• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
logo

দিনাজপুর-রংপুর সড়কে শতকোটি টাকার চাঁদাবাজি

দিনাজপুর থেকে ফিরে মিথুন চৌধুরী

  ২২ জানুয়ারি ২০১৭, ১৭:২০

উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর ও রংপুর মহাসড়কে যানবাহন খাতে চলছে ব্যাপক চাঁদাবাজি।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, প্রতিদিন বৃহত্তর দিনাজপুর ও রংপুর থেকে দেশের সর্বত্র চলাচল করে ৫ শতাধিক যাত্রীবাহী কোচ। আর পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের সংখ্যা ২ হাজার। সব মিলিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। যাওয়া-আসা বাবদ এসব গাড়ি থেকে যদি ১ হাজার টাকা করেও আদায় হয়, তাহলে প্রতিদিন চাঁদা উত্তোলনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ লাখ। যা মাসে শেষে দাঁড়ায় ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর বছর ঘুরে দাঁড়ায় ৯0 কোটি টাকা। এ হিসাব শুধু দূরপাল্লার গাড়ির ক্ষেত্রে। আর শহরের জেলা ও বিভাগের অভ্যন্তরে গাড়ির চাঁদা তোলা হচ্ছে মালিকের কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে।যার পরিমাণ ২০ লাখ টাকার নিচে নয়।

এসব চাঁদাবাজির ফলে বেড়ে গেছে পণ্যবোঝাই ও বিভিন্ন রুটের বাসভাড়া। পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে।

পরিবহন শ্রমিকদের অভিযোগ, চাঁদার টাকা না দিলে গাড়ি কিংবা পরিবহন খাতের শ্রমিকদের প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে। দিন যতোই যাচ্ছে, বাড়ছে চাঁদার স্পট ও পরিমাণ। রীতিমতো পরিবহন মালিকরা দাঁতে দাঁত কামড়ে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে সাধারণ যাত্রীদের ওপর।

এ চাঁদাবাজির একটা অংশ অসাধু পুলিশ, রাজনীতিক, শ্রমিক নেতা ও দালালদের পকেটে যায়। কোনো চালক চাঁদা দিতে না চাইলে তাকে হয়রানি ও মারপিট করা হচ্ছে। ক্যাডারদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করছেন না। চাঁদাবাজির মাধ্যমে এসব নামধারী নেতা লাখ লাখ টাকা আয় করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেলেও জনগণের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে চরমভাবে।

পরিবহন মালিকরা জানান, পত্রিকায় লেখালেখি হলেই কেবল পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি বন্ধ থাকে। কয়েকদিন পর ফের আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

সরেজমিনে দেখা যায়, দিন কিংবা রাত সবসময় চলে এ চাঁদাবাজি। লাঠি হাতে কিছু মাঝবয়সী লোক তুলে নেয় এ চাঁদা। আবার মাঝরাতে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে হাইওয়ে পুলিশ তুলে নেয় চাঁদা। তবে ট্রাক থেকে বেশি চাঁদা তোলে হাইওয়ে পুলিশ। দেখে মনে হয় চাঁদার মহাউৎসব। কিছু স্পটে পরিবহন শ্রমিকদের ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে ভুঁইফোড় সংগঠনের স্লিপ। পুলিশ ফাঁড়ি ও সামাজিক উন্নয়নের নামে এ দিয়ে উঠানো হচ্ছে চাঁদা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হিলি-জয়পুরহাট সড়কের পাঁচবিবি কবরস্থানের মোড় থেকে শুরু হয় চাঁদা উৎসব। এখানে দিতে হয় ৫০ টাকা। পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের সাতখামার বাস স্ট্যান্ডে গুণতে হয় ৩০ টাকা। ঠাকুরগাঁও বাস স্ট্যান্ডে ১৩০ টাকা, বীরগঞ্জে ১০০, দশমাইল ১০০, সৈয়দপুর ওয়াপদা মোড়ে ৩০, রংপুর টার্মিনালে ১৭০, পলাশ বাড়িতে ৭০, বগুড়ায় সাতমাথা, চারমাথা, তিনমাথা ও মাটিডালি মোড়ে যাওয়া আসায় ৪০০ টাকা গুণতে হয় পরিবহন মালিকদের।

চাঁদা আদায়কারী সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে, বগুড়া জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠন পরিচালনার নামে আদায় করে ১’শ টাকা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন(রংপুর বিভাগীয় কমিটি) সংগঠন পরিচালনার নামে আদায় করে ১০টাকা, বগুড়া জেলা মোটর মালিকগ্রুপ ছাড়পত্রের নামে ৫০ টাকা, গাইবান্ধা জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন শ্রমিক কল্যাণের সাহায্যার্থে ২০ টাকা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন( উত্তরবঙ্গ আঞ্চলিক কমিটি) সংগঠন পরিচালনার নামে আদায় করে ২০টাকা, কোচ ও বাস এর পৌরটোল ২০ টাকা, বগুড়া জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন হাসপাতালের নির্মাণ সাহায্যার্থে ১০ টাকা।

সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের জন্য চাঁদার হার ঠিক করে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির দাবি তোলেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। এ নিয়ে যোগাযোগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে শাজাহান খানের উপস্থিতিতে একাধিক বৈঠক হয়। এ লক্ষ্যে তাঁর নেতৃত্বে চাঁদার হার ঠিক করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ঢাকায় মালিক-শ্রমিকের জন্য ৭০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে শ্রমিকদের জন্য ২০ টাকা প্রস্তাব করে তা সরকারিভাবে প্রজ্ঞাপন প্রকাশের জন্য চাপ দেয়া হয়। ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে একাধিক বৈঠকে নৌমন্ত্রী এটা বাস্তবায়নের জন্য উত্থাপন করেন। অবশেষে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় রাজি না হওয়ায় এবং এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হলে বিষয়টি আর এগোয়নি। কিন্তু এখনো এ চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১০ টাকা নেয়া হয় তার নেতৃত্বাধীন শ্রমিক ফেডারেশনের নামে।

এদিকে সংগঠন পরিচালনায় খরচের জন্য শ্রম আইনে যে চাঁদার কথা বলা হয়েছে, তা দৈনিক নয়, মাসিক কিংবা বার্ষিক। এ ছাড়া ফেডারেশন সারা দেশের শ্রমিক সংগঠনের সমন্বয়কারী বা কেন্দ্রীয় সংস্থা। তাই ফেডারেশন সরাসরি প্রতিটি বাস থেকে চাঁদা তুলতে পারে না। কেবল শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে মাসে বা বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা নিতে পারে ফেডারেশন। এখন ফেডারেশন ও শ্রমিক ইউনিয়ন আলাদাভাবে প্রতিদিন ও প্রতি গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করছে।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪ লাখ নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহন রয়েছে। এর মধ্যে বাস-মিনিবাস ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। ১০ টাকা করে চাঁদা আদায় করলে এ তিন পরিবহন থেকেই দৈনিক ১৫ লাখ টাকার বেশি উত্তোলন হয়। যা মাসে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা। এর বাইরে অটোরিকশা, হিউম্যান হলার, ট্যাংক লরি থেকেও নিয়মিত চাঁদা তোলা হয়।

এ বিষয়ে হুইপ ইকবালুর রহিম এমপিকে একাধিকবার ফোন দিলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠনের নেতারা টাকা তোলে বলে স্বীকার করে দিনাজপুরের এসপি হামিদুল আলম জানান, ওরা টাকা তোলে। তবে আমার পুলিশের কোনো কর্মকর্তা বা সদস্য টাকা তোলেন না।

এ বিষয়ে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আব্দুল ভারী জানান, বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা পরিবহন খাত থেকে চাঁদা তুলতে পারে। এটা থানাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে।এ নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই।

এমসি/ডিএইচ

মন্তব্য করুন

daraz
  • অপরাধ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh