জয়পুরহাটে নবান্ন উৎসব ঘিরে হরেকরকম মাছের মেলা (ভিডিও)
জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার পাঁচশিরা বাজারে নবান্ন উৎসব উপলক্ষে শেষ হয়েছে একদিনের জমজমাট মাছের মেলা। নবান্ন উপলক্ষে মূলত প্রতি বছর এই এলাকার জামাইসহ তার আত্মীয়দেরকে শ্বশুড়বাড়িতে দাওয়াতের আয়োজন করা হয়। জামাইদের আগমন উপলক্ষে স্থানীয়ভাবে মেলাও বসে; যা মূলত সবাই এটাকে বলে মাছের মেলা।
মঙ্গলবার (১৭ নভেম্বর) দিনব্যাপী মাছের মেলাকে ঘিরে থরে থরে সাজানো হয় রুই, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, গ্লাসকার্প, পাঙাস, ব্রিগেড, বাঘাইর, বোয়ালসহ হরেক রকমের মাছ। সারি সারি দোকানে এক কেজি থেকে শুরু করে ২০ কেজি ওজনের মাছ দেখা যায়।
এই দিনটির জন্য পুরো বছর অপেক্ষায় থাকেন কালাই উপজেলাবাসী। পঞ্জিকা অনুসারে পহেলা অগ্রহায়ণে বসে এই মাছের মেলা। অগ্রহায়ণ মাসে কিছুটা ঠান্ডা হলেও মেলা জুড়ে ছিল ক্রেতা-বিক্রেতা আর কৌতূহলী মানুষের ঢল। প্রায় শতবছর পূর্ব থেকে চলে আসা মেলায় নদী, দীঘি ও পুকুরে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা দেশীয় প্রজাতির টাটকা মাছ কিনতে ক্রেতারা ও পাইকাররা ভিড় জমায়।
এই অগ্রহায়ণ মাসে মাঠ থেকে নতুন ফসল কৃষকদের ঘরে উঠলেই নবান্ন উৎসবের আয়োজন করেন উপজেলার সকল কৃষকেরা। এতে অংশ নেয় উপজেলার মাত্রাই, হাতিয়র, মাদারপুর, হাটশর, হারুঞ্জ, পুনট, বেগুনগ্রাম, পাঁচগ্রামসহ ২৫ থেকে ৩০ গ্রামের মানুষ। এই উৎসবে প্রতি বাড়িতে মেয়ে জামাই ও বেয়াই-বিয়ানসহ আত্মীয়-স্বজনরা স্বজনদের আগে থেকে দাওয়াত দিয়ে রাখে।
ফলে অত্র এলাকার গ্রামীণ জনপদের প্রত্যেক কৃষকদের ঘরে ঘরে নতুন চালের নবান্ন শুরু হয় এবং পিঠা-পুলি, পায়েস, ক্ষীর, খই ও মুড়ি তৈরি করা হয়। কৃষকদের ঘরে হয় যেন এক মিলন মেলা।
স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা আগের দিন থেকেই পাঁচশিরা বাজারে তাদের আড়ত ঘরে জেলা-উপজেলার বিভিন্ন দীঘি, পুকুর, নদী থেকে নানান জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করেন।
মেলায় বিশালাকৃতির একটি মাছ তুলে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন কালাই উপজেলার হাতিয়র গ্রামের মাছ বিক্রেতা গোলাম রব্বানী। তিনি ১৫ কেজি ওজনের সিলভার মাছটির দাম হাঁকেন ১১ হাজার টাকা। ২০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিগ্রেড ও সিলভার কার্প মাছ বেশি বিক্রি হয়েছে। রুই ও কাতলা মাছ বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে।
মাছ ব্যবসায়ী মো. সাইফুল, আব্দুল লতিফ, সাদ্দাম হোসেন, তাজুল ইসলাম, মোরশেদুল ইসলাম বলেন, এই মাছের মেলার জন্য বিভিন্ন পুকুর, দীঘি ও নদী থেকে নানান জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করা হয়। কাতলা, রুই, মৃগেল বিভিন্ন সাইজের তিনশ থেকে আটশ টাকা কেজিতে এবং বাঘাইর, বোয়াল ও চিতল মাছ হাজার থেকে ১২শ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও মাঝারি আকারের মাছ ৪৫০ টাকা থেকে ৫শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ২৫০ টাকা দরে বিগ্রেড ও সিলভার কার্প বিক্রি হয়েছে। মাছের মেলায় প্রচুর লোক সমাগম হলেও বেচাকেনা সেই তুলনায় কম। তারপরও যেটুকু বেচাকেনা হয়েছে, সব খরচ বাদে তাতে লাভ টিকবে।
মাছের মেলায় আসা ক্রেতা বেলাল হোসেন, অমিত মন্ডল, মনোয়ার হোসেনসহ অনেকে জানান, এবারের মেলায় প্রচুর মাছ উঠেছে কিন্তু দাম অনেকটা বেশি। প্রতিটি দোকানে সাজানো হয়েছিল বোয়াল, রুই, মৃগেল, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, পাঙাস, ব্রিগেড, বাঘাইরসহ নানা ধরনের মাছ। এবারের মেলায় সর্বোচ্চ ১৪ কেজি ওজনের মাছ বিক্রি হয়েছে।
মাছচাষি মাহতাব তালুকদার মেলা সামনে রেখে এক বছর ধরে পুকুরে বড় বড় মাছ বাছাই করে চাষ করেছেন। তাই এবার পাঁচশিরা বাজারের মাছের মেলায় বড় বড় মাছ বিক্রি করতে পারছেন।
কালাই পৌর শহরের হাসপাতাল এলাকা থেকে রূপালী রাণী সাহা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাছের মেলায় এসেছেন। প্রতি বছর মেলায় আসেন তিনি। এবার তার সঙ্গে এসেছেন ধামইরহাট থেকে আসা বড় ভাইয়ের স্ত্রী অপর্ণা কর্মকার। তারা দুইজন মিলে দরদাম করে ৬৫০ টাকা কেজি দরে ৪ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের একটি কাতলা কিনেছেন।
তিনি বলেন, মেলায় বহু ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের দেখে ভালো লাগছে। আসলে বাঙালি জীবন থেকে উৎসবগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এ রকম উৎসবে অংশ নিতে পারলে ব্যস্ততম জীবনে কিছুটা প্রশান্তি আসে।
কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোবারক হোসেন জানান, দেশীয় জাতের মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। মেলা উপলক্ষে এই জাতের মাছগুলো চাষিরা চাষ করায় এই জাতগুলো আবার ফিরে এসেছে। আমরা অতিথিপরায়ণ জাতি। নবান্ন উৎসব উপলক্ষে আত্মীয়দের মধ্যে পারস্পরিক মিলনমেলার সুযোগ ঘটে, এটা ভালো দিক। তবে যেহেতু করোনাকালীন মহামারি চলছে, তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব উৎসব পালন করতে হবে।
পি
মন্তব্য করুন