‘ছেলে হত্যার বিচার আল্লাহর কাছে দিয়েছি’
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শঙ্করচন্দ্র গ্রামের মণ্ডলপাড়ার আবু সাঈদের ২য় সন্তান শাহরিয়ার শুভ (২৬)। ঢাকায় চাকরির সূত্রে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। এসএসসি পাস করার পর যশোরে বিসিএমসি পলিটেকনিক থেকে ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরির জন্য ঢাকায় চলে যান। সেই থেকে তিনি ঢাকায় বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করছেন। তিন বছর ধরে তিনি কোহিনুর লিফট কোম্পানিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঢাকার মিরপুর এলাকার বসির উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে ভাড়া বাসায় থাকতেন।
ঢাকায় কোটাবিরোধী আন্দোলন যখন চলমান ছিল তখন শুক্রবার (১২ জুলাই) সন্ধ্যার দিকে শিশু সন্তানের জন্য খাবার কেনার জন্য বাসাবাড়ি থেকে বের হন শাহরিয়ার শুভ। বাসা থেকে বের হওয়ার পর মিরপুর ২-১০ নাম্বারের মাঝামাঝি এলাকায় পৌঁছায়। এ সময় তিনি মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে আগারগাঁও নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রাতে মারা যান। রাতেই তার মরদেহ চুয়াডাঙ্গায় গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। গ্রামের কবর স্থানে বুধবার দাফন করা হয়।
এদিকে ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় শুভর মা। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ছেলে চাকরি করত, এর ওপর আমরা নির্ভর ছিলাম। আমি চেয়েছিলাম না এমন দিন আসবে। বউমা আর শিশু সন্তানের দায়িত্ব নেবে সরকার? সব দায়িত্ব ওর মাথায় ছিল। এখন আর কিছু বলার নেই। এত কষ্ট করে ছেলে মানুষ করার পর, সেই ছেলে আমি বলি দিয়ে আসলাম। ছেলে হত্যার বিচার আল্লাহর কাছে দিয়েছি। ঘটনা শোনার পর আমি শয্যাগত হয়ে পড়েছি। আমি কিছুই চাই না সরকার যেন মাসুম বাচ্চাটা আর বউমার জন্য কিছু করে।
মা-বাবা, স্ত্রী, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজনসহ গ্রামবাসী শাহরিয়ার শুভকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ। তিন ভাই আর এক বোনের মধ্যে সে ছিল মেজ। ৬ বছর আগে মাগুরা জেলার আড়পাড়া এলাকার রিজিয়া সুলতানার সঙ্গে ৬ বছর আগে বিয়ে হয়।
নিহত শাহরিয়ার শুভর স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা বলেন, বলার মতো কোনো ভাষা নেই। অসহায় অবস্থায় পড়ে গেছে। এতটুকু ছেলেকে নিয়ে কী করব। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল। এক ঝড়েই সব তছনছ হয়ে গেছে। কোন দিকে যাব কী করব, কিছুই জানি না। বাচ্চা নিয়ে কী করব, তাও জানি না। সরকার চাকরির ব্যবস্থা করলে সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারব। সন্তান মানুষের মতো সুন্দর পরিবেশ দরকার, এখন সব হারিয়েছি। ঘটনার আগে যখন বাসা থেকে বের হয় তখন বলে যায়, নিচে যাচ্ছি তোমাদের জন্য খাবার কিনতে যাচ্ছি। বলে গিয়েছিল আধা ঘণ্টা পর বাসায় ফিরে আসব। কিন্তু ফিরে এলো লাশ হয়ে। আমাকে বিধবা করে চলে গেল। সন্তান হলো এতিম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতা পেলে শতকষ্টের মাঝে শিশু সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারব। আর একমাত্র সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করতে পারব। ৭ মাস বয়সের ছেলে সন্তান রয়েছে। আমার মতো যেন কোনো মেয়ের এমন ঘটনার শিকার না হতে হয়।
শুভর ছোট ভাই বলেন, ঘটনার আগের দিন আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাইয়ের বাসায় চলে আসি। ভাই সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ভাবিকে বলে তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসি বাইরে থেকে। ভাই বাসায় না ফেরায় ভাবি ফোন দিলে কেউ রিসিভ করেনি ফোন। গ্রামের বাড়ি থেকে খবর আসে শুভ কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনার মধ্য পড়ে গুলিতে আহত হয়েছে। এরপর ভাইকে মিরপুর ঘটনাস্থলে খুঁজতে গেলে জানান আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ভাইকে আগারগাঁও নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে আহত অবস্থায় খুঁজে পাই। মাথায় আঘাত ছিল গুলির। মঙ্গলবার ভাই মারা যায় আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
মন্তব্য করুন