• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo
ফিতরা প্রদানের গুরুত্ব ও ফজিলত
জাকাতের মতো একটি আর্থিক ইবাদত হলো ফিতরা বা সদকাতুল ফিতর। ‘সদকাতুল ফিতর’ দুটি আরবি শব্দ। সদকা মানে দান, আর ফিতর মানে রোজার সমাপন বা ঈদুল ফিতর। অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করা সদকাকেই সদকাতুল ফিতর বলা হয়। ফিতরা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে না থাকলেও এটির গুরুত্বও অনেক। জাকাত অর্জিত সম্পদের পবিত্রতা রক্ষার জন্য দেওয়া হয় আর ফিতরা রমজান মাসে রোজাদরদের ভুল-ত্রুটির কাফ্ফারা ও সাদাকাহ সাদাকাহ হিসেবে দেওয়া হয়। সদকাতুল ফিতর মুমিনজীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রমজানের সিয়াম সাধনা শেষে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতরের আগেই সাদকায়ে ফিতর দেওয়া জরুরি। ঈদের আনন্দ ধনী-গরিব সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং এ আনন্দে যেন মুসলিম জাতির প্রতিটি সদস্য শরিক হতে পারে এ জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে সদকাতুল ফিতর। রোজা একটি দৈহিক ইবাদত হলেও তার পূর্ণতা সাধিত হয় সদাকাতুল ফিতর আদায়ের মাধ্যমে। সাদকায়ে ফিতর আদায় করা মুমিনের জন্য আল্লাহ কর্তৃক অত্যাবশ্যকীয় বিধান। হজরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন অনর্থক ও অশ্লীল কথা-বার্তা দ্বারা সিয়ামের যে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে তা থেকে পবিত্র করা এবং মিসকীনদের খাদ্য প্রদানের জন্য। ঈদের নামাজের পূর্বে আদায় করলে তা যাকাতুল ফিতর হিসেবে গণ্য হবে। আর ঈদের নামাজের পর আদায় করলে তা অন্যান্য সাধারণ দানের মতো একটি দান হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৬০৯; ইবন মাজাহ, হাদিস : ১৮২৭; মুস্তাদরাকে হাকেম; ১/৪০) সাদকায়ে ফিতর সাদকায়ে ফিতর হলো- রোজা খোলার সাদকা বা দান। সাদকায়ে ফিতর এমন দানকে বলা হয়, যা পুরো রমজান মাস রোজা রাখার পর ঈদের দিন সব সামর্থ্যবানদের জন্য আদায় করা আবশ্যক। এ বিশেষ দান দিয়েই গরিব-অসহায় মানুষ ঈদের আনন্দে মেতে ওঠবে। ফিতরার নিসাব যার মালিকানায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও ঋণ ছাড়া সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা কিংবা এর সমমূল্য কোন সম্পদ বা টাকা থাকে, তাহলে তার ওপর সদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব। সদকাতুল ফিতর উত্তম হলো ঈদের নামাজের আগে আদায় করে দেয়া। কেননা রাসুল (সা.) ঈদগাহে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত এমন অভাবী লোকদের সদকাতুল ফিতর দিতে হবে। একজন দরিদ্র মানুষকে একাধিক ফিতর দেওয়া যেমন জায়েজ, তেমনি একটি ফিতরা বণ্টন করে একাধিক মানুষকে দেয়াও জায়েজ। ফিতরা আদায়ের ফজিলত হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদের স্বাধীন ও ক্রীতদাস পুরুষ ও নারী এবং ছোট ও বড় সবার জন্য এক সা’ (প্রায় সাড়ে ৩ কেজি) খেজুর বা যব খাদ্য (আদায়) ফরজ করেছেন। (বুখারি, মুসলিম) সাকদায়ে ফিতর দ্বারা কুরআনুল কারিমে পরিশুদ্ধ হওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন- নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে পরিশুদ্ধ হয়। (সুরা আলা : আয়াত ১৪) মুফাসসিরিনের কেরামের মতে, এ পরিশুদ্ধ দ্বারা সাদকায়ে ফিতরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ যারা সাদকায়ে ফিতর আদায় করবেন তারাই লাভ করবেন সফলতা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদাক্বাতুল ফিতরকে অপরিহার্য করেছেন, অনর্থক অশালীন কথা ও কাজে রোজার যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণের জন্য এবং নিঃস্ব লোকের আহার যোগানোর জন্য। (আবু দাউদ) হজরত জারির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রামজানের রোজা সাদকাতুল ফিতর আদায় করার পূর্ব পর্যন্ত আসমান-জমিনের মাঝে ঝুলন্ত থাকে। (তারগিব ওয়াত তারহিব)
২৪ মার্চ ২০২৪, ১৫:১৪

রমজানে মেসওয়াকের গুরুত্ব ও ফজিলত
মেসওয়াক হলো মুসলমানদের দাঁত মাজার উপকরণ যা একটি গাছের ডাল, কাঠ বা শিকড়ও হতে পারে। এটি মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সুন্নাহ পদ্ধতি। একে অনেক ঐতিহাসিকেরা ব্রাশের প্রাথমিক রূপ মনে করেন। কারণ, রাসুল (সা.)-এর যুগে এটিই ছিল দাঁত মাজার একমাত্র মাধ্যম। ইসলামে মেসওয়াক একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। অযু ও গোসলের পূর্বে মেসওয়াক করা সুন্নত। অন্যান্য সময় মোস্তাহাব। এছাড়া যেকোন ভালো কাজের পূর্বে নবীজি মেসওয়াক করতেন।   রাসুলু (সা.) বলেন, ‘এমনটি কখনও হয়নি, জিবরাইল (আ.) আমার কাছে এসেছেন আর আমাকে মেসওয়াকের আদেশ করেননি। এতে আমার আশঙ্কা হচ্ছিল যে, (বেশি ব্যবহারের ফলে) আমার মুখের অগ্রভাগ ক্ষয় না করে ফেলি।’ (মুসনাদে আহমদ: ২২২৬৯)  হজরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মেসওয়াক মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যম ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায়।’ (নাসায়ি: ৫) অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলু (সা.) বলেছেন, ‘যদি আমি আমার উম্মতের ওপর কষ্ট হওয়ার আশঙ্কা না করতাম, তাহলে তাদের প্রত্যেক নামাজের সময় মেসওয়াক করার আদেশ দিতাম।’ (বুখারি: ৮৮৭) রোজার দিনের যেকোনো সময় মেসওয়াক করা যাবে। হাসান (রহ) বলেন, ‘রোজা অবস্থায় দিনের শেষে মেসওয়াক করতে কোনো অসুবিধা নেই। মেসওয়াক পবিত্রতার মাধ্যম। অতএব দিনের শুরুতে এবং শেষেও মেসওয়াক করো’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজজাক: ৪/২০২) আল্লামা ইবনে আবেদীন শামি (রহ.) উল্লেখ করেছেন, ‘মেসওয়াকের উপকারিতা সত্তরেরও অধিক। তন্মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র উপকার হচ্ছে মুখের দুর্গন্ধ দূর হয় আর সর্বোচ্চ উপকার হচ্ছে মেসওয়াক করলে মৃত্যুর সময় কালিমা নসিব হয়।’ (ফতোয়ায়ে শামি: ১/২৩৯) মেসওয়াকের রয়েছে অনন্য উপকারী উপাদান। যেমন- ট্রাইমিথাইল অ্যামিন, সালভাডোরাইন, অ্যালকালয়েড, ফ্লোরাইড, সিলিকা, সালফার, ভিটামিন সি, ফ্লেভোনয়েডস এবং স্টেরলস পদার্থ। তাছাড়া প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস রয়েছে মিসওয়াকে। যা শরীরের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। মিসওয়াকের আশগুলো খুব নরম এবং মসৃণ হওয়ায় দাঁতের জন্য তা বেশ আরামদায়কও। নিয়মিত মিসওয়াক করলে মুখের ভেতর সৃষ্ট হওয়া ক্ষত বা ঘা দূর দূর হয়। এর আরেকটি উপকার হলো মুখের দুর্গন্ধ দূর করা। মেসওয়াক কেমন হবে রাসুল (সা.) জাইতুন ও খেজুর গাছের ডাল দিয়ে মেসওয়াক করেছেন। তাই এ দুটো হলে উত্তম। এছাড়া তিক্তস্বাদ যুক্ত গাছের ডাল দিয়েও মিসওয়াক করা যাবে। মেসওয়াক নিজ হাতের আঙুলের মতো মোটা ও এক বিঘত পরিমাণ লম্বা হওয়া উচিত। অজুতে হাত ধোয়ার পর কুলি করার পূর্বে মেসওয়াক করা উত্তম। মেসওয়াকের পদ্ধতি মিসওয়াক ধরার সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি হলো, ডান হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলি মেসওয়াকের নিচে থাকবে। মধ্যমা ও তর্জনী ওপরে ও বৃদ্ধাঙ্গুলি নিচে রেখে মেসওয়াক ধরা। মুখের ডান দিক থেকে শুরু করা এবং ওপর থেকে নিচে মেসওয়াক করা। আড়াআড়িভাবে না করা।  মেসওয়াকের ক্ষেত্রে যেসব জিনিস থেকে বিরত থাকা জরুরি আলেমদের পরামর্শ মেনে রোজার বিশেষ ফজিলত অর্জনে টুথপেস্ট, টুথ পাউডার ব্যবহার থেকে বিরত থাকা জরুরি। তবে রমজানে দিনের বেলা টুথপেস্ট বা মাজন ব্যবহার করতে না পারলেও দাঁত ও মুখের যত্ন নেওয়া আবশ্যক। কারণ, দুই দাঁতের মাঝখানে খাবার জমে থাকলে ডেন্টাল ক্যারিজ ও মাড়ির প্রদাহ হওয়ার সম্ভব থাকে। এজন্য রমজান মাসে ইফতার ও সেহরির পর মানসম্মত টুথপেস্ট ও ব্রাশ দিয়ে দাঁত ব্রাশ করার পরামর্শ দেন ডেন্টিসরা। 
১০ মার্চ ২০২৪, ১১:৩০

শাবান মাসের ফজিলত ও আমল
হিজরি বর্ষের অষ্টম মাস হলো শাবান। এর পরের মাসই পবিত্র রমজান মাস। তাই শাবান মাসেই রমজানের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। রমজানকে বরণ করে নিতে পবিত্র হাদিস শরিফে শাবানের বেশ কিছু ফজিলত ও আমল বর্ণিত হয়েছে। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, একদা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো- হে আল্লাহর রাসুল, কোন রোজার ফজিলত বেশি? উত্তরে তিনি বললেন, ‘রমজান মাসের সম্মানার্থে শাবান মাসের রোজার ফজিলত বেশি। আবার জিজ্ঞাসা করা হলো- কোন দানের ফজিলত বেশি? উত্তরে তিনি বললেন, রমজান মাসের দানের ফজিলত বেশি।’ (বায়হাকি: ৮৭৮০) হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বছরের অন্য কোনো মাসে শাবান মাসের চেয়ে বেশি রোজা রাখতে দেখিনি। শাবান মাসে তিনি প্রায় সারা মাসই রোজা রাখতেন। খুব সামান্য কয়েক দিন বাদ যেত।’ (সুনানে তিরমিযি: ৭৩৬) হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) হতে বর্ণিত এক হাদিসে নবি করিম সা. বলেন, রজব হলো আল্লাহর মাস। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর মাস রজবকে সম্মান করল, সে আল্লাহর বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। আর যে আল্লাহর বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুন নাঈমে প্রবেশ করাবেন। আর শাবান হলো আমার মাস। আর যে ব্যক্তি শাবান মাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল সে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। আর যে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, কিয়ামতের দিন আমি হব তার অগ্রবর্তী এবং সওয়াবের ভাণ্ডার। আর রমজান মাস হলো আমার উম্মতের মাস।  হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ১৫ শাবানের রাত (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে, সে রাতে তোমরা তা ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং পরদিন রোজা রাখ। (ইবনে মাজাহ) শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত ১৫ তারিখের রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। ফারসি পরিভাষায় শব অর্থ রাত, বারাআত মানে মুক্তি; শবে বরাত অর্থ মুক্তির রাত। ‘শবে বরাত’ এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’ তথা মুক্তির রজনী। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে। এ রাতে ইবাদত করা এবং পরদিন রোজা রাখা সুন্নত। শাবান মাস ইবাদতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। নফল রোজা, নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরিফ, জিকির–আজকার, তাসবিহ–তাহলিল, দোয়া, দান–সদকাহ, ওমরাহ হজ ইত্যাদির মাধ্যমে এই মাসকে সার্থক ও সাফল্যময় করা যায়। শাবান মাসে নবি করিম (সা.) বেশি বেশি করে এই বরকতময় দোয়া পাঠ করতেন। ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’  অর্থ : হে আল্লাহ, আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসে বিশেষ বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান মাস পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন। (মুসনাদে আহমদ ও শুআবুল ঈমান)
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:০৯

শবেবরাতের ফজিলত ও আমল
শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘লাইলাতুন মিন নিসফি শাবান’ বলা হয়। মুসলিম উম্মাহর কাছে এ রাত শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত হিসেবে পরিচিত।  শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। শব মানে রাত, বরাত মানে মুক্তি; শবে বরাত অর্থ মুক্তির যামিনী। ‘শবে বরাত’-এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারকাত’। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানান ভাষায় যা ‘শবে বরাত’ নামেই অধিক পরিচিত। ইসলামি তমদ্দুন তথা মুসলিম কৃষ্টিতে যেসব দিবস ও রজনী বিখ্যাত, এর মধ্যে পাঁচটি রাত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বিশেষ পাঁচটি রাত হলো: দুই ঈদের রাত্রিদ্বয়, শবে মেরাজ, শবে বরাত ও শবে কদর। যারা রাতের ইবাদতের গুরুত্ব অনুধাবন করেন, তারা প্রতিটি রাতকে শবে বরাত বানিয়ে নেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন ও সব জানেন। তিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এই উভয়ের মাঝে যা আছে সেসবের রব। যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করো, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন, তিনিই তোমাদের পরওয়ারদিগার আর তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও। তবু তারা সংশয়ে রঙ্গ করে। তবে অপেক্ষা করো সেদিনের, যেদিন আকাশ সুস্পষ্টভাবে ধূম্রাচ্ছন্ন হবে। (সুরা-৪৪ [৬৪] দুখান, রুকু: ১, আয়াত: ১-১০, পারা: ২৫, পৃষ্ঠা ৪৯৬-৪৯৭/১৪-১৫)। মুফাসসিরিনগণ বলেন, এখানে ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)। হজরত ইকরিমা (রা.) প্রমুখ কয়েকজন তফসিরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সুরা দুখানের দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত্রি বলে শবে বরাত বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)। শবে বরাতের ফজিলত হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন; আমি তখন উঠে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়িশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না? নবীজি (সা.) বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন। তখন নবীজি (সা.) বললেন, এটা হলো অর্ধশাবানের রাত; এ রাতে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২)। হজরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুণাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ৭৩৯)। শবে বরাতের নফল নামাজ ও ইবাদত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)। ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নামাজ; সুতরাং নফল ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নফল নামাজ। প্রতিটি নফল ইবাদতের জন্য তাজা অজু বা নতুন অজু করা মোস্তাহাব। বিশেষ ইবাদতের জন্য গোসল করাও মোস্তাহাব। ইবাদতের জন্য দিন অপেক্ষা রাত শ্রেয়তর। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো; কেননা, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন; কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিকপ্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৮৪)। মধ্য শাবানের নফল রোজা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করো ও দিনে রোজা পালন করো। (সুনানে ইবনে মাজাহ)। এ ছাড়া প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিজ-এর নফল রোজা তো রয়েছেই। যা আদি পিতা হজরত আদম (আ.) পালন করেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় নবী (সা.)–ও পালন করতেন; যা মূলত সুন্নত। সুতরাং তিনটি রোজা রাখলেও শবে বরাতের রোজা এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ হাফিজ ইবনে রজব (রা.) বলেন, এদিনের রোজা আইয়ামে বিজ, অর্থাৎ চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজার অন্তর্ভুক্ত। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ১৫১)। এ ছাড়া মাসের প্রথম তারিখ, মধ্য তারিখ ও শেষ তারিখ নফল রোজা গুরুত্বপূর্ণ; শবে কদরের রোজা এর আওতায়ও পড়ে। সওমে দাউদি বা হজরত দাউদ (আ.)-এর পদ্ধতিতে এক দিন পর এক দিন রোজা পালন করলেও সর্বোপরি প্রতিটি বিজোড় তারিখ রোজা হয়; এবং শবে কদরের রোজা এর শামিল হয়ে যায়। সর্বোপরি রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসের পর রজব ও শাবান মাসে বেশি নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন করতেন; শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি নফল রোজা, কখনো আরও বেশি রাখতেন। এমনকি উম্মুহাতুল মোমেনিন বা মোমিন মাতাগণ বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এভাবে নফল রোজা রাখা শুরু করতেন মনে হতো তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না। (মুসলিম)। শবে বরাতে করণীয় ও বর্জনীয় যা যা করা উচিত: (ক) নফল নামাজ [১] তাহিয়্যাতুল অজু, [২] দুখুলিল মাসজিদ, [৩] আউওয়াবিন, [৪] তাহাজ্জুদ, [৫] ছলাতুত তাসবিহ [৬] তাওবার নামাজ, [৭] ছলাতুল হাজাত, [৮] ছলাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া। (খ) নামাজে কিরাআত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা। (গ) পরের দিন নফল রোজা রাখা; (ঘ) কোরআন শরিফ [১] সুরা দুখান ও [২] অন্যান্য ফজিলতের সুরাসমূহ তিলাওয়াত করা; (ঙ) দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া; (চ) তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা; (ছ) দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির-আসকার ইত্যাদি করা; (জ) কবর জিয়ারত করা; (ঝ) নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সকল মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা। যা যা করা উচিত নয়: (১) আতশবাজি, পটকা ফোটানো, (২) ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে বেহুদা ঘোরাফেরা করা, (৩) অনাকাঙ্ক্ষিত আনন্দ-উল্লাস করা, (৪) অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা, (৫) অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো, (৭) হালুয়া-রুটি বা খাওয়াদাওয়ার পেছনে বেশি সময় নষ্ট করে ইবাদত থেকে গাফিল থাকা।
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:৪২

শবেমেরাজের গুরুত্ব ও ফজিলত
শবেমেরাজ শব্দটির বাংলা অর্থ ঊর্ধ্ব গমনের রাত। আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত সফরকে ‘ইসরা’ এবং মসজিদুল আকসা থেকে সাত আসমান পেরিয়ে আরশে আজিম সফরকে ‘মিরাজ’ বলা হয়। নবুওয়াতের দশম বছর ৬২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ রজব দিবাগত রাতে আল্লাহর সান্নিধ্যে মিরাজ গমন করেন মহানবি (সা.)। পবিত্র কোরআনের সুরা বনি ইসরাইল ও সুরা নজমের আয়াতে, তাফসিরে এবং সব হাদিস গ্রন্থে মিরাজের ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। শবেমেরাজের গুরুত্ব ও ফজিলত শবেমেরাজে ঊর্ধ্বাকাশে ভ্রমণ করে মহানবি হজরত মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহ তা’য়ালার সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। তাই রাতটি মুসলিমদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।  তবে এ উপলক্ষে বিশেষ কোনো আমলের কথা ইসলামি শরীয়তে উল্লেখ করা হয়নি। তারপরও এ রাতে ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশেষ ইবাদতে লিপ্ত থাকতে পছন্দ করেন। বিশেষত এ রাতকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মসজিদে কিংবা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে ওয়াজ এবং দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। সারারাত তাসবিহ-তাহলিল পাঠ করেন অনেকে। বিশেষ গুরুত্ব থাকায় আজ রাতে মহান রাব্বুল আলামিনের রহমত কামনায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মসজিদে বা নিজগৃহে সালাত আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আসকারের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করবেন। অনেকে নফল রোজাও পালন করবেন। রজব মাস আমলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। মহানবি (সা.) এ মাস থেকে রমজানের প্রস্তুতি শুরু করতেন। এ বিষয়ে উম্মে সালমা (রা.) বলেন, নবি করিম (সা.) রমজান মাস ছাড়া সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন শাবান মাসে, অতঃপর রজব মাসে।  এ প্রসঙ্গে আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ‘যখন রজব মাস আসত, তা আমরা নবিজির (স.) আমলের আধিক্য দেখে বুঝতে পারতাম।’  ৬২০ খ্রিস্টাব্দ হজরত মুহাম্মদের (সা.)-এর জন্য দুঃখ ও শোকের বছর ছিল। এ সময় তিনি তার কঠিন সময়ের দুজন প্রিয় ব্যক্তি স্ত্রী খাদিজা (রা.) এবং চাচা আবু তালেবকে হারিয়েছেন। তা ছাড়া ইসলামের দাওয়াত নিয়ে তায়েফ গেলে সেখান থেকেও আশাহত হয়ে ফেরেন। এরপর মহান আল্লাহ ইসরা ও মেরাজের মাধ্যমে প্রিয় রাসুলকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেন। এই রাতে প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দিদার লাভ করেন এবং আল্লাহর কাছ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নিয়ে দুনিয়ায় ফিরে আসেন।
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৫১
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়