আর আত্মহত্যার চেষ্টা নয়, বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন মনিকা
মাত্র পনের দিন আগে যিনি বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। করতে চেয়েছিলেন আত্মহত্যা। ক্ষুধার যন্ত্রণা, দুটো নাবালক সন্তানের কান্না, আর চোখের পানি সহ্য করতে না পেরে একাধিকবার তিনি ভেবেছেন আত্মহত্যার কথা। অসহায় এ বিধবার নাম মনিকা রাণী মণ্ডল (২৪)। তার স্বামীর নাম নিরঞ্জন মণ্ডল। বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানি ইউনিয়নের ছহেরাবাদ গ্রামে।
গেলো তিন নভেম্বর তিনি বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও লোক বেতারের পরিচালক মনির হোসেন কামালের কাছে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বলছিলেন, সন্তান দুটোর কথা ভেবে আত্মহত্যাও করতে পারি না। এ সময় তিনি শৈশবকাল থেকে ২৪টি বছরের দু:খগাথা তুলে ধরেন। মনিকা রাণী মণ্ডলের বাবার নাম গৌরাঙ্গ হাওলাদার। মায়ের নাম কল্পনা রানী।
তাদের কেউই বেঁচে নেই। মনিকা রাণীর বয়স যখন তিন মাস। তখন তার মাকে ছেড়ে আরেকটি বিয়ে করে বাবা অন্যত্র চলে যান। সেই থেকে মনিকা তার মা ও মামার কাছে বড় হয়েছেন। সংসারের টানাপোড়েনের কারণে মা ও মামার কাছেও তার বেশি দিন থাকা হয়নি। মাত্র সাড়ে ১১ বছর বয়সে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। তার বিয়ে হয়েছিলো মধ্য বয়সী নিরঞ্জন মণ্ডলের সঙ্গে। নিরঞ্জন মণ্ডল আগেও একটি বিয়ে করেছিল।
একটি কন্যা সন্তান রেখে তার প্রথম স্ত্রী মারা যায়। মনিকা রাণী স্বামীর সংসারে গিয়ে মাত্র সাড়ে ১৩ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের মা হয়ে যান। তার কন্যা সন্তান শম্পা রানীর বয়স এখন ১১ বছর। মেয়েটি বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। মেয়ে জন্মের সাড়ে তিন বছর পরে ছেলে অন্তর মণ্ডলের জন্ম হয়।
ছেলেটি পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। গেলো দুই মাস আগে মনিকা রাণীর স্বামী মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পরই নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। তাদের নেই কোনও আবাদি জমি।
বাড়ির জমিটুকো থাকলেও নেই কোনও আয়-রোজগার। ২০০৭ সালের সিডরে বসতঘরটি নিশ্চিহ্ন করে দিলেও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা-সংগ্রাম তাদের একটি ঘর করে দিয়েছিলো। ১৩ বছর পরে এখন শুধু নামেমাত্র ঘর আছে। উপরে ঝাঝড়া টিনের ছাউনি। বৃষ্টি এলেই ঘরের ভেতরে পানি পড়ে। নেই ঘরের বেড়াটি পর্যন্ত। প্রতিটা রাত কাটে নিরাপত্তাহীনতায়। ২৪ বছরের বিধবা মনিকা ১১ বছরের মেয়েকে নিয়ে আছেন সম্ভ্রম হারানোর দুঃশ্চিন্তায়।
আজ থেকে পনের দিন আগে বরগুনা আসার পরেই দুটো শিশু সন্তানসহ মনিকা রানীর দু:খ ঘোচানোর জন্য শুরু হয় অভিযান।
মনির হোসেন কামাল যোগাযোগ করেন, জেলা প্রশাসনসহ কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে। পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরগুনা আসার তিন দিন পরেই মনিকা রাণীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন ২৪ আইটেমের খাবার প্যাকেট। আজ বৃহস্পতিবার সকালে বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির পক্ষ থেকে সবজি ও পিঠা-চা বিক্রির উপকরণসহ মনিকার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে নগদ চার হাজার টাকা। এছাড়াও আগামী ছয় মাস প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা দেয়া হবে মনিকার সংসার চালানোর জন্য।
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানিয়েছেন, আগামী বছরের জানুয়ারি মাস থেকে মনিকাকে দেয়া হবে ৩০ কেজি করে ভিজিডির চাল। দেয়া হবে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি সেমিপাকা বাড়ি। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর-বরগুনার উপ-পরিচালক মেহেরুন নাহার মুন্নী আরটিভি নিউজকে জানিয়েছেন, আগামী বছর তিন মাসের সেলাই প্রশিক্ষণ শেষে মনিকাকে দেয়া হবে একটি সেলাই মেশিন। পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ফাতিমা পারভীন জানিয়েছেন, মনিকাকে বিধবা ভাতার কার্ড করে দেয়া হবে। সেইসঙ্গে তিনি সাধ্যমতো সহযোগিতা করবেন। একটি বেসকারি সংস্থা মনিকাকে রাস্তায় কাজ করার সুযোগ দেবেন।
মনিকা রানী জানিয়েছেন, এখন আর তিনি আত্মহত্যা করতে চান না। দেখতে শুরু করেছেন বেঁচে থাকার স্বপ্ন। দুটো সন্তানকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করতে চান। মেয়েকেও তার মতো বাল্যবিয়ের শিকার হতে দেবেন না।
জেবি
মন্তব্য করুন