কোটালীপাড়ায় সাংবাদিক নির্মল সেনের ৯০তম জন্মদিন পালন

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট, বাম রাজনীতির পুরোধাব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধা নির্মল সেনের ৯০তম জন্মদিন পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে আজ সোমবার নির্মল সেন স্মৃতি সংসদের আয়োজনে উপজেলার দিঘীরপাড় গ্রামে নির্মল সেন স্কুল এন্ড মহিলা কলেজ চত্বরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সাংবাদিক রতন সেন কংকনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় অধ্যাপক গৌরাঙ্গ লাল চৌধুরী, জেলা পরিষদ সদস্য নজরুল ইসলাম হাজরা মন্নু, পিনজুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক দেবতোষ দে, সাংবাদিক মোহাম্মদ মাহমুদ কবির, গৌরাঙ্গ লাল দাস, নির্মল সেন স্মৃতি সংসদের সভাপতি মিজানুর রহমান বুলু প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

কোটালীপাড়া শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক গৌরাঙ্গ লাল চৌধুরী বলেন, কোটালীপাড়ায় যুগ যুগ ধরে অনেক মনীষীর জন্ম হয়েছে। তার সবশেষজন ছিলেন নির্মল সেন। দেশভাগের পর তার বাবা-মা ভাই-বোন ভারতে চলে গেলেও জন্মভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে তিনি কোথাও যাননি। দেশের জন্য তার যে আত্মত্যাগ ও আমাদের কোটালীপাড়ার উন্নয়নে তার যে অবদান সেটি মনে রেখে তার নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজটির উন্নয়নে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।
জেলা পরিষদ সদস্য নজরুল ইসলাম হাজরা মন্নু বলেন, নির্মল সেন একজন নির্লোভ, সৎ ও সাহসী সাংবাদিক ছিলেন। তিনি কোনোদিন অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। তার লেখায় কোটালীপাড়ায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। নির্মল সেন কোটালীপাড়ার অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত ছিলেন। আমাদের সকলের উচিত নির্মল সেনের নামে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নে এগিয়ে আসা।

নির্মল সেনের ভাতিজা সাংবাদিক রতন সেন কংকন বলেন, করোনার কারণে এ বছর ‘নির্মল সেন স্মৃতি সংসদ’ ছোট পরিসরে নির্মল সেনের জন্মদিন পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। ‘নির্মল সেন স্মৃতি সংসদ’ ও পরিবারের পক্ষ থেকে তার নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুল ও কলেজটির উন্নয়নে স্থানীয় প্রশাসনসহ প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি।

নির্মল সেন ১৯৩০ সালের ৩ আগস্ট গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার দিঘীরপাড় গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। মা লাবণ্যপ্রভা সেনগুপ্তা। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে নির্মল সেন ছিলেন পঞ্চম। নির্মল সেনের বাবা সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত কোটালীপাড়ার প্রাচীন বিদ্যাপীট কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইন্সটিটিউশনের গণিতের শিক্ষক ছিলেন। এর আগে সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ঢাকার ইস্ট বেঙ্গল ইন্সটিটিউটে শিক্ষকতা করতেন।

দেশবিভক্তির পর নির্মল সেনের বাবা-মা অন্য ভাই-বোনদের সঙ্গে নিয়ে কলকাতা চলে যান। জন্মভূমির প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসার কারণে তিনি এ দেশে থেকে যান। নির্মল সেন বড় হয়েছেন ঝালকাঠি জেলায় তার পিসির বাড়িতে। তিনি ঝালকাঠি জেলার কলসকাঠি বিএম একাডেমি থেকে ১৯৪৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাস করেন। পিসির বাড়িতে যাওয়ার আগে নির্মল সেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার জিটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে এক বছর লেখাপড়া করেন। তিনি বরিশাল বিএম কলেজ থেকে আইএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
স্কুলজীবনে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের মাধ্যমে নির্মল সেনের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়। কলেজজীবনে তিনি অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আরএসপিতে যোগ দেন। তারও আগে তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। শেষজীবনে তিনি দীর্ঘদিন শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রাজনীতি করতে গিয়ে নির্মল সেনকে জীবনের অনেকটা সময় জেলে কাটাতে হয়েছে।

১৯৬১ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার মধ্য দিয়ে নির্মল সেন তাঁর সাংবাদিকজীবন শুরু করেন। তারপর দৈনিক আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে ১০ বছর অতিথি শিক্ষক ছিলেন।

লেখক হিসেবেও নির্মল সেনের সুনাম রয়েছে। তার লেখা ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’, ‘মানুষ সমাজ রাষ্ট্র’, ‘বার্লিন থেকে মস্কো’, ‘মা জন্মভূমি’, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’, ‘আমার জীবনে ৭১-এর যুদ্ধ’, ‘আমার জবানবন্দি’ উল্লেখযোগ্য।

নির্মল সেন ২০০৩ সালের ১০ অক্টোবর ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এরপর দেশে-বিদেশে অনেক চিকিৎসার পর ২০১৩ সালের ৮ জানুয়ারি পরলোকগমন করেন। নির্মল সেনের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করা হয়েছে।
পি