• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

একাত্তরে নৃশংস নির্যাতনেও অটল ছিলেন যে যোদ্ধা

ইয়াছিন রানা সোহেল

  ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:০৭

একাত্তরে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে দেশপ্রেমের অনন্য নজির রেখেছেন শহিদ এম আবদুল আলী। ১২দিনের নির্মম নির্যাতনে তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করার পর বস্তাবন্দি করে ফেলে দেয়া হয় কাপ্তাই হ্রদে, অথৈ জলে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে ইতিহাস চাপাই পড়েছিল দীর্ঘ ৪৪ বছর।

দেশের এক দশমাংশ, অবিভক্ত পার্বত্য জেলা রাঙামাটির এসডিও তথা মহকুমা প্রশাসক হিসেবে ১৯৭০সালের ২০ নভেম্বর যোগ দেন এম আবদুল আলী। মূলতঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশেই তিনি রাঙামাটি মহকুমার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কারণ এ পদে দায়িত্বরত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেন। আর দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলে কর্মরত থাকায় তাঁকে নিয়ে পরিবার ও স্বজনরা বেশ চিন্তিত ছিলেন। বিশস্ত এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না, যিনি দুর্গম এ পার্বত্যাঞ্চলে দায়িত্ব নেবেন। অবশেষে এসডিও হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পরপরই এম আবদুল আলীকে রাঙামাটি মহকুমা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দেন। ৭০-এর নির্বাচনের পর যখন পাক বাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করছিল তখন পূর্ব বাংলায় এক রকম অলিখিতভাবে বঙ্গবন্ধুর শাসনই চলছিল।

বঙ্গবন্ধুকে অকৃত্রিম ভালবাসতেন এম আবদুল আলী। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর মুক্তিকামী বাঙালি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। তখন দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলে মুক্তিকামী ও সংগ্রামী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদেরকে জেলা সদরের পুলিশ লাইন ও স্টেশন ক্লাবে ছাত্র, যুবক ও আপামর জনসাধারণকে যুদ্ধ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। পুলিশ সুপার বজলুর রহমান ও মহকুমা প্রশাসক হিসেবে এম আবদুল আলীই প্রশিক্ষণের সার্বিক দেখাশুনা করতেন।

মুলতঃ ২৫মার্চের আগেই মহকুমা প্রশাসক এম আবদুল আলী জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) ও পুলিশ বাহিনীর অবাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে ক্লোজ করে নিয়ে আসেন। বাঙালি সৈনিকদেরও প্রস্তুত রাখা হয়-নির্দেশ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেনো সবাই রাঙামাটি শহরে চলে আসে এবং অবাঙালি সদস্যদের গ্রেপ্তার করে।

২৫ মার্চের পর জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ আবদুস সামাদ ও পুলিশ সুপার বজলুর রহমানসহ প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নিরাপদ আশ্রয়ে সীমান্তের ওপারে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ বারবার বলার পরেও এম আবদুল আলী ওপারে যাননি।
দিন যত গড়াতে থাকে রাঙামাটি ততই জনশূন্য হয়ে পড়তে থাকে। এদিকে উল্কার মতো শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়াতে থাকেন এম আবদুল আলী। আর মুক্তিকামী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সাহস যোগাতে থাকেন। তাদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রের ব্যবস্থাও করেন।

১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি দোসরদের সহায়তায় রাঙামাটি দখলে নেয় শত্রু বাহিনী। এম আবদুল আলী তখনো জানতেন না-রাঙামাটি শত্রু বাহিনী দখলে নিয়েছে। ১৬ এপ্রিল ডিসি বাংলো ঘাটে স্পিড বোটযোগে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসেন তিনি। বোট ঘাটে ভেরার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানি সৈন্যরা দৌঁড়ে নেমে আসে। শত্রু বাহিনী রাঙামাটি দখলে নিয়েই খুঁজতে থাকেন জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ আবদুস সামাদ, পুলিশ সুপার বজলুর রহমান, এসডিও (মহকুমা প্রশাসক) এম আবদুল আলীর মত সরকারের উর্ধ্বতন বাঙালি কর্মকর্তাদের। স্পিডবোটযোগে যেহেতু এসেছে সে হিসেবে নিশ্চয় বড় কোনো সরকারি কর্মকর্তা হবেন তাই পাকিস্তানি সৈন্যরা আবদুল আলীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় কমান্ডারের কাছে। যখন পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলো, পাকিস্তানি সৈন্যরা ‘শুয়োর কা বাচ্চা’ বলে রাইফেলের বাট দিয়ে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেয়। আর বোটের পাটাতন উল্টাতেই দেখে-বস্তা ভর্তি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এসময় এম আবদুল আলীর সঙ্গে তাঁর বড় ছেলে ইউসুফ হারুনও ধরা পড়েন।

প্রথমে আবদুল আলীকে জিজ্ঞেস করা হয়-এইচ টি ইমামসহ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা কোথায় আশ্রয় নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধারা কোন পথ দিয়ে গিয়ে, কোথায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আর তাদের অস্ত্র ও রসদ কোথা থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো কথারই উত্তর দিচ্ছিলেন না এম আবদুল আলী। এরপরই তাঁর ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। তাঁর কাছ থেকে কথা বের করার জন্য প্রথমে তার আঙ্গুলে সুই ফুটানো হয়। এরপর হাতের সব আঙ্গুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়। বারবার চেষ্টা করেও যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা কোনো তথ্যই বের করতে পারছিল না, তখন পিতা-পুত্রের উপর অভিনব কায়দায় চালানো হয় নির্যাতন। ফ্যানে লটকিয়ে বেত্রাঘাত করা হতো পিতা-পুত্রকে। অন্ধকার ঘরে দুজনকে বন্দি করে রাখা হতো। সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়া হতো শরীরে। তাদের এমন বন্দিদশা থেকে মুক্তির কোনো পথই ছিলো না। পিতা-পুত্রের এ দৈন্যদশা দেখে পাহাদারের মনে দয়া হল। তিনি জানালার শিক খুলে দিয়ে ছেলে ইউসুফ হারুনকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

এদিকে পুত্র পালিয়ে যাওয়ার পর পিতার ওপর নির্যাতনের মাত্রা যায় বেড়ে। একদিন তাকে লম্বা রশি দিয়ে জীপের পিছনে বেঁধে টানা হয়। চলন্ত জীপের পিছনে কিছুক্ষণ দৌঁড়ানোর পর এম আবদুল আলী পড়ে যান। তারপর তাঁকে হেঁচড়ানো হয়। এতে শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ে। এভাবে গাড়ি দিয়ে তাঁকে যখন টানা হচ্ছে, পাকিস্তানি সৈন্যরা জোরে জোরে চিৎকার করে লোকজনকে জানাতে থাকে-‘তোমারা এসডিও বাপ কা হালত দেখো; তোমারা এসডিও বাপ কা কিয়া হালত হ্যায় দেখো’।
প্রায়ই নানা কায়দায় তাঁর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চলতো। তাঁর শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলা হতো। ক্ষুধা আর পিপাসায় ছটফট করে খাবার ও পানি চাইলে মুখের মধ্যে ইট ঢুকিয়ে দেয়া হত। এ অবস্থায় মুখটা যখন হা হতো তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা মুখে ভেতর প্রস্রাব করে দিতো। আবদুল আলীকে খোলা জায়গায় এনে অন্য বন্দিদের দেখিয়ে গরম ড্রামের ছ্যাঁকা দিতে দিতে বলা হতো-‘তোমাদের অফিসারের কি শাস্তি হচ্ছে দেখো’। নিয়মিত নির্যাতনে তার কপালের সামনের অংশ ঝুলে পড়েছিল। ঐ ক্ষত স্থানে লবণ ঢেলে দিত পাকিস্তানি সৈন্যরা। যন্ত্রণায় ছটফট করে চিৎকার করতেন আবদুল আলী। আর পাকিস্তানি আর্মি তখন উল্লাসে ফেটে পড়তো।

