংলাদেশের যেকোনো গ্রাম থেকে একে আলাদা করে রেখেছে। দ্বীপের বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে এই বন, যেখানে প্রায় ১২-১৫ হাজার হরিণের বসবাস। নিঝুম দ্বীপবাসীর সঙ্গী হয়ে উঠেছে এরা। মানুষ আর বনের নিরীহ প্রাণীর অপূর্ব মিলন শুধু এই দ্বীপেই দেখা যায়।

কথিত আছে, নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ছোট্ট এই দ্বীপে ওসমান নামের এক ব্যক্তি প্রথম মহিষের পাল নিয়ে বসতি গড়েন। তার নামেই এটি ওসমানের চর হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে সত্তরের দশকের পর নিঝুম দ্বীপ নামে এর নামকরণ হয়।

বিরাটাকৃতির শ্বাসমূলীয় বনটিতে বন বিভাগের কার্যক্রমও শুরু হয় ওই সময়েই। ১৯৭৮ সালে নিঝুম দ্বীপে সর্বপ্রথম সুন্দরবন থেকে চার জোড়া চিত্রা হরিণ অবমুক্ত করা হয়। তাদেরই বংশধরদের সংখ্যা এখন প্রায় ১৬ হাজার ছাড়িয়েছে, দাবি বন বিভাগের। আশেপাশের চরগুলোতেও ছড়িয়েছে পড়েছে নিঝুম দ্বীপের হরিণ।

সুন্দরবনের আদলের এই বনে হিংস্র প্রাণী না থাকায় মনের আনন্দেই চলাফেরা করতে পারে বনের হরিণগুলো। হঠাৎ হঠাৎই রাস্তার পাশে চলে আসে এসব হরিণ। স্থানীয় মানুষেরা কোনোভাবেই তাদের ক্ষতি করেন না। এক্ষেত্রে বন বিভাগের কঠোর নজরদারিও রয়েছে।

নিঝুপ দ্বীপের বাসিন্দা আনোয়ার বলেন, ‘হরিণ আমাদের সম্পদ। আমরা এদের মারি না। বরং বাঁচাই। অনেক সময় কাঁদায় আটকে গিয়ে বিপদে পড়ে ওরা। আমরা তাদেরকে উদ্ধার করে আবার বনে দিয়ে আসি। এরা আমাদের ঘরে পোষা প্রাণীগুলোর মতোই’।

নিঝুম দ্বীপকে ২০০১ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। এখানে চিত্রা হরিণ ছাড়াও মেছো বাঘ, শিয়াল ইত্যাদি প্রাণী পাওয়া যায়। রয়েছে নানা প্রজাতির পাখিও।

পর্যটকরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েই হরিণ দেখতে পারেন। এটাই এখানে বেড়ানোর মূল আকর্ষণ। তবে বেশি হরিণ দেখতে কিছুটা অপেক্ষা করতে হয়। জোয়ার চলে যাবার পর খাবারের সন্ধানে তারা বের হয়ে আসে। এজন্য নীরবে অপেক্ষা করতে হয়। নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের সঠিক সময় শীতকাল। এ সময় নানা প্রজাতির পাখির দেখাও মেলে।

তবে যেকোনো সময় হরিণগুলোর চপলতা মুগ্ধ করবে যে কাউকেই। তবে খুব বেশি শব্দ পেলে দ্রুতই তারা বনের ভেতরে লুকিয়ে পড়ে। অপরিচিত শব্দ চিনে ফেলে তারা। রাস্তা দিয়ে নিত্য চলাচল করা মোটরসাইকেলের শব্দ তাদের বিচলিত না করলেও তাদের দেখে যেকোনো পর‌্যটকেরে উচ্ছ্বাস বুঝতে পারে তারা। তাই স্থানীয় লোকদের সামনে নির্দ্বিধায় বনের কূল ঘেঁষে চরে বেড়ালেও অপরিচিত কারো উপস্থিতিতে বেশ লাজুক আর সতর্ক মায়াবি এই প্রাণীটি।

ঘাস লতা-পাতাই তাদের প্রধান খাদ্য। দিনের একটা সময় তারা দলবেধে ঘুরতে বের হয়। দলে একজন দলপতি থাকে। কোনো শব্দ বা বিপদের আঁচ পেলে সেইই সবার আগে সামনে এসে দাঁড়ায়। এমন অবস্থায় দল কোনদিকে যাবে সে সিদ্ধান্তও দলপতিকে নিতে দেখা যায়।

বর্ষাকাল হরিণগুলোর জন্য বিপদের সময় বলা যায়। জোয়ার বেশি থাকায় প্রতিদিন বন্যার মতো পরিস্থিতি হয় বনে। ফলে কাঁদা-পানিতে ডুবে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে।

এমন পরিস্থিতিতে এলাকাবাসীর পাশাপাশি বন বিভাগও তাদের নিয়মিত টহলের মাধ্যমে হরিণগুলোকে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর পরে এমনই একটি হরিণ শাবককে কুড়িয়ে পায় বন বিভাগ। তাকে নিয়ে এসে সুস্থ করে তোলা হয়। মাতৃহীন অন্য আরেকটি হরিণ শাবককেও একইসঙ্গে বড় করে তোলার দায়িত্ব পালন করছেন বন কর্মকর্তারা।

বন বিভাগের নিঝুপ দ্বীপের বিট কর্মকর্তা মোহাম্মদ নূরে আলম হাফিজ বলেন, ‘স্থানীয় লোকজন হরিণের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। আমরাও সব সময় চেষ্টা করি নিরীহ প্রাণীগুলোকে বাঁচাতে’।

রোয়ানুর পর পাওয়া শাবকটির নামও আদর করে রোয়ানু রেখেছেন এই কর্মকর্তা। তাদেরকে বাঁচাতে প্রতিদিন গরুর দুধ কিনে খাওয়াতে হচ্ছে। বড় হবার পরে তাদেরকে বনে ছেড়ে দেয়া হবে বলেও জানান নূরে আলম।

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh