• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

‘ওডারল্যান্ড ফর আওয়ারল্যান্ড’

কুশল ইয়াসির

  ২৬ মার্চ ২০১৭, ১৭:২৭

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মুক্তিবাহিনীতে বেশ কিছু বিদেশিও অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে কেউ ছিলেন সাংবাদিক। কেউ কবি। কেউ চিত্রশিল্পী কেউ আবার গায়ক। মুক্তিবাহিনীর প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে আমাদের মহান অর্জনে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন যারা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড। তিনিই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা যিনি মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য পেয়েছিলেন 'বীর প্রতীক' উপাধি। কিন্তু এ বীরের কথা অনেকেরই জানা নেই। আর যারা জানেন তারাও ভুলতে বসেছেন হয়তো।

মহান এ যুদ্ধের প্রায় ৩০ বছর পর সিতারা, তারামন বিবিকে খুঁজে বের করে সম্মানিত করা হয়েছে। কিন্তু ওডারল্যান্ডের কথা হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতির গভীরে। ভিনদেশি হয়েও একটি জাতির মুক্তির সংগ্রামে জীবনবাজী রেখে সম্মুখ সমরে নামার যে সৎ সাহস ও মানসিকতা তিনি দেখিয়েছিলেন তার এ অবদানের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতার ভাষা আমাদের নেই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ওডারল্যান্ডকে নিয়ে আরো জানতে গবেষণা শুরু করেন মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া নামে এক ব্যাংকার। পরে তিনি বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এ যোদ্ধাকে নিয়ে লিখে ফেলেন জীবনী। ‘ওডারল্যান্ড ফর আওয়ারল্যান্ড’এ বায়োগ্রাফিতে উঠে এসেছে এ বীরপ্রতীকের নানান তথ্য।

মামুনুর রশীদ যখন তথ্য সংগ্রহ করছিলেন তখন সবচে’ বেশি সাহায্য পেয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের (হল্যান্ড) সাবেক রাষ্ট্রদূত জেফ ইজারম্যানস (২০০০-২০০৪) ও দূতাবাসের রাজনৈতিক, সংবাদপত্র ও সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব মনিক ডি গ্রুট ও দূতাবাসের কর্মকর্তা বিরজিটা স্মিথের কাছে।

বিরজিটা স্মিথের কাছে ওডারল্যান্ডের ব্যাপারে জানতে চেয়ে মেইল করা হলে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন।

উইলহেলমাস আব্রাহাম সিমন ওডারল্যান্ড বা ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর আমস্টারডামে জন্মান করেন। তার বাবার নাম উইলহেলমাস আব্রাহাম সিমন ভেইজ।

১৯১৮ সালে ৪ জানুয়ারি ওডারল্যান্ড হল্যান্ডের পারিবারিক কার্ড পান। ১৯২০/২১ সালের আদমশুমারিতে ওডারল্যান্ডের পরিবারের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। জানা যায়, পরিবারটি জার্মানিতে পাড়ি জমায়।

ওডারল্যান্ড ১৯৩৬ সালে জার্মানির ন্যাশনাল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৪০ সালের মে মাসে জার্মানরা হল্যান্ডে হামলা চালানোর কয়েকদিন আগেই তিনি ডাচ রয়্যাল সিগন্যালস কর্পের সার্জেন্ট হিসেবে যোগ দেন।

মাতৃভূমি হল্যান্ডে জার্মানের হামলা ঠেকাতে যুদ্ধে নেমে পড়েন তিনি। জার্মানরা হল্যান্ড দখল করলে যুদ্ধবন্দি হন। সেখান থেকে পালিয়ে যোগ দেন ডাচ আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যাসিসটেন্স মুভমেন্টে।

সংস্থাটির জন্য পথ নির্দেশক, দোভাষী ও আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দানসহ বিভিন্ন কাজ করতেন ওডারল্যান্ড। মা জন্মগত জার্মান হওয়ায় কাজটি সহজ হয়েছিলো তার জন্য। জার্মান উচ্চপদস্থের কাছে থেকে তথ্য পেতে ছদ্মবেশ ধারণ করতেন তিনি। পরে ১৯৪৫ সালে জার্মান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর হল্যান্ড স্বাধীনতা লাভ করে।

১৯৭০ সালে বাটা কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে ঢাকায় নিযুক্ত হন ওডারল্যান্ড। বাঙালি জাতি তখন বৃহত্তর যুদ্ধের জন্য ফুঁসছে।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতা ওডারল্যান্ডকে ইউরোপের নাৎসিদের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ অত্যাচার তাকে বিদ্রোহী করে তোলে। বিদেশী হিসেবে তখন নগরজুড়ে বিচরণের বাধা ছিল না। এ সুযোগে তিনি অত্যাচারের নমুনা ক্যামেরায় ধারণ করতেন। আর এগুলো আন্তর্জাতিক মহলের মত গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠাতেন।

শুধু তাই নয় একটি বহুজাতিক কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে পাকিস্তানের শীর্ষ পদস্থদের সঙ্গেও তার খাতির ছিল। বিভিন্ন সামরিক অভিযানের গোপন তথ্যও পেতেন তিনি।

মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতায় সক্রিয় হয়ে যুদ্ধের সময় স্ত্রী মারিয়াকে অস্ট্রিয়া পাঠিয়ে দেন। এমনকি বাসা পরিবর্তন করে সুবিধাজনক স্থানে বাসা ভাড়া নেন। পানির ট্যাঙ্ক খালি করে এতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ করেন। ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় গেরিলা অপারেশনে নিজেই অংশ নিতে শুরু করেন।

যোদ্ধাদের মনোবল গঠনের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, নগদ অর্থ, ওষুধ, জুতা ইত্যাদি সরবরাহ করে এদেশের মানুষের মহান অর্জনের অন্যতম অংশ হয়ে ওঠেন।

স্বাধীনতা অর্জনের পর মহান মুক্তিযুদ্ধের এ বিরল অবদানের জন্য ওডারল্যান্ডকে 'বীর প্রতীক' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এসময় তাকে সনদপত্র ও সম্মাননা স্বরূপ ১০ হাজার টাকার চেক দেয়া হয়। সম্মানির টাকাগুলো তিনি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ তহবিলে দান করেন।

১৯৭৮ সালে বাটা কোম্পানি থেকে এ তাকে অস্ট্রেলিয়ায় বদলি করা হলে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। ২০০১ সালের ১৮ মে পার্থের একটি হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় শেষ নিঃশাষ ত্যাগ করেন। এ মুক্তিযোদ্ধাকে বীর প্রতীকের মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়। তার সঙ্গে স্ত্রী মারিয়া, মেয়ে এনি হ্যামিলটন, নাতী গ্রেগ হ্যামিলটন ও নাতনী মিশেল হ্যামিলটন পার্থের স্কারবোরোতে বাস করতেন।

২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গুলশান-২-এর ৮৪ নম্বর সড়টির নামকরণ করা হয় অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক বীর প্রতীক ডাব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড সড়ক।

জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছেন। এমনকি তিনি 'বীর প্রতীক' উপাধিটি নামের সঙ্গে সবসময় ব্যবহার করতেন।

ওয়াই/জেএইচ

মন্তব্য করুন

daraz
  • বাংলাদেশ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh