ঢালাও মামলায় আসামি হচ্ছেন রাজনীতির বাইরে থাকা ব্যবসায়ীরাও
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার থেকে শুরু করে সরকার পতনের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লাগাতার কর্মসূচির সময়টাতে ঘটে যাওয়া সহিংসতাগুলোকে কেন্দ্র করে মামলা হচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট হাজারো ব্যক্তির নামে অসংখ্য মামলা হয়ে গেছে এরই মধ্যে, যেখানে শুধু হত্যা মামলাই আছে কয়েকশো। এমন ঢালাও মামলায় ফেঁসে যাচ্ছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাহীন অনেক ব্যক্তিও। আসামির তালিকায় ঢুকে গেছে এমন অনেক ব্যবসায়ীর নামও, রাজনীতির সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্কই নেই যাদের।
শুধু তাই নয়, এমন হত্যা মামলার খোঁজও পাওয়া গেছে, যেখানে ভিকটিমের মারা যাওয়ার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহের কোনো সম্পর্কই নেই; এমনকি মারা গেছেন আন্দোলন শুরুর অনেক আগে।
অভিযোগ আছে, চাঁদা ও অনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্যই এমন অনেক ব্যবসায়ীকে আসামি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তৈরি পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসাসহ বিভিন্ন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটিও।
আরও অভিযোগ, মামলায় কারা আসামি হবেন, কারা হবেন না—সেটা অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ করছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বিএনপি বা দলটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা। আবার কোনো কোনো নেতাকে ব্যবহার করে স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরাও তাদের প্রতিপক্ষকে মামলায় ফাঁসাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জেই এমন পাঁচটি মামলার খবর পাওয়া গেছে, যাতে অন্তত সাতজন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাহীন ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি হত্যা মামলা আড়াইহাজার থানার। মামলা দুটিতে আসামি করা হয়েছে বৃহৎ রপ্তানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফকির গ্রুপের তিনজনকে। তারা হলেন ফকির নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আক্তারুজ্জামান ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মাশরিকুজ্জামান নিয়াজ এবং ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ। উভয় মামলায় ঢাকার বাইরের একজন পরিবহন ব্যবসায়ীকেও আসামি করা হয়। মামলা দুটির এজাহারের বর্ণনা প্রায় একই। দুই এজাহারেই এসব ব্যবসায়ীর নামের ক্রমিকও একই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফকির গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজারের মতো কর্মী কাজ করছেন। তাদের তৈরি পোশাক কারখানার ঝুটসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত মালামালের ব্যবসা করেও অনেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এটি আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা নিয়ন্ত্রণ করতেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপির একাধিক পক্ষ এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে আড়াইহাজার এলাকায় প্রভাবশালী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা বড় অঙ্কের অর্থ দাবি করে বলেও অভিযোগ আছে। এর জেরে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ব্যক্তিদের নাম আড়াইহাজার থানার দুটি হত্যা মামলায় জড়ানো হয়।
ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদের দাবি, তাদের পরিবার কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ব্যবসায়িক সুনাম ক্ষুণ্ন ও হয়রানি করার উদ্দেশ্যে তাদের হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, আরও মামলায় জড়ানোর হুমকি–ধমকিও দেওয়া হচ্ছে।
জানা যায়, মামলা দুটির মধ্যে একটি হলো বিএনপির কর্মী সফিকুল ইসলাম হত্যা মামলা। তাকে গত ১৯ জুলাই কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তার স্ত্রী তাছলিমা আক্তার বাদী হয়ে ২১ আগস্ট আড়াইহাজার থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সেখানে ১০ থেকে ১৩ নম্বর ক্রমিকে এই চার ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করা হয়।
মামলায় এসব ব্যবসায়ীর নাম কে বা কারা দিয়েছেন, সেটা স্বীকার করেননি তাছলিমা আক্তার। তবে তার দাবি, জেনে-বুঝেই মামলা করেছেন তিনি।
আড়াইহাজার থানার অপর মামলাটির খোঁজ নিতে গিয়ে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। দুপ্তারা ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি বাবুল মিয়াকে হত্যার অভিযোগ এনে ২২ আগস্ট মামলাটি করেন ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন।
এতে বলা হয়, ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সচেতন নাগরিক হিসেবে অংশ নেন বাবুল। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বাড়ি ফেরার পথে পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাবুল মিয়াকে কালীবাড়ি বাজার থেকে উঠিয়ে নিয়ে দুপ্তারা ঈদগাহ মাঠে হত্যা করা হয়।
অথচ বাবুলের মৃত্যুসনদ ও স্বজনদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি মারা গেছেন ৩ জুন। তার মৃত্যুতে বিএনপির মহাসচিব তখন শোকবার্তাও পাঠিয়েছিলেন।
নিহত বাবুলের পরিবার ও এলাকাবাসী জানান, গত ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর ছোট ভাই নাজমুল হোসেনের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা বাবুলকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর ৩ জুন হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
৩ জুন উপজেলার গিরদা-পশ্চিমপাড়া-চৌধুরীপাড়া কবরস্থানে বিএনপির নেতা বাবুলের মরদেহ দাফন করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক সেলিম মিয়াও। এছাড়া, ৩ জুন যে ৪৯ বছর বয়সী বাবুলের মৃত্যু হয়েছে, সেই মৃত্যুসনদ প্রদান করেছে রূপগঞ্জের ভুলতায় এলাকায় অবস্থিত ডিকেএমসি হাসপাতাল লিমিটেড।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, সাজানো মামলা করতে রাজি ছিল না বাবুলের পরিবার। এ কারণে পরিবারটির কাউকে মামলায় সাক্ষীও করা হয়নি।
এ ব্যাপারে বাবুল হত্যা মামলার বাদী বিএনপির নেতা নুরুল আমিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, দলের সিদ্ধান্তে মামলাটি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পরে যোগাযোগ করা হয় আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এহসান উল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, থানায় অভিযোগ নিয়ে আসায় এজাহার গ্রহণ করা হয়েছে। নিরপরাধ কেউ থেকে থাকলে সেটি তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
এদিকে গত ৫ আগস্ট হাফেজ সোলাইমান নিহত হওয়ার ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় করা মামলায় রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি আসামি করা হয় আরএস নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিকেএমইএর সহসভাপতি মোর্শেদ সারোয়ারকেও।
মোর্শেদ সারোয়ার বলেন, ‘আমি কখনো রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম না। কী কারণে আমাকে এ হত্যা মামলায় জড়ানো হলো, তা বুঝতে পারছি না।’
একইভাবে ফতুল্লা থানার একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে ভুঁইগড়ের এসবি স্টাইল লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানকে।
অন্যদিকে এক বছর আগের একটি মারপিটের ঘটনায় জনৈক নাজমুল ইসলাম রনি ২৭ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ ১৯৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। মামলায় ভাই ভাই স্পিনিং মিলের মালিক লাক মিয়াকেও আসামি তালিকাভুক্ত করেন তিনি।
এছাড়া ১৯ জুলাই রাজধানীর বাড্ডায় তৌফিকুল ইসলাম নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা হয় ২১ আগস্ট। বাড্ডা থানার এ মামলায় ১১৩ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়। এর মধ্যে রাজউকের প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম ও উত্তরার ব্যবসায়ী শেখ মো. রুহুল আমিনের নামও রয়েছে।
রুহুল আমিন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। মামলার বিষয়ে রাজউকের প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলামের দাবি, তাকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে আসামি করা হয়েছে। একটি চক্র কিছুদিন ধরে তাকে হুমকি দিচ্ছিল, এই পদত্যাগ করার জন্য।
মন্তব্য করুন