• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

কোরবানির পশুর হাট : সব কূল রক্ষাই মূল চ্যালেঞ্জ

সৈয়দ আশিক রহমান

  ২০ জুলাই ২০২০, ১৩:৫৫
Sacrificial Animal Market: The main challenge to protect all shores
সৈয়দ আশিক রহমান

জীবন আগে নাকি জীবিকা, এই তর্কের মীমাংসা অনেক আগেই হয়ে গেছে। মোটামুটি সবাই একমত যে, দুটির যেকোনো একটিকে বেছে নেবার সুযোগ নেই, বরং দুটোকেই এগিয়ে নিতে হবে সমান্তরালে। তবে, করোনার মতো অতিমারি দুর্যোগে “জীবন এবং জীবিকাকে” একসূতায় গাঁথতে হলে অনেক কৌশলী হতে হয়, চলতে হয় সুপরিকল্পিত পথে। আর পরিকল্পনা দুর্বল হলে জীবন-জীবিকা দুটোই হারানোর শঙ্কা থাকে। পুরনো এই কথা আবারো সামনে আনার পেছনে বড় কারণ হলো, আসন্ন কোরবানির ঈদ।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসেবে গত বছর দেশে কোরবানি হয় ১ কোটি ১০ লাখের কিছু বেশি। ধারণা করা হচেছ, করোনার দুর্যোগ না থাকলে, এবারও প্রায় সমপরিমাণ অথবা তারচেয়েও বেশি পশু কোরবানি হতো। প্রায় অর্ধ লক্ষ কোটি টাকার পশু কেনা-বেচা হয় এই ঈদে। কাপড়-চোপড়, পরিবহন, মসলাপাতি সবকিছু মিলে অন্তত ৭০ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে ঈদুল আজহাকে ঘিরে। দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি খাত চামড়া শিল্পের জন্য সারা বছর যে পরিমাণ চামড়া সংগ্রহ হয়, তার অর্ধেকেরও বেশি সংগ্রহ হয় এই ঈদে।

বর্তমানে শিক্ষিত তরুণরা সারাদেশে ছোট-বড় প্রায় ৫৮ হাজারের বেশি খামার গড়ে তুলেছে। এই খামারগুলোর টার্গেট থাকে কোরবানির ঈদ। বিপুল সংখ্যক গৃহস্থের স্বপ্নের ডাল-পালা বিস্তৃত হতে থাকে বাড়িতে পালা গবাদিপশুর তিলে তিলে বেড়ে ওঠার সঙ্গে। পোষা গরু, ছাগল কিংবা মহিষটি বিক্রি করে প্রিয় সন্তানের আবদারটি পূর্ণ করার স্বপ্ন দেখেন অনেকে। কিংবা পশুবিক্রির টাকা দিয়ে এবার বড় মেয়েটির বিয়ে দেবে, অথবা, ধানমাড়াইয়ের একটি যন্ত্র কিনবে। কোরবানি দিতে না পারলে সামর্থ থাকা মুসলমান ভাইটির মনে কতটা রক্তক্ষরণ হবে, তাও তো এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। সারা বছর গরু কিংবা ছাগলের মাংস খেতে না পারা দরিদ্র মানুষগুলো চেয়ে থাকে কোরবানির ঈদের দিকে। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকার পুরোটাই গরীব-দুস্থদের হক। মফস্বলে তো বটেই, শহরেও অনেক এতিমখানা চলে সাধারণ মানুষের দেয়া চামড়া কিংবা চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে।

এখন প্রশ্ন হলো, করোনার কারণে এবার কি সব খারিজ করে দেবো? গৃহস্থ কিংবা খামারির স্বপ্নগুলো কি সব চুরমার হয়ে যাবে? নাকি জীবন বাঁচিয়ে জীবিকা এগিয়ে নেবার পথ তৈরির চেষ্টা করবো আমরা?

কোভিড-১৯ বাস্তবতায় সব কূল কিভাবে রক্ষা করা যায়, তার কিছু আইডিয়া তুলে ধরার জন্যই এই প্রয়াস।

প্রথমত কোরবানির বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। প্রদর্শনের চিন্তা থেকে বেরিয়ে কোরবানির মূল দর্শনে ফিরে যেতে হবে, পরিবর্তন আনতে হবে মাইন্ডসেটে। ঈদের আগের দিন দুপুরের পর থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষ ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের মতো বড় শহরগুলোতে কসাইয়ের কাজ করতে আসে। ট্রেনের ভেতরে এবং ছাদে এসব শ্রমিকের ভিড় দেখলেই বোঝা যায় কি পরিমাণ মৌসুমী কসাই ঈদে শহরগুলোতে আসে। সাধারণ সময়ে এটা ইতিবাচক হলেও করোনার এই দুর্যোগে এটা ডেকে আনতে পারে ভয়ঙ্কর পরিণতি। বিপুলসংখ্যক এই মৌসুমী কসাইরা যেমন শহরে এসে নিজেরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রান্তিক অঞ্চলে কোভিডের জীবাণু বহন করে নিয়ে যেতে পারে, তেমনি নিজেরাই বাহক হিসেবে শহরে এসে করোনার দ্রুত বিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারে। অথচ, শহরের বাসিন্দারা যদি গ্রামে কোরবানি দেয় তাহলে এই মৌসুমী কসাইরা গ্রামেই কাজের সুযোগ পেয়ে যাবে, শহরে আসতে হবে না। গ্রামের অতি দরিদ্র মানুষরা কিছু মাংস খাওয়ার সুযোগও পাবে, কোরবানির উদ্দেশ্যও সফল হবে।

দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পশুর হাট কমিয়ে ফেলায় কম হাটে বেশি মানুষের ভিড় হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব হবে না, ফলে কোরবানির জন্য পশু কিনতে যারা হাটে যাবেন, তাদের মাধ্যমে ঘরে ঘরে কোভিড-১৯ জীবাণু পৌঁছে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এর বদলে গ্রাম এবং মফস্বল এলকাগুলোতে পশুর হাটের সংখ্যা বাড়িয়ে দিলে প্রতিটি হাটে ভিড় কম হবে, সঙ্গে করোনার ঝুঁকিও কমে যাবে। আর রাজধানী ঢাকার মতো অতি ঘনবসতিপূর্ণ নগরের ভেতরে পশুর হাট না বসিয়ে নগরের বাইরে প্রয়োজনে চক্রাকারে পশুর হাট বসানো যেতে পারে।

এবারের ঈদুল ফিতর করোনার কারণে ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যেই পালিত হয়েছিলো। সেসময় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ ও আবাসস্থল বা কর্মস্থল ত্যাগের ব্যাপারে একধরনের নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়। কিন্তু, ঈদের দুদিন আগে নগরীর বহির্মুখগুলোতে এবং ফেরিঘাটে গ্রামমূখী মানুষের ঢল ঠেকানো যায়নি। সাধারণ পরিবহন না পেয়ে অনেকে মোটরবাইক, মাইক্রোবাস, ছোট পিকাপ ভাড়া করে ঠাসাঠাসি করে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেছেন। যার ফলে, শুধু জুন মাসেই প্রায় ১ লাখ মানুষ নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এবারের ঈদেও যদি পরিকল্পনায় দুর্বলতা থাকে, তবে আবারো করোনার সংক্রমণ লাফিয়ে বেড়ে যাবার শঙ্কা রয়েছে।

ঈদুল ফিতরের মতো এবারের ঈদেও যদি মানুষের ব্যাপক মুভমেন্ট না ঘটে, কঠোরভাবে সবাই যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, তা নিশ্চিত করতে হবে। “সেভ ইয়োর টি” অর্থাৎ দুই চোখ, নাক এবং মুখ সুরক্ষিত রাখতে হবে। নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রায় সব গবেষণারই ফাইন্ডিংস হচ্ছে এই ভাইরাসটি চোখ, নাক ও মুখ দিয়ে মানব দেহে প্রবেশ করে। সুতরাং, এই অঙ্গগুলো ঢেকে রাখতে হবে। পশুর হাটে, গণপরিবহন কিংবা যেকোনো ধরনের মার্কেটে মাস্কবিহীন ব্যক্তির প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।

দেশে ১৬ কোটি ১৫ লাখের বেশি মোবাইল সিম ব্যবহার হচ্ছে, ইন্টারনেট সংযোগ আছে ১০ কোটির বেশি। দেশজুড়ে বিস্তৃত এই নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে সরকার ভার্চুয়াল পশুর হাটের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে, এর সুবিধা পেতে হলে ব্যাপক ভিত্তিক প্রচারণা চালাতে হবে। বিশেষ করে ক্রেতা এবং বিক্রেতা, উভয়ের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়ার কার্যকর উদ্যোগ এখনই নিতে হবে। কেননা অনলাইনে পশু বিক্রির প্রক্রিয়া সম্পর্কে এখনও অধিকাংশ খামারি ও কৃষক কিছুই জানেন না। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনলাইন বাজার পরিচালনা সম্ভব হলে খামারিরা যেমন লাভবান হবেন, বেঁচে যাবে বহু গৃহস্থের স্বপ্ন, তেমনি করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখাও সম্ভব হবে। ভার্চুয়াল পশুর হাটের সুবিধা পেতে হলে ইন্টারনেটের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি দামও কমাতে হবে।

বাস্তবতা হচ্ছে, অনলাইন ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থা এখনো শহরেই সীমাবদ্ধ, এই অল্প সময়ে সারা দেশের মানুষকে এর আওতায় আনা কখনোই সম্ভব হবে না। ফলে, মফস্বল শহরে এবং গ্রামে সরাসরি পশুর হাট বসানোর বিকল্প নেই। এতে কোনো সমস্যাও হবে না, যদি কিছু ব্যবস্থা নেয়া যায়। প্রতিটি হাটেই মাস্ক, সাবান, তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র, স্যানিটাইজারের মতো সুরক্ষা সামগ্রীর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিটি হাটের জন্য ভলান্টিয়ার তৈরি করা যেতে পারে। হাট কমিটিগুলোর সঙ্গে প্রশাসনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। পশুর দরদামে ব্যস্ত থেকে ক্রেতাকে যেনো হাটে বেশি সময় থাকতে বাধ্য হতে না হয় সেজন্য হাট কমিটি পশুর একটি যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারেন, যেনো ক্রেতার পশু পছন্দ হওয়ার পর তা দামের জন্য সময়ক্ষেপণ করতে না হয়। এছাড়া কেউ হাটে অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুত স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ ও আইসোলেশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

তবে মুখে মাস্ক ছাড়া কোনো ক্রেতা-বিক্রেতা হাটে যেনো প্রবেশ করতে না পারে এবং একটি পশু থেকে আরেকটা পশুর কমপক্ষে ৫ ফুট দূরত্ব অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

মহামারির এই দুর্যোগে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই অর্থনীতি সচল রাখার পাশাপাশি ধর্মীয় রীতি এবং উৎসব পালনের সুযোগ অবারিত রাখা যেতে পারে। আর যদি বাজার অনিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পনাহীন হয়ে পড়ে তাহলে শেষ পর্যন্ত জীবিকাও টিকবে না, মানুষও বাঁচবে না।

লেখক: সৈয়দ আশিক রহমান

প্রধান সম্পাদক আরটিভি অনলাইন ও সিইও আরটিভি

মন্তব্য করুন

daraz
  • নির্বাচিত কলাম এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
সৈয়দ আশিক রহমানের ‘প্রেম পুরাণ’ উপন্যাসের মোড়ক উন্মোচন
X
Fresh