• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

আল আকসা মসজিদে হামলা নেতানিয়াহুর জন্য কেন জরুরি ছিল?

খন্দকার মো. মাহফুজুল হক

  ১৪ মে ২০২১, ১৩:৫৪
ফাইল ছবি

ইসরাইলিরা ভালো করেই জানতো যে মাসজিদুল আকসার অবমাননা তাও আবার রমজান মাসে ফিলিস্তিনিদের সহ্যের সীমাকে অতিক্রম করবে এবং এর ফলে ব্যাপক সংঘাতের সূচনা হবে। প্রশ্ন হলো, তারপরও তারা কেন তা করতে গেল ?

ইসরাইলের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। অনেক দিন ধরেই এই ইহুদিবাদী দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে শূণ্যতা বিরাজ করছে। সর্বজনগ্রাহ্য নেতৃত্বের অভাব ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ সঙ্কটকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে। ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এখন টালমাটাল। নিজের পিঠ বাঁচাতেই তিনি এখন বেশি ব্যস্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়ের জামাই জারেড কুশনার ছিলেন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ ও অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। গত নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ের পর তিনি তার এই ঘনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষককে হারিয়েছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া সমর্থন থেকে ব্যক্তি নেতানিয়াহু এখন প্রায় বঞ্চিত। ইসরাইলের গত নির্বাচনে নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। এরপর বহুমুখী প্রচেষ্টা চালিয়েও মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত কোয়ালিশন সরকার গঠনে সফল হতে না পেরে তিনি বুঝতে পারলেন যে ভাগ্যের চাকা আগের মত আর ঘুরছে না। তিনি এটাও বুঝতে পারলেন ক্ষমতায় আকড়ে থাকা হয়তো আর বেশি দিন সম্ভব হবে না। আর এ অবস্থায় ক্ষমতা ছাড়লে মাথার উপর চেপে থাকা দুর্নীতির অভিযোগ তাকে তাড়া করবে, এমন কি কারাগারেও যেতে হতে পারে।

আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দিক দিয়েও ইসরাইল খুবই খারাপ অবস্থানে রয়েছে। সম্প্রতি তাদের একটি বড় অস্ত্র কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বলয় ভেদ করে ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী যোদ্ধাদের রকেট প্রায়ই হামলে পড়ছে ইসরাইলের ইহুদী উপশহরগুলোর উপর। এ রকম অবস্থায় ইসরাইলের নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বোধ দেখা দিয়েছে। এর ফলে অভিবাসী ইহুদীরা যেসব দেশ থেকে ইসরাইলে বসতি গড়েছিলেন তারা আবার সেখানেই ফিরে যাওয়ার চিন্তা করছেন, ইতিমধ্যে অনেকেই ইসরাইল ছেড়েছেন।

ইসরাইলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। গত কয়েকমাস যাবত প্রায় প্রতিদিনই অর্থনৈতিক সঙ্কট ও নানা বৈষম্যের প্রতিবাদে ইসরাইলের নাগরিকরা প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি জোরদার হয়েছে আফ্রিকা ও অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসী ইহুদীদের পক্ষ থেকে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ ।

গত ২৯ এপ্রিল সংঘটিত হয় মেরুন পর্বত ট্র্যাজেডি। সেখানে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে পদদলিত হয়ে মারা যায় ৬০ জন ইসরাইলি নাগরিক। এছাড়া শতাধিক লোক ওই ঘটনায় আহত হয় । ‘লাগ বার্মার’ হিসেবে পরিচিত ওই ধর্মীয় উৎসবে অংশ নিতে হাজার হাজার মানুষ দেশটির মাউন্ট মেরনের পাদদেশে জড়ো হয়েছিলেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশংকায় ইসরাইলের নীতি নির্ধারকদের অনেকেই ওই অনুষ্ঠানের অনুমতি না দেয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু কট্টরপন্থী ইহুদিদের সমর্থন লাভের আশায় সেই অনুষ্ঠানের অনুমতি দেন। অতএব, ওই দুর্ঘটনার দায় বর্তায় নেতানিয়াহুর উপর।

রাজনৈতিক এই দৈন্যতার মধ্যে নেতানিয়াহু নির্বচনকে ঘিরে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেন, কিন্তু তার সে চেষ্টাও সফল হয়নি। রমজানের শেষ শুক্রবার বিশ্ব কুদস দিবসে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তার সতীর্থরা বুঝতে পারেন যে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভেদ ও বিবাদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা বিফলে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে জেহাদে ইসলামি ও হামাস বিরোধী ফিলিস্তিনি দল এবং গোষ্ঠিগুলোও ইসরাইলের সাথে আলোচনার নীতি থেকে সরে আসছে। ইসরাইলের সাথে সমঝোতার পক্ষের ফিলিস্তিনি নেতারা এখন বুঝতে পারছেন যে ইহুদিবাদীদের সাথে আলোচনা করে আসলে কোন লাভ নেই। হামাস ও জেহাদে ইসলামি প্রতিরোধ নীতিই ফিলিস্তিন মুক্তির একমাত্র পথ।

প্রধানমন্ত্রীর নেতানিয়াহুর বিপর্যয়ের পেছনে আরেকটি কারণ হলো ইসরাইলের 'ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি' কোনো ফলাফল বয়ে আনতে না পারা। নেতানিয়াহু ভেবেছিলেন যে গত এক বছরে যেসব দেশ ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে অন্তত এই দেশগুলো আর ফিলিস্তিনিদেরকে সমর্থন করবে না। ফলে তিনি এ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পারবেন। তিনি ভেবেছিলেন এটাকে দেশের জনগণের সামনে নিজের কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে তুলে ধরতে পারবেন। কিন্তু তার এই আশা পুরোপুরি বিফলে গেল। কারণ যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বা প্রলোভনে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে নিজ দেশের জনমত বা অন্য যে কোন কারণেই হোক ফিলিস্তিনিদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। এই ঘটনা কট্টর ইহুদিবাদী এই প্রধানমন্ত্রীর ব্যর্থতাকে আরও অনেক বেশি সুস্পষ্ট করেছে।

মূলত এসব ব্যর্থতা ঢাকা দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জন্য দরকার হয়ে পড়েছিল একটি বড় ধরনের সংঘাতের । আর এজন্য তিনি ও তার সতীর্থরা বেশ কিছু দিন ধরেই নানা ভাবে উগ্র ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে উস্কানোর চেষ্টা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন ঠিকই কিন্তু এর পরিণতি যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তার সঠিক হিসাব হয়ত তিনি করতে সক্ষম হননি।

গাজা বা ফিলিস্তিনের অন্য অঞ্চলে ইসরাইলের তাণ্ডব, ব্যাপক ধ্বংসাত্মক বহুমুখী অভিযান, নারী ও শিশুসহ ব্যাপক গণহত্যা নতুন কোন বিষয় নয়। মজলুম ফিলিস্তিনিরা এখন এসবে অভ্যস্ত, এসবের কোনো পরোয়া নেই তাদের। কিন্তু ইসরাইলের ইহুদি উপশহরে হামাস ও ইসলামি জেহাদের উপর্যুপরি রকেট বৃষ্টির মুখে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির দৃশ্য ইসরাইলের নাগরিকদের জন্য নতুন বিষয়। এতে তারা অভ্যস্ত হতে পারবে কি না তাই এখন দেখার বিষয়।

লেখক : আইআরআইবি, বাংলা বিভাগের সাবেক পরিচালক

kmhoque@yahoo.com

মন্তব্য করুন

daraz
  • নির্বাচিত কলাম এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
গাজায় মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধের আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
ইসরাইলি হামলায় ৭০ বন্দী নিহত : হামাস
আইসিজের আদেশ মানছে না ইসরায়েল
গাজায় প্রাণ হারিয়েছে ৯ হাজার ৬০০ শিশু
X
Fresh