• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
logo

নাটকীয়তায় বছর পার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

মিথুন চৌধুরী

  ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১১:৩৯

কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে বছর পার করলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বছরের শুরুতে ২২ জানুয়ারি একসঙ্গে মেয়াদ শেষ হয়ে যায় তিন ডেপুটি গভর্নরের। গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পরে আবার তাদেরকে পৃথক পৃথক চুক্তিতে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এস কে সুর চৌধুরীকে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত, নাজনীন সুলতানাকে ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই পর্যন্ত, আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসানকে ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়।

৪ ফেব্রুয়ারি ঘটে ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হিসাব থেকে হ্যাকাররা ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার স্থানান্তরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে ৩৫টি নির্দেশনা পাঠানো হয়। এর জন্য আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সুইফটকে ব্যবহার করা হয়।

৮ ফেব্রুয়ারি—বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন, ৫টি অনুমোদিত সুইফট বার্তার মাধ্যমে নিউইয়র্ক ফেডের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার সরানো হয়েছে। এর মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার গেছে ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকে। আর ২ কোটি ডলার গেছে শ্রীলঙ্কার প্যান এশিয়ান ব্যাংকিংয়ে। আরও ৮৫ কোটি ডলার স্থানান্তরের নির্দেশনা আটকে দেয়া হয়।

১১ ফেব্রুয়ারি—ফিলিপাইনের অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইন থেকে অন্যত্র চলে গেছে। ঐদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আমান্দো তেতাংকোর কাছে ফোন করে চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত পাবার বিষয়ে সহযোগিতা চান।

১৬ ফেব্রুয়ারি—বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রতিনিধিরা ফিলিপাইনের ম্যানিলায় গিয়ে সে দেশের এএমএলসির সঙ্গে বৈঠক করে।

১৭ ফেব্রুয়ারি—শ্রীলঙ্কার প্যান এশিয়া ব্যাংকিং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিউইয়র্ক ফেড শাখায় ২ কোটি ডলার ফেরত দেয়।

২৯ ফেব্রুয়ারি—পাঁচটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করার জন্য ফিলিপাইনের এএমএলসির পক্ষ থেকে আদালতে মামলা করা হয়। পরে ৭ মার্চ—বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনাটি জানায়। এদিন দেশের সংবাদমাধ্যমে রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

১১ মার্চ—ফিলিপাইনের এএমএলসি অর্থ পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে রিজাল ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোর বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসে অভিযোগ দায়ের করে। পরে ২২ মার্চ তাকে বহিষ্কার করা হয়।

১৩ মার্চ—বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঘোষণা দেন, ব্যর্থতার দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

১৫ মার্চ—বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। অব্যাহতি দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের দু’ ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানাকে। আর ওএসডি করা হয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলমকে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি অপারেশন ও অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের নির্বাহী পরিচালক এবং মহাব্যবস্থাপককেও বরখাস্ত করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের উপ-পরিচালক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। এদিনে ফিলিপাইনের সিনেট এ বিষয়ে শুনানি শুরু করে। পরে ১৮ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১তম গভর্নর হন অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব ফজলে কবির।

২৩ মার্চ—রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় নিউইয়র্কের ফেডের গাফিলতি রয়েছে কি না এবং সে বিষয়ে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রে একজন আইনজীবী নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

রিজার্ভ হ্যাক নিয়ে দেশ বিদেশে তোলপাড়ের মধ্যেই গত ২৫ এপ্রিল রিজার্ভ প্রথমবার ২৯ বিলিয়নের ঘর অতিক্রম করেছিল। পরে ২৭ এপ্রিল ৩০ বিলিয়নে ডলারে পৌঁছায় রিজার্ভ।

এর মাঝে ২৬ জুলাই ফজলে কবির তার প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে সাড়ে ১৬ শতাংশ। সরকারি খাতে ধরা হয়েছে ১৫.৯ শতাংশ।

বছরের মাঝামাঝিতে কর্মকর্তা পর্যায়ে রদবদল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ৯ মহাব্যবস্থাপককে এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে বদলি করা হয়েছে। এদের মধ্যে দু’জনকে প্রধান কার্যালয় থেকে খুলনা ও রংপুর অফিসে বদলি করা হয়।

রির্জাভ চুরির ঘটনার পর ডেপুটি গর্ভনর নাজনীন সুলতানা ও আবুল কাশেমকে অব্যাহতি দেয়ার পর খালি পড়ে থাকে পদটি। পদে অবসর গ্রহণ ও অবসর-উত্তর ছুটি (পিআরএল) বাতিলের শর্তে ১৫ নভেম্বর মুনিরুজ্জামানকে ডেপুটি গভর্নর হিসাবে নিয়োগ দেয় সরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা এখন পর্যন্ত অজানাই রয়ে গেছে। যদিও নানামুখী তদন্ত চলছে। তদন্তে নেমেছে এফবিআই। স্থানীয় তদন্তকারী সংস্থা সিআইডিও তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ফিলিপাইনের সিনেটে এ নিয়ে পর পর দু’দিন শুনানি হয়। সিআইডি'র সঙ্গে এফবিআই বৈঠক করেছে। এফবিআই এ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেনি।

এদিকে ১১ নভেম্বর ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ফেরত দেয় ফিলিপাইন সরকার।

এছাড়া ডিসেম্বরে রিজার্ভ চুরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িতের বিষয়টিও উঠে আসে।

সিআইডির অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ শাহ আলম বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা জেনেশুনেই ব্যাংকের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক অনিরাপদ করে রেখেছিলেন এবং তাতে হ্যাকাররা নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করতে পারে।

এদিকে সরকারি তদন্ত দলের প্রধান ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, রিজার্ভ চুরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচ কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলা ও অসতর্কতার প্রমাণ তদন্তে উঠে আসে। তিনি ওই অর্থ উত্তোলন এবং তা জুয়ার টেবিলে চলে যাবার সুযোগ দেয়ার জন্য রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন’কে (আরসিবিসি) দায়ী করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির পাশাপাশি সিআইডিও তদন্তে নামে। ডিসেম্বরে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত বিভাগ সিআইডি।

এদিকে ১১ বার পেছানোর পর ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারিতে সিআইডিকে রিজার্ভ চুরি নিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেধে দেয় ঢাকা মহানগর হাকিম মাহমুদুল হাসান।

তবে কবে চুরি হয়ে যাওয়া টাকাগুলো পুরোপুরি বাংলাদেশ পাবে। বা আদৌ পাবে কিনা তা নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়িই হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন চুরি হয়ে যাওয়া টাকা পুরোপুরি আদায় করা সম্ভব নয়। তবে বেশিরভাগ টাকা উদ্ধারে সরকারের উর্দ্ধতন মহল থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

এই ঘটনার পর সাইবার নিরাপত্তা বা আইটি সিকিউরিটিতে খরচ বাড়িয়েছে অধিকাংশ ব্যাংক। ২০১৭ সালে সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এরইমধ্যে সব বেসরকারি ব্যাংকে আইটি সিকিউরিটি নামে আলাদা বিভাগ গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে আইটি বিশেষজ্ঞদেরও। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রায় ১ হাজার ৬শ’ কোটি টাকার প্রকল্পের মাধ্যমে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ১১টি ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এমসি/এমকে

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিদায় ২০১৬ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh