করোনায় বেকারত্বের ভার কমাতে পারে গ্রামীণ অর্থনীতি
বৈশ্বিক মহামারি করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণে থমকে আছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। করোনা নামের ক্ষুদ্র এই অদৃশ্য শক্তির আঘাতে শুধু বাংলাদেশই নয় দিশেহারা আজ সারা বিশ্ব। দীর্ঘ সময় লকডাউন কাটিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা ও সরবরাহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও কোনো দেশই এখনও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। বাংলাদেশেও ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির পর কলকারখানা ও অফিস খুললেও এখনও স্বাভাবিক হয়নি উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা। যার জন্য অফিস ব্যয় কমানো ও ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যবসা বাণিজ্যকে গতিময় রাখতে অনেক প্রতিষ্ঠানেই চলছে কর্মী ছাঁটাই। ফলে বেকার হয়ে গ্রামে ফেরার মানুষের ঢল বাড়ছে।
আবার অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যের তেল নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো থেকেও ফেরত আসছে মানুষ। বিমান চলাচল স্বাভাবিক হলে এই মিছিল আরও অনেক দীর্ঘ হবে তা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে।বিশ্ব বাজারে তেলের দাম স্মরণকালের তলানিতে ঠেকায় সেসব দেশে অদক্ষ কর্মীরাই ছাটাই তালিকার প্রথমে রয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঝুকির তালিকায় প্রথমেই থাকবে কারণ আমাদের শ্রমিক রপ্তানির বড় অংশই অদক্ষ।
এছাড়া বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর তথ্য মতে করোনায় ৫৫ শতাংশ গার্মেন্টস অর্ডার কমেছে। ইতোমধ্যেই অনেক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, সামনে শ্রমিকদের বড় একটি অংশ চাকরি হারানোর ঝুকিতে রয়েছেন। শুধুমাত্র বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত ৩৪৮টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। আর এর বাইরে বন্ধ হওয়া কারখানার তালিকা আরও বড়। এসব শ্রমিকরা বাধ্য হয়েই গ্রামমুখী হচ্ছেন। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে গ্রামে ফেরায় গ্রামাঞ্চলে অর্থপ্রবাহ কমার পাশাপাশি বাড়ছে বেকারত্বের বোঝা।
তবে গ্রামে কৃষিভিত্তিক নানা কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে এই কর্মহারা বেকার যুবকদের কাজে লাগিয়ে গ্রামভিত্তিক অর্থনীতি শক্তিশালী করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির ভিতকেও পাকাপোক্ত করার সুযোগ রয়েছে। তবে সেজন্য অবশ্যই দরকার হবে কৃষিকে নানামুখী বাণিজ্যকরণ। একইসাথে দেশ ও বিদেশের চাহিদার দিকে নজর দিয়ে নতুন নতুন কৃষিপণ্য উৎপাদন ও সহজ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা।
একটা সময় ধারণা ছিল ভারতের গরু এদেশে না আসলে গরুর মাংস ও কুরবানির চাহিদা পুরণ সম্ভব নয়। কিন্তু আজ মাত্র ৬ বছরের ব্যবধানে সেই ধারণা বদলে দিয়েছে এদেশের তরুণ সমাজ ও সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও মাংস রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
করোনাকালে দেশের জন্য সুখবর হচ্ছে বাংলাদেশ মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে। মাছের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পেলে সরাসরি কাঁচা মাছ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ মাছ রপ্তানির সুযোগ বাড়বে। আর এলাকাভিত্তিক মাছ প্রক্রিয়াজতকরণ ইন্ডাস্ট্রি হলে স্থানীয় বেকার কর্মসংস্থান হবে। শুধু মাছ বা মাংস নয়, যেকোনো কৃষি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা সৃষ্টি হলে তা রপ্তানির যেমন সুযোগ বাড়বে তেমনি এসব কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়ে গ্রামেই কর্মসংস্থান হবে লাখো যুবকের।
