• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo
আলেশার ২০২০ শতাংশ জমির হদিস, আড়ালে আরও কয়েক গুণ
বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদারের দুই হাজার ২০ শতাংশ জমির হদিস পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। জমিগুলো কেনা হয়েছে গাজীপুরে। স্থানীয় বাসিন্দা, আলেশার নিয়োগ করা তত্ত্বাবধায়ক ও জমি কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা অবশ্য বলছেন, যে পরিমাণ জমির হদিস সিআইডি এখন পর্যন্ত পেয়েছে তা কিছুই না, আলেশার কেনা জমির পরিমাণ আরও কয়েক গুণ বেশি। শুধু তাই নয়, জমিগুলোর প্রকৃত দাম ও দলিলে উল্লেখিত দামের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য বিদ্যমান।  সিআইডি যে পরিমাণ জমির হদিস পেয়েছে, তার দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা। কিন্তু আসলে এই পরিমাণ জমির বাজারমূল্য অন্তত ১৫০ কোটি টাকা বলে ধারণা তদন্ত কর্মকর্তাদের। যেমন এক জায়গায় প্রতি শতাংশ জমির দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা। অথচ, স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সেখানে জমির বাজারমূল্য প্রতি শতাংশ সর্বনিম্ন দুই লাখ টাকা।  গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের মাধ্যমেই মঞ্জুর আলম শিকদার এত বিশাল সম্পত্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে ধারণা। কারণ, ২০২১ সালের দিকে যখন আলেশা মার্ট গ্রাহককে বড় ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রির নামে টাকা ওঠাচ্ছিল, তখনই জমিগুলো কেনা হয়। ওই সময় আলেশা মার্ট ছাড়াও বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে।   প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদার এখন কারাগারে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মঞ্জুর আলমের বিরুদ্ধে করা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের একটি মামলার তদন্ত করছে। এ তদন্তেই আলেশার বিপুল পরিমাণ জমি কেনার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আদালতের নির্দেশে ইতোমধ্যে মঞ্জুর আলমের দুই হাজার ২০ শতাংশ (২০ একর) জমি জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মনিরুজ্জামান। মঞ্জুর আলম জমিগুলো কিনেছেন আলেশা হোল্ডিংস লিমিটেডের নামে। বেশি জমি কেনা হয়েছে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের ঠাকুরপাড়া এলাকায়।  ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুরের মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে ঠাকুরপাড়া সাহেবেরচালা বাজার। শুক্রবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একটি রাস্তার মুখে বড় একটি সাইনবোর্ডে লেখা আলেশা হোল্ডিংস লিমিটেড। সেই রাস্তা ধরে এক কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে পাওয়া যায় আলেশার নামে কেনা জমি। জমিগুলো দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন আলেশার নিয়োগ করা তত্ত্বাবধায়ক নুরুল আলম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা দুজন সেখানে কাজ করেন। তবে চার-পাঁচ মাস ধরে মালিকপক্ষ তাদের কোনো খোঁজ নেয় না। বেতনও পান না। জমিতে শাকসবজি চাষ করে সেগুলো বিক্রি করে চলেন তারা।  সিআইডি দুই হাজার শতাংশের মতো জমির খোঁজ পেলেও তত্ত্বাবধায়ক নুরুল আলম বলছেন, সব মিলিয়ে সেখানে আলেশা হোল্ডিংসের নামে জমি রয়েছে ১৩ হাজার ২০০ শতাংশ। এর বাইরে আশপাশে আরও জমি আছে। তিনি শুনেছেন কিছু জমি বিক্রিও করা হয়েছে।  কালিয়াকৈর উপজেলার মাঝুখান এলাকায় দুটি জায়গায় আলেশা হোল্ডিংসের দুটি সাইনবোর্ড দেখা যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সেখানে আলেশার জমি রয়েছে প্রায় ২০০ বিঘা। জমিগুলো নিচু, জলাভূমি। স্থানীয় কিছু যুবক ইজারা নিয়ে তাতে মাছ চাষ করেন।  আলেশাকে জমি কিনে দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কালিয়াকৈর উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, তারা তিন থেকে চারজন আলেশার জমি কেনার মধ্যস্থতা করেছেন। তিনি নিজে কিনে দিয়েছেন ২০০ বিঘা জমি। সব জমি ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কেনা হয়েছে।  স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২০২১ সালে একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ জমি কেনা শুরু করে আলেশা। সে সময় তারা বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দাম প্রস্তাব করেছিল। কারখানা করার কথাও বলেছিল। যার ফলে জমি বিক্রিতে উৎসাহিত হয়েছিল মানুষ। আর যার বিক্রি করেননি, তাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছে আলেশার দালালরা।  এমনই একজন ভুক্তভোগী ঠাকুরপাড়ার নাহিদ স্টোরের মালিক শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আলেশা আমাদের বাড়ির পাশের জমিগুলো ২০২২ সালে কেনে। আমাদের জমি কিনতেও বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমরা বিক্রি করিনি। তারা আমাদের বাড়ির চলাচলের রাস্তাও বন্ধ করে দিয়েছে।’ আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম ছিলেন একজন স্বল্পপরিচিত ব্যবসায়ী। তবে আলেশা মার্ট খুলে এবং ব্যাপক প্রচার চালিয়ে পরিচিতি পান তিনি। তার আইনজীবীর দাবি, আলেশা হোল্ডিংস নামের একটি প্রতিষ্ঠান ছিল মঞ্জুর আলমের মূল ব্যবসা। সেখান থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্ট খোলেন তিনি।  আলেশা মার্ট খোলার আগে মঞ্জুরের আয় কেমন ছিল, নিজেদের প্রতিবেদনে তা তুলে ধরেছে সিআইডি। বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের আয়কর বিবরণীতে মঞ্জুর আলম বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন মাত্র ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা।  মানি লন্ডারিং মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আলেশা মার্ট ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসা শুরু করে। মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্য বড় ছাড়ে দেওয়ার কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিত প্রতিষ্ঠানটি। এভাবে বিপুল টাকা সংগ্রহ করেছিল তারা। ২০২১ সালের দ্বিতীয় ভাগে কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহককে পণ্য অথবা টাকা ফেরত দেওয়া বন্ধ করে দিতে থাকে। আর গ্রাহকেরা টাকা না পেয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ এবং মামলা করা শুরু করেন। এর মধ্যে আলেশা মার্টও ছিল। সিআইডি ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা গ্রাহকের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি।  মঞ্জুর আলম টাকা নিয়ে কী করেছেন, তা অনুসন্ধান করে সিআইডি জানতে পেরেছে, আলেশার চারটি ব্যাংক হিসাব থেকে ৪২১ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যেটা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ। গ্রাহকের টাকায় জমি ছাড়াও বিভিন্ন নামে ১০টি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানও খোলে আলেশা মার্ট।  সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, জমির পাশাপাশি মঞ্জুর আলমের নিজের নামে, স্ত্রীর নামে এবং স্বজনদের নামে একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি পাওয়া গেছে। ব্যাংকের পরিচালক হতে আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সহসভাপতি আবুল কাশেমকে প্রায় ১০০ কোটি টাকাও দিয়েছেন তিনি।  পুলিশ ও আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মঞ্জুর আলমের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের করা শতাধিক প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ১৩ জানুয়ারি তাকে ঢাকার বনানী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখন তিনি কারাগারে রয়েছেন। এদিকে গত বৃহস্পতিবার চেক প্রতারণার মামলায় মঞ্জুর আলম ও তার স্ত্রী সাবিয়া চৌধুরীকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন ঢাকার দ্বিতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালত।  মঞ্জুর আলমের আইনজীবী অলিউর রহমান বলেন, তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। মঞ্জুর আলমের বিরুদ্ধে আরও কিছু মামলার বিচার চলছে। 
২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১৫:৫০
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়