১২দিনের নির্মম নির্যাতনের পর ২৭এপ্রিল ক্ষত-বিক্ষত আবদুল আলীর নিথর দেহ কেটে টুকরো টুকরো এবং বস্তাবন্দি করে ফেলে দেয়া হয় কাপ্তাই হ্রদে।
এম আবদুল আলী রাঙামাটিতে এসডিও হিসেবে যোগদানের পর শহরের ‘কায়েদে আজম মেমোরিয়াল একাডেমি’ স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্বও পড়ে তার ওপর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ স্কুলের নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিলে সর্বসম্মতভাবে স্কুল পরিচালনা কমিটির সবাই যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী এম আবদুল আলীর নামে নামকরণের প্রস্তাব করেন। ফলে স্কুলটির নাম ‘কায়েদে আজম মেমোরিয়াল একাডেমি’ বদলে ‘শহীদ আবদুল আলী একাডেমি’ করা হয়। এছাড়া শহরের পুরাতন স্টেডিয়ামের পাশে আইয়ুব খানের আমলে বসানো একটি ফলক উপড়ে ফেলে স্থানটি শহীদ এম আবদুল আলীর বেদী করা হয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন উৎসর্গকারী এ সৈনিকের বীরত্বগাঁথা কিংবা যুদ্ধ অবদান নিয়ে ছিল না কোনো কাগুজে ডকুমেন্ট। তার নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলে তার একটি আঁকা ছবি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও জানতো না-কে এই শহীদ আবদুল আলী। এমনকি কোনো সংবাদকর্মীও খোঁজেনি এ বীরের ইতিহাস। কারো কাছে তেমন কোনো তথ্যই ছিলনা। এ শহীদ পরিবারের সঙ্গে রাঙামাটির কারোরই যোগাযোগ ছিল না। পালন করা হতো না তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীও। এমনকি জাতীয় দিবস সমূহেও তাঁর বেদীতে শ্রদ্ধা জানানো হতো না।

অবশেষে ২০০৫ সাল থেকে খোঁজ শুরু শহিদ এম আবদুল আলীর ইতিহাস ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের।শহরের প্রবীণ অনেক ব্যক্তির কাছে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরেছি বারবার। এখানে-সেখানে তাঁর ইতিহাস ও পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে থাকি। ২০১২সালের গ্রীষ্মের এক দুপুরে রাঙামাটি প্রেস ক্লাবের পাশে চা-দোকানে বসে আছি। এমন সময় একভদ্র লোক এসে জিজ্ঞেস করলেন-শহীদ এম আবদুল আলীর নামে করা শহীদ বেদীটি কোথায়, বলতে পারেন। শুনেই দাঁড়িয়ে গেলাম। সঙ্গে একজন ভদ্র মহিলাও ছিলেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী। একশ’ গজ দূরে অবস্থিত বেদীতে নিয়ে গেলাম তাদের। ভদ্র লোক ছিলেন শহিদ এম আবদুল আলীর ভাগ্নি জামাই। তাদের মাধ্যমে খুঁজে পেলাম শহিদ এম আবদুল আলীর সন্তানদের। এরপর যোগাযোগ শুরু করলাম। সংগ্রহ করতে লাগলাম স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গকারী এ বীর সেনার তথ্য ও চিত্র।

২০১৫ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকাশ করি তাঁর জীবনী গ্রন্থ ‘মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় বীর শহিদ এম আবদুল আলী’ নামের বইটি। এটি প্রকাশের পর সবখানে এ বীর শহিদের বীরত্বগাঁথা আলোচিত হতে থাকে। রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোঃ সামসুল আরেফিনের চেষ্টায় বিষয়টি নজরে আসে সরকারের। ফলে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য ও অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ শহিদ এম আবদুল আলীকে ২০১৬সালে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে সরকার। ২০১৬সালের ২৪মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে শহিদ এম আবদুল আলীর কনিষ্ঠ কন্যা নাজমা আকতার পুরস্কার গ্রহণ নেন। আর এটিই তিন পার্বত্য জেলায় প্রথম স্বাধীনতা পদক।

এসজেড

মন্তব্য করুন

daraz
  • বাংলাদেশ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh