• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

পাট নেবে নতুন মোড়

মিথুন চৌধুরী

  ১০ মার্চ ২০১৭, ২৩:৫০

ফের বিশ্ব জয় করবে পাট। কাড়বে বিশ্ববাসীর মন। চালু হবে থেমে যাওয়া পাটকল। দেশ হবে আরো সবল। এমন ভাবনা নিয়ে করা হলো প্রথম পাট দিবস পালন। চলছে পাট মেলাও। ঢাকা শহরকে পাটের শহরেও রূপ দেয়া হয় কয়েকদিন ধরে। পাট থেকে সেনেটারি ন্যাপকিন, ঢেউটিন-সবকিছু আবিষ্কার হয়েছে এ দেশে। তৈরি হচ্ছে ডেনিম কাপড়ও, যা দিয়ে তৈরি করা যাবে প্যান্ট।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাটজাত পণ্য গবেষণার ফলে নিত্যদিন নানা চমক আসছে।

দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট খাতের ওপর নির্ভরশীল। মোট রপ্তানি আয়ের ৩ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। এসব বিবেচনায় নিয়ে এ খাতকে চাঙ্গা করতে সরকার বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে।

বিশ্বব্যাপী ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ। বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমকে পাশে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ঘোষণায় তাক লেগে যায় বিশ্বজুড়ে। রহস্য উন্মোচনের ফলে পাটকে এক ফসলি থেকে তিন ফসলিতে রূপান্তরের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

গেলো ৫ বছরে দেশে ১০৮টি নতুন পাটকল চালু হয়। ফলে বর্তমানে দেশে পাটকল সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৬টি। তবে এর মধ্যে ২২টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের আওতায় দেশে পাট থেকে সুতা তৈরির জন্য ৯৬টি কারখানা রয়েছে।

এরই মধ্যে ১৯৬২ সালের জুট অর্ডিন্যান্স আইন বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। গেলো ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে আইনটি পাস হয়। যাতে পাট আইন ভঙ্গে তিন বছর কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

এছাড়া ২৪ জানুয়ারি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে সংরক্ষণ ও পরিবহনে পাটজাত মোড়কে ১১ পণ্যে বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। যাতে বলা হয়েছে ২০ কেজির বেশি পণ্যের ওজন হলে মানতে হবে এ নিয়ম। পণ্যগুলো হচ্ছে পেঁয়াজ, ডাল, আলু, আটা, ময়দা, মরিচ, হলুদ, ধনিয়া, আদা, রসুন, এবং তুষ-খুদ-কুড়া।

এর আগে ২০১৫ সালে ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি’তে পাটজাত মোড়ক বাধ্যতামূলক করা হয়। আইন না মানলে এক বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে শাস্তি সর্বোচ্চ দণ্ডের দ্বিগুণের কথা বলা হয়।

পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট পাটকে ব্যবহার উপযোগী ও সময়োপযোগী করে বিভিন্ন জিনিস উদ্ভাবন করছে। যা পাটকে করেছে সমৃদ্ধ।

গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, পাট সুতাকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন করে উল প্রস্তুত করা হয়েছে। তুলা, পশম এবং কৃত্রিম আঁশের মিশ্রণে পাট আঁশ ব্যবহার করে নভোটেক্স কাপড় তৈরি করা হয়েছে। মাইক্রোক্রিস্টালাইন সেলুলোজ উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা ঔষধ শিল্পে ব্যবহার হচ্ছে। পাট এবং পাট আঁশের সঙ্গে নভোটেক্স কম্বল প্রস্তুত করা হয়েছে। পাট থেকে তৈরি করা হচ্ছে সেনিটারি ন্যাপকিন। উদ্ভাবন হয়েছে জুট ফেল্ট, যা থার্মাল ইনসুলেটিং, শব্দ শোষণ, বৈদ্যুতিক ইনসুলেটিং, ওয়াল কভারিং হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। মনোক্লোরো এসেটিক এসিড তৈরি হচ্ছে পাট দিয়ে। চিকন সূতা তৈরি করা হয়েছে, যা দিয়ে হালকা পাটবস্ত্র তৈরি করা যায়। পাটের সঙ্গে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে জিওটেক্সটাইল প্রস্তুত করা হয়েছে, যা দিয়ে বাঁধ সংরক্ষণ, মাটির ক্ষয়রোধ, সেচ খাল রক্ষা করা সম্ভব। পাট বস্ত্র দাহ্য পদার্থ হলে রাসায়নিক ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে তা এখন অগ্নিরোধী করা হয়েছে।

আরো জানা যায়, পচনরোধী পাটজাত দ্রব্য স্থায়িত্বকাল ৩ মাস থেকে রাসায়নিক ট্রিটমেন্ট এর মাধ্যমে ৫-৬ বছর পর্যন্ত করা হয়েছে। পাটজাত দ্রব্যকে স্থায়ীভাবে রং করার পদ্ধতি উদ্ভাবন হয়েছে। ভাঁজ পড়ে না, সংকুচিত হয় না এবং কম জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন পাট বস্ত্র উদ্ভাবন হয়েছে। পলিথিন ব্যাগের বিকল্প পাটের ব্যাগ তৈরি পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা দিয়ে স্বল্প দামে তা ব্যবহার করা যাবে। বাড়ানো হয়েছে পলি ব্যাগের বদলে পাট ব্যাগ, যা ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। বন বিভাগে ব্যবহারও করছে এ ব্যাগ। পাট থেকে জুট ডেনিম তৈরি করা হয়েছে, যা প্যান্ট তৈরিতে ব্যবহৃত হবে। যা টেকসই এবং সস্তা। কাপড়ে ব্যবহৃত ইন্টারলাইনিং তৈরি করা হয়েছে পাট দিয়ে। তৈরি করা হয়েছে পরিবেশবান্ধব পাটের ঢেউটিন। যা বজ্রপাত প্রতিরোধক, সূর্যের তাপ নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং শিলাবৃষ্টি বা ৫ কেজি ওজনের ভারের আঘাত প্রতিরোধে সক্ষম। পাট পাতার চা পাতা এনে দিয়েছে নতুন চমক।

পাটজাত পণ্যের মধ্যে বাজারে দেশ-বিদেশে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে শো পিস, শপিং ব্যাগ, হ্যান্ড ব্যাগ, পর্দা, টেবিল ম্যাট, ফ্লোর ম্যাট, মেয়েদের গহনা, সেন্ডেল, শিকা, সোফার কভার, শপিং ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, জায়নামাজ, বাসাবাড়ির আসবাব সামগ্রী, বাগানে ব্যবহৃত শৌখিন সামগ্রী থেকে শুরু করে শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, স্যুট, শার্ট, প্যান্ট এমনকি জিন্স বা ডেনিম। এসব রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৩০টির বেশি দেশে। এছাড়া পাট বিশ্বের নামীদামি গাড়ির ভেতরের বাক্স, বডি ও অন্যান্য উপাদান তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার যোগান যায় বাংলাদেশ থেকে।

বাংলাদেশের পাটের তৈরি আধুনিক বিলাস সামগ্রী এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ব্রিটিশ রাজপুত্র প্রিন্স চার্লসের বাসায়। স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের রানি ব্যবহার করেছেন পাটের তৈরি বাহারি ব্যাগ। ২০১১ সালে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ১৫ হাজার অংশগ্রহণকারীর হাতে যে আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাটের ব্যাগ তুলে দেয়া হয়, তা বাংলাদেশি পণ্য। বিশ্বের বেশিরভাগ পরিবেশ বিষয়ক সম্মেলনে পাটের ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে, যার যোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পাটের শাড়ি, জুতা ও ব্যাগ ব্যবহার করেছেন।

পাট অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮৫ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৭৫ লাখ টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৭৫ লাখ টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এর উৎপাদন কমে প্রায় ৬৮ লাখ টনে দাঁড়ায়। ২০১১-১২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৭৮ লাখ ৫ হাজার টন পাট উৎপাদন হয়।

২০১৫-২০১৬ সালে রপ্তানি হয়েছে ৭০০ কোটি টাকার পাট পণ্য। যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে হয় ৮১৭ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় কমে ৭০৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকার।

বর্তমানে বিশ্বে প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি পিস শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। যা ২০২০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হবে।

পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম জানান, দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী সোনালি আঁশ পাটের সম্ভাবনাগুলো বিকশিত করতে চায় সরকার। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে। ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় পাটের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে। এতে চাষিরা পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। বর্তমানে পাট থেকে হাজার রকমের বহুমুখী পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে পাট থেকে পলিথিন উৎপাদন হচ্ছে। এ পলিথিন শুধু বাংলাদেশে নয়, চাহিদা সৃষ্টি হবে সারাবিশ্বে। সারাবিশ্বের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আগামীতে ৫ কোটি বেল পাট উৎপাদন হবে বলে আশা করছি।

এমসি/ডিএইচ

মন্তব্য করুন

daraz
  • বাংলাদেশ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh