• ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
logo

এক উপসচিবের এত ঝাঁঝ?

খান আলামিন, আরটিভি

  ২৪ আগস্ট ২০১৯, ১৬:২৯
জামাল হোসেন মজুমদার ও সাবা ইসলাম

জামাল হোসেন মজুমদার, বাংলাদেশ সরকারের একজন উপসচিব। জনপ্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের একটি প্রকল্পের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকল্পটি হচ্ছে পটুয়াখালীর মহিপুর ও আলিপুর, পিরোজপুরের পাড়েরহাট এবং লক্ষীপুরের রামগতিতে আনুষঙ্গিক সুবিধাদিসহ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র স্থাপন।
সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় আহরিত দেশি ও সামুদ্রিক মাছের Post Harvest Loss রোধকরণের জন্য বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন জামাল হোসেনকে উল্লিখিত প্রকল্পের দায়িত্ব দিলেও তিনি অনেকটা সময় ব্যয় করছেন ছোট ভাই হেলাল উদ্দিন মজুমদারের স্ত্রী আমেরিকা প্রবাসী সাহেদা আক্তারের (আলাদা থাকেন) সহায়-সম্পত্তি ভোগ দখলের পেছনে। এতে তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন স্বয়ং হেলাল উদ্দিন। এছাড়া তাদের ছোট ভাই কামাল উদ্দিন মজুমদার, জামালের স্ত্রী সাবা ইসলাম ও ছেলে জাফির হাসান মজুমদারও সাহেদার সম্পত্তি দখলে একাট্টা হয়েছেন।পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- পিবিআইযের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এমন সব তথ্যই ওঠে এসেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, নানা সময় ভয়-ভীতি দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে রাজধানীর মগবাজারের দুটি ফ্ল্যাট এবং চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে সাহেদা আক্তারের নামে কেনা সব সম্পত্তি করায়ত্ত্ব করে নিয়েছেন জামাল হোসেন ও হেলাল উদ্দিন গঙরা। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সাহেদা আক্তারের সাড়ে ১৬শ’ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে। ঢাকার অদূরে সাভারের গেন্ডায় ১৩ শতক (দাগ নং- সাবেক এস,এ-১০৭, বর্তমান আর,এস-১৬৯) জমিরও মালিক তিনি। এগুলো ভোগ-দখলের জন্য দীর্ঘদিন ধরে জামাল তার সহযোগীদের নিয়ে তৎপরতা চালিয়ে আসছেন। সাভারের জমিটি এরইমধ্যে অবৈধভাবে জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে দখলও করে নিয়েছেন। এজন্য জাল দলিল তৈরি থেকে শুরু করে হেন কোনো কাজ নেই তারা করেননি। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে। পিবিআই তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এর ভিত্তিতে আদালত জামাল হোসেনসহ সব আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছেন।
১৯৯৩ সালে পারিবারিক নিয়মে বিয়ে হয় হেলাল উদ্দিন মজুমদার ও সাহেদা আক্তার দম্পত্তির। ১৯৯৬ সালে সাহেদা ডাইভারসিটি ভিসা (ডিভি) লটারি পেয়ে পরের বছর স্বামীসহ একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমান। সেখানে যাওয়ার পর তাদের আরো দুটি সন্তান হয়। সাহেদা উপার্জিত অর্থ দিয়ে ২০০২ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে স্বামীর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ৪২০ শতক ও সাভারে ১৩ শতক জমি কেনেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি ও মগবাজারে কেনেন দুটি ফ্ল্যাট। ১৯৯৭ সালে আমেরিকা যাওয়ার পর সাহেদা বেগম বাংলাদেশে আসেন চারবার। শেষবার তিনি এসেছিলেন ২০০৯ সালের ১৮ জুলাই। এই সময়ের মাধ্যেই সম্পত্তিগুলো ক্রয় করেন সাহেদা।
২০০৯ সাল থেকেই শুরু হয় সাহেদা-হেলাল দম্পত্তির কলহ-বিবাদ। হেলাল মাদকাসক্ত ছিলেন বলেই কলহ শুরু হয় বলে অভিযোগ সাহেদার। মাদক সেবন করতে গিয়ে সাহেদার উপার্জিত অর্থ নানাভাবে নষ্ট করতেন বলে জানান তিনি। ২০১০ সালে আমেরিকায় একটি দোকান কেনার কথা বলে হাজীগঞ্জের একটি জমি বিক্রির প্রস্তাব দেন হেলাল। তখন সাহেদা জমি বিক্রির জন্য আম-মোক্তার নামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) করে দেন স্বামীর নামে। হেলাল উদ্দিন তার ভাই জামাল হোসেনের সহায়তায় ছলচাতুরি করে হাজীগঞ্জের সবগুলো জমিই নিজেদের করে নেন। ২০১৫ সালে পুনরায় দেশে এসে হেলাল উদ্দিন আরেকটি বিয়ে করেন বলে অভিযোগ স্ত্রী সাহেদার। তখন থেকে তাদের মধ্যে দুরুত্ব আরো বাড়তে থাকে। ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর তাদের মধ্যে আমেরিকান রীতিতে বিচ্ছেদ ঘটে। পরের বছর ৫ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন হেলাল।
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, হেলাল দেশে আসার পর শুরু হয় সাহেদার বাকি সম্পত্তি দখলের তৎপরতা। বড় ভাই উপসচিব জামাল হোসেনের নকশা মতো চলতে থাকে তাদের পরিকল্পনা। সাভারের ১৩ শতক জমি দখল হয়ে ওঠে তাদের পরিকল্পনার মূল অংশ।
সাভারের জমির আম-মোক্তার স্থানীয় মনিরুজ্জামান
সাভারের গেন্ডার জমিটি ২০০৪ সালের ২২ জুলাই রেবেকা সুলতানা নামে এক নারীর কাছ থেকে ক্রয় করেন সাহেদা আক্তার। জমিটি কেনার সময় জামাল হোসেন মজুমদার সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। সাভার সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে সাফ কবলা দলিল বুঝে নেন সাহেদা (দলিল নং- ১৪৭৭৭)। প্রতিবেদন মতে, জমিটি দখলে নিতে জামাল হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যরা মরিয়া হয়ে ওঠলে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের আমেরিকান দূতাবাস এবং আমেরিকার বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে সাভারের গেন্ডার মনিরুজ্জামানকে আম-মোক্তার নিযুক্ত করেন সাহেদা (আম-মোক্তার দলিল নং- ৪৫২৪)।
সাহেদার হয়ে মনিরুজ্জামানের মামলা
পিবিআই সূত্রমতে, জাল দলিলের মাধ্যমে জামাল হোসেন গঙরা সাভারের জমির মালিকানা দাবি করলে এবং বেশ কয়েকবার জমিটি দখল করতে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করলে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন সাহেদা। সেই মোতাবেক তার আম-মোক্তার মনিরুজ্জামান সাভার থানায় মামলা করতে গেলে মামলা নেয়নি পুলিশ। জামাল হোসেনের প্রভাবেই পুলিশ মামলা নেয়নি বলে জানান মনিরুজ্জামান। বেশ কয়েকবার তাঁকে হুমকিও দেন জামাল হোসেন। গত বছরের ৫ নভেম্বর সাহেদার পক্ষে কাজ না করতে মনিরুজ্জামানকে শাসিয়ে যান জামাল হোসেন। পরদিন আবারও মামলা করতে গেলে পুলিশ আগের মতোই বেঁকে বসে। তাই গত বছরের ২৯ নভেম্বর ঢাকার আদালতে মামলা করেন মনিরুজ্জামান। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন। পিবিআইয়ের পরিদর্শক আলী ফরিদ আহমেদ গত ৩ জুন আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে উঠে আসে জামাল হোসেনসহ অন্য আসামিদের নানা অপকর্মের কথা। জমির জাল দলিল ও আম-মোক্তার নামা তৈরি করে কীভাবে সাহেদার জমির মালিক হতে চেয়েছেন, ফুঁটে ওঠে তার আদ্যপান্ত।
জাল দলিলের কারসাজি!
পুলিশ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের ৯ অক্টোবর জামাল হোসেন তার ভাইদেরসহ কয়েকজন সন্ত্রাসী নিয়ে সাভারের জমিটি দখল করতে যায়। মনিরুজ্জামান বাঁধা দিলে তাকে মারধর করে জামাল হোসেন। খবর পেয়ে পুলিশ যায়। কিন্তু জামাল হোসেন, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অপারগতা জানায় পুলিশ। জামালের ছোট ভাই কামাল উদ্দিন পুলিশকে একটি জাল দলিলের ফটোকপি দেখায়। এতে দেখা যায়, ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর সাহেদা আক্তার তাঁর স্বামীর ছোট ভাই কামালের কাছে জমিটি বিক্রি করেন। বড় ভাই জামাল হোসেন যার সাক্ষী। পিবিআই দলিলের সার্টিফায়েড কপি সংগ্রহ করে এতে থাকা সাহেদা আক্তারের টিপসইয়ের সঙ্গে মনিরুজ্জামানকে দেয়া আম-মোক্তার নামায় থাকা টিপসই পরীক্ষা করতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি’র ফরেনসিক শাখায় পাঠায়। অঙ্গুলাংক বিশারদ পুলিশ পরিদর্শক তানজিনারা বেগম পরীক্ষা করে দেখতে পান মূল আম-মোক্তার নামায় সাহেদার আঙ্গুলের ছাপে ৬টি রেখা আছে, আর কামাল উদ্দিনের বিতর্কিত দলিলে সাহেদার আঙ্গুলের ছাপে আছে ৯টি রেখা। কামাল উদ্দিন দলিলটি যে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করেছেন তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পায় পিবিআই।
কামাল উদ্দিনের নামে করা জাল দলিলের খোঁজ করতে গিয়ে এই জমির আরেকটি জাল দলিলের সন্ধান মেলে। এই দলিলে দেখা যায়, গত বছরের ৮ আগস্ট জামাল হোসেন মজুমদার ও তার স্ত্রী সাবা ইসলাম নিজেদেরকে সাহেদার আম-মোক্তার দেখিয়ে ছেলে জাফির হাসানের কাছে জমিটি বিক্রি করেছেন। অথচ উপরোল্লিখিত ছোট ভাই কামাল উদ্দিন মজুমদারের নামে করা জাল দলিলের সাক্ষীও জামাল হোসেন। বিক্রির ক্ষমতা দিয়ে আম-মোক্তার নামাটি সম্পাদিত হয়েছে ২০০৮ সালের পহেলা মার্চ (আম-মোক্তার নামা দলিল নং-২০৮)। পিবিআই সাভার সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে ২০৮ নং দলিলের খোঁজ করে ব্যর্থ হয়। পরে ঢাকার সদর রেকর্ড রুমে যাচাই-বাছাই করে একই নম্বরের একটি দলিল খোঁজে পায়। দলিলে দেখা যায়, এটি কোন আম-মোক্তার নামা নয়, একটি সাফ-কবলা দলিল। জমির অবস্থান সাভারের গেন্ডা নয়, রাজাশন এলাকায়। জমিটি খোদেজা বেগম নামের এক নারীর কাছ থেকে কামরুন নাহার নামে আরেক নারী ২০০৮ সালের ৩ জানুয়ারি ক্রয় করেছেন। সাভারের সাব-রেজিস্ট্রার আবু তালেব সরকারের সহায়তায় জামাল হোসেন জাল-জালিয়াতির এই অপকর্ম সম্পাদন করেছে বলে জানতে পারে পিবিআই।
ছবি: জাফির হাসান মজুমদার
জামাল হোসেনসহ আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
চলতি বছরের ৩ জুন জামাল হোসেন মজুমদারসহ সব আসামির বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পিবিআই। ফৌজদারী কার্যবিধির ৭৫ ধারা মোতাবেক আসামি জামাল হোসেন মজুমদার, হেলাল উদ্দিন মজুমদার, কামাল উদ্দিন মজুমদার, সাবা ইসলাম, জাফির হাসান, কামাল উদ্দিনের জাল দলিলের সাক্ষী শওকত হোসেন ও কামাল উদ্দিনের জাল দলিল তৈরিতে সহায়তাকারী আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে গত ১৫ জুলাই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। জামাল হোসেনের পরিবারের সবার ঠিকানাই দেয়া আছে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ। হাজীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, এখনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তারা পাননি। চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর দপ্তর) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানও বলেন, পুলিশ সুপার কার্যালয়েও পরোয়ানাগুলো পৌঁছায়নি। অথচ পরোয়ানা জারির পর পেরিয়ে গেছে এক মাস পাঁচ দিন।
সার্বিক বিষয়ে সাহেদার স্বামী হেলাল উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাহেদা আক্তার তাদের পরিবারের সঙ্গে বেইমানি করেছে। তাকে ঠকিয়ে সব সম্পত্তি নিজের করে নিয়েছে। এর স্বপক্ষে তিনি প্রমাণ দেখানোর কথা বলেন। কিন্তু কোন প্রমাণ নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। হেলাল উদ্দিন ২০১৫ সালে হাজীগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ছিলেন। বর্তমানে তিনি উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক।
জামাল হোসেন মজুমদারের সঙ্গে এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে এই প্রতিবেদক। ঈদুল আযহার আগে ফোন করে পরিচয় দেয়ার পর তিনি কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানের সামনে আছেন বলে, পরে যোগাযোগ করতে বলেন। ঘন্টা খানেক পরে যোগাযোগ করলে তিনি আর ফোন ধরেননি। এর কিছুক্ষণ পরই হেলাল উদ্দিন মজুমদার এই প্রতিবেদককে ফোন করেন এবং তার বিকাশ নম্বর চেয়ে অর্থের লোভ দেখান। ঈদের পর জামাল হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোন এবং ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে বেশ কয়েকদিন যোগাযোগের চেষ্টা করে এই প্রতিবেদক। কিন্তু কোনভাবেই সাড়া দেননি জামাল হোসেন। ফলে জাল-জালিয়াতির বিষয়ে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ছবি: হেলাল উদ্দিন মজুমদার
এসজে

মন্তব্য করুন

daraz
  • অপরাধ এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
তিন উপসচিবের দপ্তর বদল
X
Fresh