• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
logo

‘ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে এতো সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে যাবো কোথায়’

জয়নুল আবেদীন, চট্টগ্রাম

  ২৭ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৪১

প্রতিবছরই চট্টগ্রামে বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে অসহায় ও দরিদ্র মানুষের মৃত্যুর ঘটনা অনেকটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে এখন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নেয়া হয় অনেক পদক্ষেপ। তবে তার বাস্তবায়ন চোখে পড়ে না। কেনো হয় না তার কোনো সুনির্দিষ্ট উওর নেই।

পাহাড়ের পাদদেশের বাসিন্দাদের উচ্ছেদ না করে শুধু তাদের অন্যত্র সরে যেতে মাইকিং করা হয়। এছাড়া মাঝেমধ্যে প্রশাসনের অভিযানে তারা তাৎক্ষণিকভাবে স্থান ত্যাগ করলেও পরে ফের একই স্থানে এসে আস্তানা গাড়ে।

মতিঝর্ণা পাহাড়ে বসবাসরত মোহাম্মদ সারু মিয়া (৭০) আরটিভি অনলাইনকে জানান, বিশ বছর ধরে এখানে থাকি। হায়াত আল্লাহর হাতে। ঝুঁকি নিয়ে এখানে থাকার দরকার কী এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এত উঁচুতেও এখানে পানি, বিদ্যুৎ আর গ্যাসের অভাব নেই। পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও এতসব সুযোগ সুবিধা ছেড়ে যাব কোথায়? এতো সুযোগ সুবিধার মধ্যে অল্প দামে ঘর কোই পাবো।

পাহাড়ে বসবাস করা লুৎফা বেগম জানান, এখানে ঘর ভাড়া থেকে বাইরের ঘর ভাড়া দ্বিগুণ। তাছাড়া এখানে থাকলে মানুষের বাসায় কাজ করে কিছু পয়সা কামানো যায়। তবে ঝড় তুফান দেখা দিলে আর বর্ষা আসলে পাহাড়ে থেকে চলে যাই।

শুধু লুৎফা বেগম নয়। চট্টগ্রামের ৩৩টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত লক্ষাধিক মানুষই এমনই ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে আসছে বছরের পর বছর।

পাহাড়ে বসবাসরত গাড়ি চালক জাহাঙ্গীর জানান, পাহাড়টি ওয়াসার জায়গা হলেও সবাই এখানে এলাকার প্রভাবশালীদের কাছ থেকে দখলসত্ব কিনে ঘর তৈরি করে বসবাস করে আসছেন।

জাহাঙ্গীরের পাশেই উর্মি বেগমের ঘর। একইভাবে তিনিও প্রভাবশালীদের কাছ থেকে কিনেছেন জায়গা। দুই বছর ধরে বসবাস করেন ঘর তুলে। তার স্বামী মোতালেব জানান, দুই লাখ টাকা দিয়ে এক গন্ডা জায়গার দখলসত্ব কিনেছি। বাইরে ভাড়া থাকলে যে টাকা যেতো সে টাকা দিয়ে একটা নিজের ঘর হয়েছে। এখানে সবাই দখলসত্ব কিনে নিজে থাকে আর খালি জায়গায় ঘর তুলে ভাড়া দেয়।

ভাড়াটিয়ারা জানান, স্থানীয় কাউন্সিলর এফ আই কবির মানিকসহ এলাকার, শহীদ, মিল্লাত, শাহজাহান পাহাড় দখলের কাজে জড়িত।

নগরীর বাটালী হিল পাহাড়ের জায়গা দখল করে যারা ভাড়া দেয় তাদের মধ্যে ইমন গ্রুপ আর তাসলিম গ্রুপের নাম বললেন ওই জায়গার ভাড়াটিয়ারা। দু’গ্রুপেই ভাড়া দাবি করায় বিপাকে পড়েছে পাহাড়ের অসহায় ভাড়াটিয়ারা। পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় সংঘাত হবার আশঙ্কার কথা জানালেন ভাড়াটিয়ারা।

