• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

ঢাকা-১৮ আসনে ব্যবসায়ীদের এতো আগ্রহ কেন?

  ২৬ আগস্ট ২০২০, ১৯:১৯
file photo
ফাইল ছবি

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে শূন্য হয় ঢাকা-১৮ সংসদীয় আসনটি। এরপরই শুরু হয়েছে তোড়জোড়। বড় দুই দলের মনোনয়ন পেতে ছুটছেন প্রায় একশ' নেতা। এর মধ্যে সিংহভাগই ব্যবসায়ী। এর বাইরে ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরাও নিজেদের জোট প্রধানের কাছে প্রার্থীতার দাবিও তুলেছেন। এই প্রার্থীরাও পেশায় ব্যবসায়ী। প্রশ্ন উঠেছে, অপেক্ষাকৃত 'এলিট এরিয়া' হিসেবে পরিচিত এই আসনটি নিয়ে কেন এতো তোড়জোড় ব্যবসায়ীদেরই বা এতো আগ্রহ কেন?

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেতে পোশাকশিল্পের শীর্ষ নেতাসহ বেশ কয়েকজন প্রার্থী বেশ তৎপর হয়েছেন। এ লক্ষ্যে তারা এলাকায় পোস্টার সাঁটানোর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রচারণা চালাচ্ছেন। রাজনীতির মাঠে না থাকলেও হঠাৎ কর্মী-সমর্থক বানিয়ে নিজেদের পক্ষে অনেক কিছু লিখছেন। বিএনপি থেকেও মনোনয়ন প্রত্যাশী এমন প্রার্থী কম নয়। পেশায় তারা ব্যবসায়ী হলেও দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছেন।

জানা গেছে, হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসা এমন প্রার্থীদের প্রচারণায় দলের নেতা-কর্মীরাও পড়েছেন ভাবনায়। রাজধানীর প্রবেশদ্বারখ্যাত ঢাকা-১৮ আসনে আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিবিদ সাহারা খাতুন প্রায় ১২ বছর সাংসদ ছিলেন। এ সময়ের মাঠ কাপানো এই নেত্রীর মৃত্যুর পর ব্যবসায়ী রাজনীতিকরা হঠাৎ করেই উঠে এসেছেন আলোচনায়। ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ প্রভাব তৈরি করে বাণিজ্যিক ফায়দার আশায় ভিড়ছেন নৌকায়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নৌকার টিকিট পেতে ব্যাপক পোস্টার সাঁটিয়েছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। প্রয়াত এমপি সাহারা খাতুনের ভাগ্নে আনিসুর রহমানও এলাকায় পোস্টারিং করেছেন। তিনিও পেশায় ব্যবসায়ী। আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা জোর লবিং-তদবির করছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে। কেউ কেউ নিজেদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেও এলাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির প্রার্থীরাও কম যান না, চেষ্টা করছেন দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। বিএনপির রাজনীতি করলেও এদের অনেকেই স্থানীয় আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করে নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন।

আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক সায়েম খান গণমাধ্যমকে বলেন, শূন্য হওয়া পাঁচটি আসনের উপ-নির্বাচনে মোট ১৪০টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা-১৮ আসনেই ৫৬টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে সিংহভাগ ব্যবসায়ী। কেউ কেউ ব্যবসায়ী পরিচয় না দিলেও নিজের ও পরিবারের নামে রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা। আবার অনেককে শিক্ষকতাকে পেশা দেখালেও বেশিরভাগ আয় আসে ব্যবসা থেকে। আবার আগে ব্যবসা না করলেও আওয়ামী লীগের পদবী নিয়ে জড়িয়ে পড়েছেন ব্যবসার সঙ্গে। কৃষিজীবী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ হিসেবে তারা পরিচয় দিলেও প্রায় সবার আয়ের মূল উৎস হচ্ছে ব্যবসা।

তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এ আসনে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকে মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে কর্মীরা একাট্টা। ঢাকা-১০ (ধানমন্ডি) এর মতো আসনটি ব্যবসায়ীদের হাতে ছাড়তে চান না তারা।