অঞ্চলভিত্তিক এমন অনেক কৃষিপণ্য রয়েছে যেগুলোর দেশ ও দেশের বাইরে বিপুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সঠিক বাজারজাত ও প্রক্রিয়াকরণের অভাবে সেসব পণ্য থেকে রপ্তানি আয় সম্ভব হচ্ছে না। আনারস, পেয়ারা, লটকন, আম ও কাঠাল এসব ফলের অঞ্চলভিত্তিক প্রক্রিয়াজাতকরণ ইন্ড্রাস্ট্রি যদি গড়ে উঠে তাহলে যেমন রপ্তানির সুযোগ বাড়বে তেমনি কর্মসংস্থান হবে।
তবে এসব প্রক্রিয়া অবশ্যই সময়সাপেক্ষ, এখন দরকার খাদ্য শষ্য, শাক সবজি ও গোবাদি পশু পালন ও উৎপাদন বাড়ানো। বিদ্যমান বিশ্ব পরিস্থিতি অনুধাবন করেই করোনার শুরুতেই এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু তাই নয় ফসলের রপ্তানির সুযোগের বিষয়টিও মনে করিয়ে দেন। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের শাক সবজি রপ্তানিতে সুনাম রয়েছে। করোনাকালীন ও পরবর্তীতে এই বাজারে আরও জোড়ালো ভুমিকা রাখা সম্ভব। যদি উৎপাদন বৃদ্ধি ও গুণগত মান ঠিক রাখা যায়। সেজন্য কৃষির বিভিন্ন উপখাতকে দক্ষ ও প্রতিযোগী করে তুলতে হবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডমুখি করা ও আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা গেলে গ্রামীণ অর্থনীতিকে নতুন রূপে সাজানো সম্ভব। তার মাধ্যমে ২০১৮ সালের বর্তমান সরকারের নির্বাচন ইশতেহারে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ বাস্তবায়ন করা যাবে।
তবে সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে যদি কৃষিপণ্যের সঠিক বাজারজাত ও কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা না যায়। এজন্য আগামী অন্তত তিন বছর অপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।বাজারে চাহিদা ও যোগানের ক্ষেত্রে যদি স্থানীয় কৃষি পণ্যের দাম কিছুটা বৃদ্ধিও পায় তবুও তা আমদানি না করে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যকেই প্রধান্য দেয়া উচিত। দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে কোনো পণ্য ক্রয়ের পেছনে যে বাড়তি টাকাটা যাবে তা কৃষকের পকেটেই যাবে, অর্থ্যাৎ দেশের টাকা দেশেই থাকছে। কিন্তু বিদেশি পণ্য আমদানি করে দাম নিয়ন্ত্রণ ও কমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পরবর্তী ফসল উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবে।বর্তমান এই দুর্যোগকালে খাদ্য শষ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বংয়সম্পূর্ণ থাকাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এই সময় যদি দেশে কোনো খাদ্য ঘাটতি না হয় তাহলেই জিতে যাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর তথ্য মতে দেশে ১১ কোটি শতক পতিত জমি রয়েছে, যা মোট জমির প্রায় ৫ শতাংশ। পুকুর রয়েছে ৫ কোটি ৬৪ লাখ ৮১ হাজার একর। এছাড়া প্রচুর সংখ্যক ডোবা, নালা, খাল ও মরা নদী আছে। যেগুলো সংস্কার করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখাসহ পাড়ে সবজি চাষ ও বৃষ্টির পানি সঞ্চয় করে সেচ হিসেবে ব্যবহার ও অন্যদিকে মাছ চাষের ব্যবস্থা করে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা সম্ভব।এছাড়া বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে অনেক চরাঞ্চলে অনাবাদি জমি রয়েছে যেখানে নানা রকম সবজি চাষ বাড়ানো যেতে পারে।
বর্তমানে দেশে এক ফসলি জমি রয়েছে ৫০ কোটি ৪৮ লাখ ৪৬ হাজার একর। এই বিপুল পরিমাণ জমিকে আধুনিক প্রযুক্তি ও কৃষি গবেষণার মাধ্যমে দুই বা তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করে কৃষি উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব। করোনাকালীন বেকার হয়ে পড়া এসব যুবকদের কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতি যেমন মজবুত করা সম্ভব তেমনি শহরের ওপর জনসংখ্যার বিশাল চাপ হ্রাস ও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমানোও সম্ভব।
লেখক: সৈয়দ আশিক রহমান
প্রধান সম্পাদক আরটিভি অনলাইন ও সিইও আরটিভি
মন্তব্য করুন