• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

দুবাইয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ‘দাউদ ইব্রাহিম’ খ্যাত শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী সাইফুল

টেকনাফ প্রতিনিধি

  ০৬ জুন ২০১৮, ১৭:১১

দেশে মাদকবিরোধী কঠোর সাঁড়াশি অভিযান শুরু হওয়ার পর টেকনাফসহ জেলার অসংখ্য ইয়াবার গডফাদার ও ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে চলে গেছে। কেউবা চলে গেছে সৌদি আরবে ওমরা পালন করতে। আবার অনেকেই তাবলীগ জামাতে শরিক হয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

এছাড়া টেকনাফের অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। অনেকেই চিকিৎসার নামে ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। বাংলাদেশে ইয়াবার ‘দাউদ ইব্রাহিম’ খ্যাত, দেশে ইয়াবার প্রধান শীর্ষতম ব্যবসায়ী টেকনাফের সাইফুল করিম বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে আনন্দে সময় পার করছেন। এইসব খবর একাধিক নির্ভরশীল ও দায়িত্বশীল সূত্রের।

--------------------------------------------------------
আরও পড়ুন : খুলনায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ৩
--------------------------------------------------------

বর্তমানে টেকনাফের সাধারণ মানুষ বলেছে, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের ত্যাগী কর্মী, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি একরামুল হক কাউন্সিলর যখন বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়, ঠিক সে সময়ে বাংলাদেশে ইয়াবার জন্মদাতা, ইয়াবা রাজ্যে ‘দাউদ ইব্রাহিম’ খ্যাত টেকনাফের সাইফুল করিম বরাবরের মত সকল ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। কয়েকদিন আগে দুবাই পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশে ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা আয় করে সেখানে রাজকীয় জীবন যাপন করছে তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকনাফ সীমান্ত হয়ে মিয়ানমার থেকে এদেশে ইয়াবা পাচার শুরু হওয়ার পর থেকে এক যুগের বেশী সময় ধরে এই সাম্রাজ্যের একছত্র অধিপতি হিসাবে যার নাম উচ্চারিত হয় তিনি টেকনাফের সাইফুল করিম। এই ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রক হয়েও আজও ধরা ছোঁয়ার বাইরে তিনি। এই কারণে তাকে বোম্বের দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে তুলনা করেন সীমান্তের মানুষ। দাউদ ইব্রাহিমের মতোই নাকি অধরা, ক্ষমতাবান আর রহস্য পুরুষ টেকনাফের এই সাইফুল করিম। ক্ষুরধার তীক্ষ বুদ্ধি, মিয়ানমার ভাষায় পারদর্শিতা, আর দেশব্যাপী বিস্তৃত তার নেটওয়ার্ক। শোনা যায় তার নিজের এলাকা উপজেলা টেকনাফে মিডিয়ার বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি জেলার মিডিয়া জগতের শক্তিশালী একটি অংশও তার নিয়ন্ত্রণে। এই কারণে তাকে নিয়ে খুব বেশী লেখালেখিও হয় না। মিডিয়ার এই অংশটি বরাবরই তাকে নিরাপদ রাখতে টেকনাফ স্থল বন্দরের একজন বৈধ ব্যবসায়ী হিসাবে প্রচার করে থাকেন।

তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৭৬৪ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর যে তালিকা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ৭ জনকে অত্যধিক প্রভাবশালী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাতে তার নাম ছিল এক নাম্বারে। এছাড়া ১ হাজার ১৫১ ও সর্বশেষ ৬০ জন গডফাদারের যে তালিকা করা হয়েছে তাতেও তার নাম রয়েছে সর্বাগ্রে। তারপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে সাইফুল করিম।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের মাদক নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানালে দেশব্যাপী মাদক বিরোধী অভিযান শুরু হয়। বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও সাইফুল করিম এখনো অধরা।

ভারতের দাউদ ইব্রাহিমের মতো সাইফুল করিমকে নিয়ে নানা গল্প চালু রয়েছে সীমান্ত এলাকায়। সাইফুল করিম তার ইয়াবা পার্টনারদের দম্ভ করে নাকি বলে থাকেন, এই দেশে এমন কেউ তৈরি হয়নি যারা নৌ অথবা সড়ক পথে তার ইয়াবার চালান আটকের ক্ষমতা রাখে। এইসব কাহিনীর সত্যতা জানা না গেলেও সীমান্ত এলাকায় মানুষ যখন ইয়াবা নিয়ে আলোচনা করেন তখনই সাইফুল করিমের নামটি সবার আগে উঠে আসে।

অল্পসময়ে তার উত্থান ও মাফিয়া জগতের কিং হয়ে উঠার পেছনের রহস্য অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে উঠে আসে চমকপ্রদ সব কাহিনী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে মিয়ানমারের আরাকান থেকে টেকনাফে এসে শীলবুনিয়া পাড়া এলাকায় বসতি গড়েন সাইফুল করিমের পিতা হাতুড়ে ডাক্তার মোহাম্মদ হানিফ। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর পুনরায় সপরিবারে মিয়ানমারে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসলে ফের ফিরে আসে টেকনাফে। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনের কারণে এবং হাতুড়ে ডাক্তার হিসাবে টেকনাফে তেমন সুবিধা করতে না পেরে চট্টগ্রামে পাড়ি জমান হানিফ। কিন্তু দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে থেকেও তিনি নিজের হাতে ভাগ্য পরিবর্তন করতে না পারলেও ইয়াবা ব্যবসার বদৌলতে তার দশ সন্তানের একজন সাইফুল ভাগ্য বদলে দেন গোটা পরিবারের।

যে পরিবারটি একদিন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এদেশে আসে সেই পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে জমিদারী ভাব-সাব আর আভিজাত্য নিয়ে চলাফেরা করেন শুধুমাত্র ইয়াবা ব্যবসার কালো টাকার বদৌলতে। বর্তমানে দেশব্যাপী তাদের সম্পদের পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্য চালু হবার কয়েক বছর পর সিএন্ডএফ কর্মচারী হিসাবে শূন্যতাতে চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফে আবির্ভাব ঘটে সাইফুল করিমের। এর কয়েক বছর পর তিনি সে সময়ের ক্ষমতাসীন দল বিএনপির প্রভাবশালী নেতা আব্দুল্লাহর এক বোনকে বিয়ে করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। আব্দুল্লাহর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় টেকনাফ স্থল বন্দরের আমদানি রপ্তানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নেয় সাইফুল গ্রুপ। আর মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানির আড়ালে গোপনে পাচার হতে থাকে ইয়াবার বড় বড় চালান। এভাবে অল্পদিনে জিরো থেকে হিরো বনে যান তিনি। সাধারণ সিএন্ডএফ কর্মচারী থেকে শত কোটি টাকার মালিক বনে যান সাইফুল। পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার।
অর্থবিত্তের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে তিনি গড়ে তোলেন গভীর সখ্যতা। শুধু তাই নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্কের অভিযোগ রয়েছে।

পরে পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে ইয়াবাসক্ত ঐশীর হাতে বাবা-মা খুন হওয়ার পর দেশব্যাপী ইয়াবা নিয়ে হৈ চৈ ও টেকনাফে ইয়াবা বিরোধী অভিযানে ক্রসফায়ারে কয়েকজন নিহত হলে সাইফুল গা ঢাকা দেন। পালিয়ে চলে যান পূর্বপুরুষদের আবাসস্থল মিয়ানমারে। কিছুকাল মিয়ানমারে অবস্থান করার পর পুনরায় ফিরে আসেন বাংলাদেশে। অবস্থান করতে থাকেন চট্টগ্রামে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলে কক্সবাজার ও টেকনাফে আনাগোনা শুরু করেন তিনি। এইবার ইয়াবা পাচারে নতুন পথ খুঁজতে শুরু করেন সাইফুল। সাগর পথে ইয়াবার চালান নিয়ে আসতে ক্রয় করেন বিদেশী অত্যাধুনিক মাছ ধরার জাহাজ। এইসব জাহাজে নিরাপদে নৌ পথে তার ইয়াবার বড় বড় চালান পৌঁছে যেতে থাকে চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনাসহ সারাদেশে।

জানা যায়, সাইফুলের ইয়াবা সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ হচ্ছে মিয়ানমারে এ ব্যবসায় সম্পৃক্ত আপন মামা, খালুসহ নিকটাত্মীয় থাকা ও মিয়ানমার ভাষায় সাইফুলের দক্ষতা।

চট্টগ্রাম শহরকেই সাইফুল বর্তমানে নিরাপদ হিসাবে বেছে নেয়ার কারণ হিসাবে জানা যায়, তার আপন ভাইরা রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চ পদস্থ একজন কর্মকর্তা হিসাবে চট্টগ্রামে রয়েছেন। ইয়াবা বিরোধী লেখালেখি অথবা ধরপাকড় শুরু হলে এই কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় আত্মগোপন করেন সাইফুল। সেই কর্মকর্তার বাড়িও টেকনাফে। টেকনাফে নিজের ভিত শক্ত করতে গেল পৌর নির্বাচনে তার এক ভগ্নীপতিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর ও পরবর্তীতে প্যানেল মেয়র নির্বাচিত করতে ভূমিকা রাখেন সাইফুল। শোনা যায়, সে সময় টেকনাফে অবস্থান করে মোটা অংকের বিনিময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করান তিনি।

কিছুদিন আগে কক্সবাজারে যৌথভাবে চট্টগ্রাম মহানগরীর এক থানায় কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাসহ পাহাড়ি এবং সাগরতীরে আবাসিক ও হোটেল নির্মাণ নিয়ে পুনরায় আলোচনায় আসেন সাইফুল করিম। তবে আলোচনা আলোচনা পর্যন্তই।

জানা যায়, বছর তিনেক আগে ঢাকায় ইয়াবা তৈরির মেশিনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিলেন সাইফুলের ম্যানেজার। এছাড়া গত কিছুদিন আগে সাইফুলের আপন ভগ্নীপতি ও ব্যবসার অংশীদার মৌলভী সাইফুলের ইয়াবার বিশাল চালান নিয়ে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া পুলিশের হাতে আটক হলেও রহস্যজনক কারণে এসব মামলায় সাইফুলের সম্পৃক্ততা খোঁজার চেষ্টা করেনি সংশ্লিষ্টরা। তাই সীমান্ত জনপদের মানুষ এখন ইয়াবা সাম্রাজ্যের দাউদ ইব্রাহিম হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন সাইফুলকে।

টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রণজিৎ কুমার বড়ুয়া বলেন, গেলো পরশু সাইফুল করিমের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। তবে তাকে পাওয়া যায়নি। সব সোর্সকে খবর পাঠানো হয়েছে। তবে যেভাবে হোক গ্রেপ্তার করা হবে।
তিনি আরও বলেন, শুধু সাইফুল করিম নয় যত মাদকব্যবসায়ী আছে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হবে।

আরও পড়ুন :

এসএস

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
আখাউড়ায় ১৮০০ পিস ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক 
শ্রীপুরে পিস্তল ও ইয়াবাসহ যুবক গ্রেপ্তার 
গাঁজাগাছ-ইয়াবাসহ আটক ২
পাথরঘাটায় ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
X
Fresh