ঢাকা-১৮ আসনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এরই মধ্যে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে বিষয়টি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতৃবৃন্দ কিংবা স্থানীয়দের মধ্যে এখন অনেকেরই এমপি হওয়ার যোগ্যতা আছে। ঢাকা শহরে নতুন করে কোনো অপরিচিত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়ে ঝুঁকি নেয়াটা উচিত হবে না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা কাদের খান বলেন, রাজনীতিবিদের এই আসনে যেন একজন রাজনীতিবিদকেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। দলে যারা ত্যাগী পরীক্ষিত নেতা আছেন তাদের মধ্য থেকে যেন মনোনয়ন দেওয়া হয় নেত্রীর কাছে এই আবেদন জানাই। হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসে কোনো ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোক আমরা তা চাই না। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করুক। রাজনীতিবিদরা রাজনীতিতে থাকুক।

যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার বলেন, রাজনীতিবিদরা যত দুর্যোগই আসুক দলের প্রশ্নে ও নেত্রীর প্রশ্নে আপসহীন থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসা ব্যক্তিরা সুবিধাটুকুই নেবে। দুর্দিন এলে কেটে পড়বে।

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিব আহসান নিজের মনোনয়নের ব্যাপারে বলেন, আমি ছাড়াও দলে অনেক যোগ্য ও ত্যাগী পরীক্ষিত নেতা রয়েছেন যারা উপনির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য। ব্যবসায়ীদের নয়, দল থেকেই প্রার্থী দেওয়া হোক এমনটাই চাওয়া।

এদিকে, বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, মনোনয়ন প্রক্রিয়া এখনও শুরু না করলেও আসন্ন ঢাকা-৫ ও ঢাকা-১৮ উপ-নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। এর মধ্যে ঢাকা-১৮ আসনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। ঢাকার উত্তর প্রবেশ মুখের এই আসন রাজনৈতিক-বাণিজ্যিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রার্থী হতে চাইছেন তারা।

জানা গেছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৮ থেকে ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল জেএসডির নেতা শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন। এবারের উপ-নির্বাচনে তার অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে তার দাবি, আসনটি ব্যবসায়ীদের কাছে নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এই এলাকায় আমার জন্ম। ছাত্র জীবন থেকে আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এখানকার স্থানীয় নেতাকর্মীরাও চাচ্ছেন আমি যেন ঢাকা-১৮ আসন উপ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচনের প্রচারণাও শুরু করে দিয়েছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম এম আকাশ এ সম্পর্কে আরটিভি নিউজকে বলেন, এই আসনে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ কেন নির্বাচন করতে চায় এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট। আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশে রাজনীতি এখন লাভজনক ব্যবসা। বিনা পুঁজিতে এত লাভজনক ব্যবসা আর নেই। আর সে কারণেই আমাদের সংসদ এখন পুরোটাই প্রায় ব্যবসায়ীদের দখলে ও নিয়ন্ত্রণে। ঢাকা-১৮ আসনটিতে অপেক্ষাকৃত উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষের বসবাস, যাদের সিংহভাগই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। ফলে এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সেখানকার এমপি হতে পারলে বড় ধরনের ব্যবসায়িক ফায়দাও তৈরি হবে। এ কারণে এতো প্রার্থীর ছড়াছড়ি।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে একদিকে যেমন ব্যবসায়ীরা সাংসদ হয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি সাংসদরাও ব্যবসায়ীতে পরিণত হচ্ছেন। ব্যতিক্রম কয়েকজন বাদ দিলে সব রাজনীতিবিদ এখন ব্যবসায়ী। এই রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি, অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছেন। এমন বিনা ঝুঁকিতে, বিনা পুঁজিতে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা আর বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। ফলে যে আসনটি ফাঁকা হচ্ছে, সেখানেই ব্যবসায়ীদের চোখ পড়ছে।

তিনি আরও বলেন, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ দুটোই পুঁজিবাদী দল। দু'দলই ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দিচ্ছে এবং ধাপে ধাপে সংসদে পেশাদার রাজনীতিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই সংসদের জনগণের পক্ষ কথা বলার লোক থাকছে না। এটা বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার জন্য ভীষন এলার্মিং। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা যদি সাংসদ হয়ে যান, তাহলে সংসদে আইন প্রণয়নে তাদের কী ভূমিকা হবে? দলগুলোর প্রতি আমার আহ্বান থাকবে তারা যেন রাজনীতিবিদদের মনোনয়ন দেয়। তাহলে তৃণমূলের মানুষের সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্ক থাকবে।

এসজে/ এমকে

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh