• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

‘বাচ্চাদের ছুড়ে মেরে আমাদের সামনেই মেয়েদের ধর্ষণ করেছে’

সরোয়ার আমিন বাবু/মুহাম্মদ শাহীনুজ্জামান, চট্টগ্রাম

  ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:৫২

রাখাইনে চলমান সহিংসতায় প্রতিদিনই মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ পালিয়ে আসছে হাজারো রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে অনেকেই আহত। এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

৬ বছরের রাহমাতুল্লাহ বাঁপাশের তলপেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ১১ নম্বর ওয়ার্ডে শুয়ে আছে ১ সেপ্টেম্বর থেকে। মংডুর দক্ষিণে চুম্মাইন্না গ্রাম থেকে এসেছে সে। আরটিভি অনলাইনকে রোহিঙ্গা শিশুটি জানায়, বার্মার মিলিটারি-পুলিশ তাকে গুলি করেছে, অনেক ব্যথা পেয়েছে সে। তার বাবা চিকিৎসার জন্য এখানে নিয়ে এসেছে।

রাহমাতুল্লাহ’র বাবা হাফিজুল্লাহ (৩৫) বলেন, ‘আঁরা রোহিঙ্গা, ইতাল্লাই বার্মার মিলিটারি আঁরারে মারের, বেশি বেশি জুলুম গঁরের, বেগ্গুনরে গুলি গঁরের, মারের, কাডের, জবাই গঁরের, ঘরবাড়ি পোড়াই দের, কিচ্ছু নো রাহের’(আমরা রোহিঙ্গা, এজন্য বার্মার মিলিটারি আমাদেরকে মারছে, সবাইকে গুলি করছে, কাটছে, জবাই করছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, কিছু রাখছে না)।

তিনি জানান, আমি ঘরে ছিলাম না, বাইরে গিয়েছিলাম। এসে দেখি কাউকে না পেয়ে আমার বাচ্চাটাকে গুলি করছে। প্রাণ বাঁচাতে ওকে নিয়ে অনেক কষ্ট করে এখানে এসেছি। বার্মায় আরো অনেক মানুষ বহু কষ্টের মধ্যে আছে, জান বাঁচাতে এসে বহু মানুষ সাগরে ডুবে মারা গেছে।

চমেকে গুলিবিদ্ধ, মাইনে ক্ষত বিক্ষত হয়ে, আগুনে পুড়ে এবং বিভিন্নভাবে আহত হয়ে এ পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে এসেছে ৮৯ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন দুজন। চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন ১০ জন। আর বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ৬২ জন। এর মধ্যে ১৮ বছরের নিচে চিকিৎসাধীন শিশু, কিশোর-কিশোরী আছেন ২১ জন।

মংডু জেলার জিমানখালি গ্রামের বাসিন্দা শামসুল আলম (২৫) গেলো ২৬ আগস্ট থেকে চিকিৎসাধীন। তাকে এমনভাবে গুলি করা হয়েছে যে তার একটি হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। শামসুল বলেন, ‘রাতে বার্মার মিলিটারি এসে পাড়া ঘিরে ফেলল। আমরা তিনজন একটি ঘরে ছিলাম। পালানোর সময় মিলিটারিরা ২ জনকে গুলি করে মেরে ফেলল। গুলি খেয়ে আমি ছড়ার মধ্যে পড়ে গেলাম। পরে আমার এক বন্ধু আমাকে কাঁধে করে নিয়ে এপাশে পার করে দিয়েছে। মিলিটারিরা রোহিঙ্গাদের কিছুই রাখছে না। ঘর-দুয়ার সব জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মেয়েদেরকে আমাদের সামনেই ধর্ষণ করেছে। বাচ্চাদেরকে পেলে ছুড়ে মারে, কেটে ফেলে।’

মংডুর আকিয়াবের মেদি গ্রাম থেকে আসা মোক্তার মিয়া (২৩) বলেন, আমাদের পাড়া ঘিরে রেখে গুলি মারছিল মিলিটারিরা। তখন পালানোর সময়ে আমার গায়ে গুলি লাগে। এর দুদিন পর কক্সবাজারের কুতুপালং শিবিরে এসে পৌঁছাই। পরে এখানে চিকিৎসার জন্য এসেছি।

মোক্তার মিয়ার দেখাশোনা করছেন তার শাশুড়ি শাহেদা বেগম (৪৫)। তিনি বলেন, বার্মায় আমাদের রোহিঙ্গাদের ওপর খুব বেশি বেশি অত্যাচার চলছে। মিলিটারিরা আমাদের বলে- তোমরা রোহিঙ্গারা এ দেশের না, বাংলাদেশে চলে যাও। ৪ থেকে ৫ বছর ধরে আমাদের এলাকার সব স্কুল, মাদরাসা বন্ধ করে দিয়েছে। হাল চাষ করলে টাকা দিতে হয়, ধান কাটার সময়েও টাকা দিতে হয়। এখন তো আমাদের ওপর গুলি চালানো শুরু করেছে, তাই আমার বাংলাদেশে চলে এসেছি।