নগরীর বাটালী হিলের মতো বাঘঘোনা, কুসুমবাগ, একে খান, ফয়েসলেক, কৈবাল্যধাম, জঙ্গল সলিমপুর, জঙ্গল লতিফপুর, কাইচ্চাঘোনা, লেবুবাগান বায়েজিদ বোস্তামী, নাচনীখোলা পাহাড়সহ ৩৩টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের একই দশা।

অভিযোগ আছে, রাজনীতিতে চরম হানাহানি আর ভেদাভেদ থাকলেও পাহাড় দখলের ক্ষেত্রে দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীরা সমান অংশীদার। প্রভাবশালীরা পাহাড়ের জায়গা দখল করে দখলসত্ব বিক্রি করে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে। অথবা নামে বেনামে ঘর তুলে ভাড়া দেয় মানুষের কাছে। কেবল কাঁচাঘর নয় পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবনও।

গেলো ১০ বছরে পাহাড় ধসে নারী শিশুসহ মারা যায় দু’শতাধিক। পাহাড় ধসের কারণে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাণহানি হয় ২০০৭ সালে। ওই বছরের ৭ জুন নগরীর ৭ স্থানে পাহাড় ধসে মারা যায় নারী শিশুসহ ১২৭ জন।

২০০৮ সালে ১৮ আগস্ট মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যায় ১১ জন। ২০১১ সালের পহেলা জুলাই বাটালি হিলে সীমানা প্রাচীর ধসে মারা যায় ১৭ জন। ২০১২ সালের ২৬ জুন আলাদা জায়গায় স্থানে পাহাড় ধসে মারা যায় ১৮ জন। ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি এবং ২৮ জুলাইয়ে আলাদা পাহাড় ধসে মারা যায় মা মেয়েসহ তিনজন। ২০১৪ সালের ১৮ জুলাই ৬ জন এবং ২০১৫ সালের ১৯ জুলাই ও ২১ সেপ্টেম্বর পাহাড় ধসে মারা যায় ৮ জন।

২০০৭ সালের ঘটনার পর বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে গঠন করা হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। পাহাড় ধস রোধ এবং পাহাড় ধসের মৃত্যুর হার কমাতে নানা উদ্যোগ নিলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি পাহাড়ে বসবাসকারীদের জন্য। পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযানে কিছু নিম্ন আয়ের মানুষদের অস্থায়ীভাবে সরিয়ে দিলেও পাহাড়খেকোরা থাকে সবসময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সামুসুল আরেফিনের কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি আরটিভি অনলাইনকে জানান, এরই মধ্যে আমরা পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে অভিযান চালানোর পাশাপাশি পানি, বিদ্যুৎ,গ্যাস লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি।

পাহাড়খেকো প্রভাবশালীদের কেনো আইনে আওতায় আনা হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি জানান, আমরা অভিযানে গেলে কেউ আমাদের নাম দেয় না। নাম পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

যুগের পর যুগ চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো দখল করে অর্থের পাহাড় গড়ছে পাহাড়খেকোরা। আর মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ। কেবল বর্ষা এলেই প্রশাসনের উচ্ছেদ অভিযান আর বর্ষা গেলেই ফের বসতি গড়ে তোলা। এ যেন প্রশাসন আর পাহাড়ে বসবাসকারীদের মধ্যে লুকোচুরি খেলা।

সচেতন মহল মনে করেন, পাহাড়ে বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করা না গেলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যাবে না। পাশাপাশি পাহাড়খেকো প্রভাবশালীদের কঠিন আইনের আওতায় আনার দাবি চট্টগ্রামবাসীর।

এসএস

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
পাহাড়ে রাতে র‌্যাব-পুলিশের অভিযান, ১০ অপহৃত উদ্ধার
শ্রীলঙ্কার রান পাহাড়ে উঠতে বিশ্বরেকর্ড গড়তে হবে টাইগারদের
ঈদের পর ভেঙে ফেলা হবে কারওয়ান বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন
‘দেশে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ, ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮ হাজার’ 
X
Fresh