‘ওরা আমার কুড়িয়ে পাওয়া সোনা মানিকের বুক ঝাঁঝরা করে দিছে’
কিশোর সিয়াম তার জন্মদাতা বাবা-মার চেহারা মনে রেখেছিলেন কি না তা কেউ জানে না। কিন্তু পালক বাবা-মায়ের আদর ভালোবাসায় এই নশ্বর পৃথিবীতে বেড়ে উঠছিলেন তিনি। সেই সিয়াম আর নেই। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের অপরাজনীতি ও ক্ষমতার নীল বিষে হারিয়ে গেছে সিয়ামের কচি প্রাণ। খেটে খাওয়া নিম্ন আায়ের পরিবার বলেই হয়তো সিয়ামের প্রাণের মূল্য হয়ে ওঠেনি দুর্মূল্য। কারও নজরে নেই তার পালক বাবা-মা ও ভাই-বোনদের।
বগুড়া শহরের সেউজগাড়ীর আমতলা মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে পুলিশ এবং আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলাকালে গুলিতে প্রাণ হারায় সিয়াম শুভ (১৬)। সে পাশের হাড্ডিপট্টি এলাকায় তার পালক বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতো।
সাত বছর আগে সিয়ামকে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনে কুড়িয়ে পান তার বর্তমান মা হাড্ডিপট্টি বস্তির বাসিন্দা শাপলা বেগম (৫১)। সে সময় তার বয়স ছিল নয় বছর। পরে বাড়িতে নিয়ে আশিক-শাপলা দম্পতি সিয়ামকে লালনপালন করেন। কখনও ভাঙারির দোকানে কাজ করতো সিয়াম। কখনওবা বাবার সঙ্গে বাসে হেলপারি করতো সংসারে বাড়তি আয়ের জন্য।
সিয়ামের পরিবার ও প্রতক্ষ্যদর্শীদের কাছে জানা যায়, ১৯ জুলাই বিকেল ৩টার পর কাজ শেষে নানার কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতে যায় সিয়াম। বিকেল ৪টার দিকে বগুড়া সেউজগাড়ী আমতলা মোড়ে আন্দোলনকারীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। বিকেল ৫টার পরে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ সেখানে জলকামান দিয়ে গরম পানি ছিটিয়ে আন্দোলনকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
একপর্যায়ে পুলিশ আর্মড পারসোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি) থেকে নেমে শর্টগান থেকে অসংখ্য গুলি শুরু করে। গোলাগুলিতে দৌড়ে সেখান থেকে সরে যাওয়ার সময় জলকামানের পানিতে পা পিছলে রাস্তায় পড়ে যায় সিয়াম। রাস্তা থেকে ওঠার সময় তার সারা শরীরে পুলিশের ছররা গুলি লাগে বলে জানায় তার সঙ্গে আন্দোলনে থাকা একাধিক শিক্ষার্থী। পরে তাকে কাছেই অবস্থিত বগুড়া নার্সিং হোমে নেওয়া হয়। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ দেখে তাকে পাঠানো হয় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ওই দিন সন্ধ্যায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক মো. সালেহ জানান, সিয়ামের সারা শরীরে ছররা গুলি ঢুকে যাওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।
হাড্ডিপট্টি বাসস্ট্যান্ডের নৈশ্যপ্রহরী ফারুক হোসেন বলেন, শনিবার সিয়ামের মরদেহ আমরাই গোসল করাই। তখন তার শরীরে অসংখ্য গুলির আঘাতের চিহ্ন দেখেছি। যখন আমরা এখানে গোসল করিয়ে দিচ্ছিলাম, তখনও পুলিশ এসে এখানে গুলি করে যায়। মরদেহ রেখে কিছু সময়ের জন্য আমাদের দৌড়াতে হয়েছিল।
ফারুক আরও জানান, অনেক রিস্ক নিয়ে পুলিশের ভয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে মাত্র কয়েকজন মিলে বগুড়ার কেন্দ্রীয় কবরস্থান নামাজগড়ে দাফন করা হয় সিয়ামকে।
সিয়ামের পালক বাবা-মায়ের খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, শাপলা নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় ঠিকমতো চলতে পারেন না তিনি। এদিকে ছেলে হারানোর শোকেও কাতর হয়ে আছেন। শোক কাটাতে পারছেন না কোনমতেই।
শাপলা খাতুন বলেন, পেটের ছোল হলেই নিজের ছোল হয় না, ভাই। অনেক সময় কুঁড়ে পাওয়া ছোল পেটের ছোলের চেয়ে আপন হয়। সিয়াম আমার তেমন ছোল। আমরা ওকে পড়ালেখা করাতে চাইছিলাম। কিন্তু ও নিজেই আর পড়ল না। ছোট থেকেই টাকা কামাই করে এনে আমাকে দিত। বলতো আম্মু আমি থাকতে তোমার কোনো কষ্ট হবে না। সেই ছোলটাক গুলি করে মারলো। আমার কুড়ে পাওয়া সোনা মানিকের বুক ঝাঁঝরা করে দিছে।
সিয়ামের পালিত বাবা মো. আশিক (৫৭) জানান, তার বাবা-মা কি করতো সেটা আমরা জানি না। যখন সিয়ামকে কুড়িয়ে পাই তখন ওর বয়স ছিলো নয় বছর। সে আমাদের যেটুকু বলেছে সেটাই জানি। সে আমাদের বাড়িতেই ছিল। ছোট বেলায় অল্প কিছুদিন লেখাপড়া করেছে। পরে বড় হওয়ার পর আর লেখাপড়া করেনি। আমাদের আর দুই ছেলে দুই মেয়ে রয়েছে। তারা লেখাপড়া করে।
গত ১৯ জুলাই সিয়ামের শহিদ হওয়ার শোক কাটাতে না কাটাতে নতুন বিড়ম্বনায় পড়ে দিনমজুর পরিবারটি। গত ২১ জুলাই বগুড়া সদর থানায় সিয়াম নিহতের ঘটনায় মামলা হয়। এজাহারে বলা হয়, আন্দোলনকারীদের ছোঁড়া ককটেল বিস্ফোরণে আহত হয়ে সিয়াম শুভ নিহত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, তৎকালীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় লোকজন সিয়াম ও তার পালক বাবা-মায়ের নামে মাদক ব্যবসায়ীর তকমা লাগিয়ে দেয়। এটা নিয়ে শাপলা ও তার স্বামী আশিককে অনেকভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়।
গত ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর চিত্র পাল্টাতে শুরু করে। সিয়ামের নিহতের ঘটনায় করা সাজানো মামলাটি খারিজ হয়। এরপর শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে শাপলা খাতুন বাদি হয়ে মামলা করেছেন।
শাপলা খাতুন জানান, আমি এখন সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকি। সিয়াম ও তার বাবা সংসারের সব খরচ দেখত। এখন সিয়াম নাই। ওর বাপেরও কাজ নাই। ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচের চাপ। কোন দিকে যাবো কিছু জানি না। এখন পর্যন্ত তেমন সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে কেউ আসেনি। স্থানীয়ভাবেও কেউ এগিয়ে আসেনি।
সিয়ামের মা আরও জানান, চার নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা হিসেবে অনেক দিন ধরে প্রতিবন্ধী কার্ড করে নেয়ার জন্য ঘুরতেছি। দুজন কাউন্সিলর চলে গেল। আমার কার্ড হলো না। সিয়ামের বাপের একটা কাজ হলে তাও সংসার চালানো যায়। সিয়াম খালি বলত, আম্মু আমি থাকতে তোমার কোনো কষ্ট নাই। এখন সিয়াম নাই। আমাদের কে দেখবে?-বাসস।
আরটিভি/এসএপি
মন্তব্য করুন