তিনি আরো বলেন, এবারের অত্যাচারের মাত্রাটা একবারে সীমা ছাড়িয়ে গেছে। যে পাড়া ঘিরে ফেলে সে পাড়া আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে, একজনকেও রাখেনি। আমাদের পাড়াতে যখন গুলি চালানো শুরু করল, তখন অনেকেই মারা যায়। কেউ কেউ গুলি খেয়ে পালাতে পেরেছে। তাদেরকে বাংলাদেশ চিকিৎসা দিচ্ছে। অনেক কষ্ট করে আমার মেয়ের জামাইকে নিয়ে কুতুপালং আসার পর সেখান থেকে এখানে পাঠিয়েছে। এখানে ভালো চিকিৎসা দিচ্ছে। আমি বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ।

বার্মায় নিজের ভিটেবাড়িতে ফিরে যাবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিয়ানমারে আর যেতে চাই না। তবে অন্য রাষ্ট্রগুলো যদি নিশ্চয়তা দেয় যে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আমাদের আর জ্বালাবে না, পোড়াবে না, গুলি করে মারবে না তাহলে ফিরে যাব, নইলে যাব না।

ওই জেলার আকিয়াবের কাছে মেরুল্লাহ গ্রাম থেকে পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এসেছেন আসমত উল্লাহ (২৭)। তিনি বলেন, মিলিটারি যাকে যেখানে পেয়েছে গুলি করেছে, বোমা মেরেছে। আমার বাড়ি পুরো জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমাদের গ্রামে ৪০ জন মারা গেছে। আমার পরিবার কোথায় আছে জানি না।

আসমত উল্লাহকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বাবা হাসিম উল্লাহ (৫৫) এখানে নিয়ে এসেছেন। যখন আমার ঘর জ্বালিয়ে দিল তখন সবাই দৌড়ে পালাতে শুরু করলাম। গুলিতে আমার ২ ছেলে সেখানেই মারা গেল। এই ছেলেকে নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে এসেছি। পরে আমার বিবি-বাচ্চা, নাতিসহ ১১ জনের আর খোঁজ পাইনি। মুসলমান বললেই মেরে ফেলে, মগ বললে কিছু বলে না। এই মগদের কাছ থেকে আমরা আমাদের দেশের স্বাধীনতা চাই, স্বাধীন হলে আমরা সবাই একসঙ্গে চলে যাব।

তিনি কোথায় থাকছেন, খাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত পাঁচ দিনে মাত্র দুই বেলা খেয়েছি। তবে গুলিবিদ্ধ ছেলে যে এখানে চিকিৎসা, ওষুধ ও খাবার পাচ্ছে তাতেই আমি খুশী।

মংডুর তম্বুরু থানার বালুকালি গ্রামের কিশোরী খালেদা আক্তার (১৭) বলেন, ‘পালানোর সময়ে বাম পায়ের উরুতে ২টি এবং হাঁটুর নিচে ১টি গুলি লাগে। এই কিশোরী বলেন, মিলিটারি আমাকে গুলি করেছে। আমার আব্বাকে মেরে ফেলেছে। আমার মাও গুলি খেয়ে পড়ে গেছে। ব্যথায় আমার গায়ে এখন জ্বর।’

খালেদা আক্তারকে দেখাশোনা করছেন তার আত্মীয় নুর আংকিস (২১)। তিনি বলেন, সেনারা মেয়েদের পেলে খুব নির্যাতন করে, আর পুরুষদের পেলে গুলি করে। আর এখানে কেউ এসে সহায়তা করলে ঠিকমতো খেতে পাই নইলে না খেয়ে থাকতে হয়।

চমেকের সেবিকা তত্ত্বাবধায়ক সিপরা চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থাই করা হয়েছে। তাদের জন্য আলাদা সেবিকা দেয়া হয়েছে। আমরা মানবিকতার জায়গা থেকে কোনো পার্থক্য করছি না।

চমেক পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আলাউদ্দীন তালুকদার বলেন, রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে মানবিক আচরণ করার নির্দেশনা রয়েছে। তাদের সুচিকিৎসায় যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তারা যাতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হন সেদিকে খেয়াল রাখছি। আমরা নিরাপত্তার পাশাপাশি মানবিক দৃষ্টিকোণ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তাদের প্রতি খেয়াল রাখছি।

এসএস/সি

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
১৪ মাস পর জামিনে মুক্তি পেলেন দানি আলভেজ
সাঁথিয়ায় গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার ৩ যুবক
ঘাপটি মেরে বসে আছে এক-এগারোর কুশীলবরা : পররাষ্ট্রমন্ত্রী 
আর্জেন্টিনায় নারী সাংবাদিককে ধর্ষণের অভিযোগে চার ফুটবলার আটক
X
Fresh