‘আগুন’ নেভানো ও ‘ঘর’ গোছানোর এক মাস
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে৷ প্রথম এক মাসে ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার কতটুকু প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে? সরকার কি সঠিক পথে আছে?
প্রথম এক মাসে সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপ ইতিবাচক বলে মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন৷ তিনি বলেন, এখনো সরকারের কাজ নিয়ে বিশ্লেষণের সময় হয়নি৷ তাদের আগুন নেভাতে আর ঘর গোছাতেই সময় চলে গেছে৷ এর মধ্যে শুরুতেই বানের মতো দাবি আসতে শুরু করে৷ তারপর আসে সত্যিকারের বান, অর্থাৎ বন্যা৷ এগুলো সামাল দিতে হয়েছে৷ তারপরও কিছু পদক্ষেপ তারা নিয়েছে, সেটা ইতিবাচক৷
যেমন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করেছে৷ এটা সুশাসনের ইঙ্গিত বহন করে৷ এছাড়া আহসান এইচ মনসুরের মতো ব্যক্তিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে৷ তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অনেকগুলো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে হাত দিয়েছেন, যেগুলো আগে দুর্বৃত্তদের হাতে ছিল৷ এছাড়া কিছু সৎ ও সাহসী মানুষ এই সরকারে যোগ দিয়েছেন৷ তাদের কাছ থেকে আমরা ইতিবাচক ফল আশা করতেই পারি৷
নতুন এই সরকারের হাতে গত এক মাসে প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদলের ঘটনা ঘটেছে, যা এখনো চলমান আছে৷ সেই সঙ্গে দেশের আর্থিকখাতসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে সংস্কার উদ্যোগ৷ স্থানীয় জনপ্রতিধিদের অপসারণ করে তাদের জায়গায় বসানো হয়েছে প্রশাসক৷ ব্যাংকখাত সংস্কারে সিদ্ধান্ত হয়েছে আলাদা কমিশন গঠনের৷ সেই সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, অনিয়ম-জালিয়াতির ঋণ ও পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার৷ কর্মবিরতি ও হামলার ভয় কাটিয়ে আবারও মাঠে ফিরেছে পুলিশ৷ পোশাক ও লোগো পরিবর্তনসহ নানান সংস্কারের মাধ্যমে বাহিনীকে জনবান্ধব করে গড়ে তোলার কথা বলছে নতুন সরকার৷
যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিগত সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করেছেন, নতুন সরকার কি সেই পথে হাঁটছে? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রিয়াজ উদ্দিন সাকিব বলেন, কেবল তো এক মাস, আমরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম, তার প্রতিফলন এই সরকারের মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি৷ ড. ইউনূসের মতো যোগ্য মানুষ সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন৷ সরকারে যারা আছেন, তাদের উপর আমাদের আস্থা আছে৷ তবে সব ক্ষেত্রে যে এই এক মাসে সফলতা এসেছে, এমনটি নয়৷ কিছু ক্ষেত্রে হয়ত আমাদের রেজাল্ট পেতে আরো একটু সময় লাগবে৷ তবে আমরা সরকারের উপর বিশ্বাস রাখছি৷
হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ আমলের এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে হচ্ছে একের পর এক মামলা৷ গ্রেপ্তারও হয়েছেন অনেকে৷ এর বিপরীতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার একাধিক মামলার সাজা বাতিল করা হয়েছে৷ মুক্তি দেওয়া হয়েছে কারাগারে বন্দি বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের৷ সেইসঙ্গে জামিন দেওয়া হয়েছে জঙ্গি কার্যক্রমসহ গুরুতর মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে, যা নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে৷
পুলিশ কাজে ফিরলেও পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করেনি৷ এছাড়া শেখ হাসিনার পতনের পর সরকারি, আধা-সরকারি, এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক দেখা যাচ্ছে৷ এক্ষেত্রে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছাড়ছেন, আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ, অপমান-অপদস্থসহ নানান চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন৷
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক মাসের কাজে ছাত্র-জনতার ইচ্ছার কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে তা জানতে চাইলে অন্যতম সমন্বয়ক ওয়াহিদ উজ জামান বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের যে কাজ, সেটা সরকারে থেকে বা বাইরে থেকে- সব জায়গা থেকেই করতে হবে৷ সরকারে যারা আছেন, তারা তাদের কাজটা করছেন, আর আমরা যারা বাইরে আছি, আমরা আমাদের কাজটা করছি৷ দেখেন, বিগত সরকারের সময়ও বন্যা হয়েছে, কতজন মানুষ ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে এসেছে? এবার দেখেন সাধারণ মানুষ কিভাবে ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে এসেছে৷ কারণ, সবাই এই সরকারকে নিজের সরকার ভাবছে৷ এটাই কিন্তু আমাদের চাওয়া৷ সরকার কেবল শুরু করেছে, আমরা আশা করছি, সঠিক পথেই চলছে৷ সামনের দিনেও ভালো কিছু আমরা আশা করতে পারি৷
দুর্নীতি, হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানান অভিযোগ থাকার পরও গত দেড় দশকে যাদের বিরুদ্ধে সেভাবে আইনি ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি, আগের সরকারের সেইসব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখন মামলা হতে দেখা যাচ্ছে৷ এর মধ্যে ইতোমধ্যেই শতাধিক মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, যেগুলোর বেশিরভাগই হত্যা মামলা৷ একইভাবে আসামি হয়েছেন সজীব ওয়াজেদ, সায়মা ওয়াজেদ, শেখ রেহানাসহ আওয়ামী লীগ সভাপতির পরিবার ও নিকট আত্মীয়দের অনেকে৷ সেইসঙ্গে, সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতার বিরুদ্ধে মামলা হতে দেখা গেছে৷
সরকার যে প্রক্রিয়ায় এই মামলাগুলো করছে তা ঠিক হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, একটা অভ্যুত্থানের পর আপনি চাইলেই সবকিছু সঠিকভাবে করতে পারবেন না৷ কারণ, এখানে অনেক মানুষের চাওয়া পাওয়ার বিষয় থাকে৷ কেউ মামলা করতে গেলে পুলিশ যদি সেই মামলা না নেয়, তাহলে তারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করবে, হতাশায় ভুগবে৷ এখন মামলা মানেই তো সবকিছু না৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তো ইতিমধ্যে বলা হয়েছে মামলা মানেই গ্রেপ্তার নয়৷ এই মামলাগুলো তদন্ত হবে, তারপর পুলিশ চার্জশিট দেবে৷ এরজন্য সময় লাগবে৷ আমার মনে হয়, তদন্তে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে৷
সরকারের এক মাসের কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে গিয়ে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, এখনো মূল্যায়নের সময় হয়নি৷ শেখ হাসিনাকে জনরোষে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হলেও তিনি কিন্তু সব যে খারাপ কাজ করেছেন, তা নয়৷ এখন এই সরকার কেবল দায়িত্ব নিলো৷ ফলে তারা যদি ভালো কাজ করেন, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে, তাহলে জনগণ প্রশংসা করবে৷ আর যদি তারা ভালো কিছু না করতে পারেন, তাহলে মানুষ সমালোচনা করবে৷ ফলে তাদের কাজের মূল্যায়ন করার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে৷ এক্ষুনি কিছু বলা ঠিক হবে না৷
মন্তব্য করুন