• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
logo

টাঙ্গাইলে ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান’ কর্মসূচিতে ব্যাপক অনিয়ম

টাঙ্গাইল (উত্তর) প্রতিনিধি, আরটিভি নিউজ

  ১৬ মে ২০২২, ২২:১৮

প্রকল্পের নাম ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান’ কর্মসূচি। স্থানীয়দের কাছে যা ৪০ দিনের কর্মসূচি নামে পরিচিত। সাধারণত এ প্রকল্পের মাধ্যমে রাস্তা মেরামত, নতুন রাস্তা নির্মাণসহ গ্রামীণ উন্নয়নের কাজ করা হয়।

এবারই প্রথম মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ এবং রকেটের মাধ্যমে জি টু পি পদ্ধতিতে শ্রমিকদের টাকা দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ সরকার থেকে সরাসরি শ্রমিক। স্বচ্ছতা বজায় রাখতে এ প্রক্রিয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নিবন্ধন করা সীম এবং বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে শ্রমিকদের নামের তালিকা করা হয়।

প্রকল্পের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা এজন্য উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার তদারকির পাশাপশি প্রতিটি ইউনিয়নে আরও একজন সরকারি কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকেন। প্রতিদিন কতজন শ্রমিক উপস্থিত থাকেন এবং প্রতিদিনের কাজের অগ্রগতি বিষয়ে ওই কর্মকর্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কাছে দিনের প্রতিবেদন জমা দেন।

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সাগরদিঘী ইউনিয়নে ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান’ প্রকল্পের স্বচ্ছ তালিকা প্রণয়নে এবং কর্মকর্তাদের কাজের তদারকির প্রতিবেদনে নাম রয়েছে কলেজ শিক্ষক, স্কুল শিক্ষক, পল্লী চিকিৎসক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতাসহ আরও অনেকের। তবে শ্রমিক নামধারী এসব লোকের দাবি এ বিষয়ে তারা কিছু জানেন না। শুধু সাগরদিঘী ইউনিয়ন নয়, অন্যান্য ইউনিয়নের তালিকাতেও এমন চিত্র দেখা গেছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চারটি প্রকল্পে ৮২ জন শ্রমিকের বিপরীতে সাগরদিঘি ইউনিয়ন বরাদ্দ পায় ১৩ লাখ ১২ হাজার টাকা। কাজ ছিল রাস্তা মেরামত। প্রকল্পের কাজ চলতি বছর জানুয়ারিতে শুরু হয়ে শেষ হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। একজন শ্রমিক এ কর্মসূচিতে নিয়মিত ৪০ দিন কাজ করলে তার প্রাপ্ত মজুরি হয় ১৬ হাজার টাকা। দুই ধাপে দেওয়া হয় মজুরির টাকা। ওই ইউনিয়নের শ্রমিকরা প্রথম ধাপে টাকা না পেলেও দ্বিতীয় ধাপের টাকা পেয়েছেন।

প্রকল্পে শ্রমিকের তালিকায় ১১৪৬ নম্বরে নাম রয়েছে ঘাটাইলের ফুলমালিরচালা কারিগরী বি.এম.এ কৃষি কলেজের ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক মো.হাসান আলীর (৩৪)।

তিনি জানান, একদিন করিমগঞ্জ গ্রামের মেহের আলী নামে একজন এসে তাকে জানান কোনও এক কাজে চেয়ারম্যান তার ভোটার আইডিকার্ডের ফটোকপি এবং ছবি চেয়েছেন। সরল বিশ্বাসে তিনি দিয়ে দেন। এরপর তিনি তার ব্যবহৃত মোবাইল সীমকার্ডে ৭ হাজার ২৫০ টাকার একটি বার্তা দেখতে পান। পরে মেহের নামের ওই লোক এসে টাকা তুলে নিয়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- মেহের সাগরদিঘি ইউনিয়ন যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য। দীর্ঘদিন তিনি সিঙ্গাপুরে ছিলেন। তারও নাম রয়েছে এই তালিকায়।

মামুন হোসাইন প্যারা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন করিমগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পনের দিন আগে যোগ দিয়েছেন রফিক-রাজু স্কুলে। তালিকায় তারও নাম রয়েছে। তবে তালিকায় যে ফোন নম্বরটি দেওয়া আছে সেটি তার নয়। তবে বাড়ি থেকে কেউ একজন এসে কাগজপত্র নিয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

তালিকায় মজনু মিয়া ডিলারশীপের ব্যবসা করেন। সাগরদিঘি বাজারে মীম ইলেক্ট্রনিক্স, জোরদিঘী বাজারে মায়ের দোয়া ইলেক্ট্রনিক্স এছাড়াও সখীপুরের বড়চওনা বাজারেও রয়েছে তার ইলেক্ট্রনিক্সের শো-রুম। কামাল হোসেন একজন পল্লী চিকিৎসক। জোরদিঘি বাজারে আছে তার কামাল ফার্মেসি নামে দোকান। নাজমুল হক চাকরি করেন সখীপুরে। মাসুদ রানা সাগরদিঘি ইউনিয়ন পরিষদের কম্পিউটার অপারেটর। বাদ যায়নি প্রভাবশালীদের নামও। সাগরদিঘি এলাকার যে ক’জন বড় ব্যবসায়ী আছেন সোহরাব আলী তাদের মধ্যে একজন। ইদ্রিস আলী লিটন প্রায় দশবিঘা সম্পত্তির মালিক। রয়েছে লেবু ও কলার ব্যবসা। বাড়িতে দালানসহ কাদের সিকদারের সাগরদিঘি বাজারে রয়েছে সিকদার মার্কেট।

অভিযোগ রয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এনামুল হক দীর্ঘদিন ধরে ঘাটাইলে রয়েছেন। সবকিছু ম্যানেজ করেই এমন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। গড়েছেন অনিয়মের পাহাড়। তার স্বেচ্ছাচারিতা, তদারকির অভাব ও নিজ স্বার্থ হাছিলের কারনেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে কাজ না করে অর্থ আত্মসাতের জন্য চেয়ারম্যানের এমন অসংগতিপূর্ণ শ্রমিকের নামের তালিকা দেখে বিব্রত ওই ইউনিয়নের সদস্যরা। ২ নং ওয়ার্ড সদস্য শফিকুল ইসলাম জানান, তার জানামতে সাগরদিঘি ইউনিয়নে শ্রমিক দিয়ে কোনও কাজ হয়নি। সিকদারপাড়া মোড় থেকে বিমানপাড়া মোড় পর্যন্ত প্রকল্প দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোনও শ্রমিক ওই রাস্তায় কাজ করেননি।

তিনি আরও জানান, তার এলাকা থেকে নয়জন লোকের মোবাইল সীমকার্ড সংগ্রহ করে দিতে বলেন চেয়ারম্যান। পরে ছয়টা সীম চেয়ারম্যান রেখে তিনটা সীম তাকে দেন। সেই তিনটা সীমে সাত হাজার করে মোট ২১ হাজার টাকা জমা হয়। সেখান থেকে চেয়ারম্যান ১০ হাজার টাকা চাচ্ছেন।

৭ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য ফরহাদ আলী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন, ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান’ প্রকল্পে দশ টাকার কাজ হয়েছে এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না।

৫ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য সুরুজ মিয়া জানান, তাকে নয় জন শ্রমিক দেওয়া হয়েছিল কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। শ্রমিক নামধারী লোকদের মোবাইল থেকে টাকা উত্তোলণ করে জমা করা হয় ইউপি সচিবের কাছে। পরে তা ভাগ বাটোয়ারা করা হয়। একই সুর দু’একজন বাদে বাকি সব ইউপি সদস্যেদেরও।

এ বিষয়ে সাগরদিঘি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হেকমত সিকদার বলেন, টাঙ্গাইল জেলা এবং সারা দেশে যেভাবে কাজ হয় আমার এখানেও সেভাবে হয়েছে। শ্রমিকও কাজ করেছে, ভ্যাকু (মাটি কাটার যন্ত্র) দিয়েও কাজ করা হয়েছে। তবে শ্রমিকদের নামের তালিকায় স্কুল-কলেজের শিক্ষক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, পল্লী চিকিৎসক ও প্রভাবশালীদের নাম থাকার বিষয়সহ অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

ওই ইউনিয়নে শ্রমিক ও কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা (ট্যাগ অফিসার) উপজেলা সহকারি মৎস কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, শ্রমিক উপস্থিতি ছিল শতভাগ। কাজ
ভালো হয়েছে। বিল উত্তোলনের জন্য প্রকল্পে শ্রমিকদের তালিকায় যেসকল কর্মকর্তাদের সই লাগে সবাই তিনি করে দিয়েছেন।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এনামুল হক বলেন, আংশিক বিল দেওয়া হলেও শতভাগ শ্রমিকের বিল পরিশোধ করা হয়নি। এ ধরনের অনিয়মের প্রামাণ পেলে শ্রমিকের নামের তালিকা সংশোধন করে পরবর্তী বিল দেওয়া হবে। আর যদি শ্রমিক ব্যতিত অন্য কোনও উপায়ে প্রকল্পের কাজ করা হয়ে থাকে তবে কোনও বিল দেওয়া হবে না। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ইউএনও মুনিয়া চৌধুরী বলেন, আমি এ উপজেলায় যোগদানের আগেই ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। তবে এমনটা ঘটে থাকলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
পুকুরে ভাসছিল শিশুর মরদেহ, টানাটানি করছিল কুকুরে!
টাঙ্গাইলের শ্রেষ্ঠ ওসি ভূঞাপুর থানার আহসান উল্লাহ্
ঘুমন্ত স্বামীর পুরুষাঙ্গ কর্তন, স্ত্রী কারাগারে 
মধুপুরে আ.লীগের দু’পক্ষের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, আহত ৬
X
Fresh