প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি / ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ নির্মাণ এখন সময়ের দাবি
ঢাকার আগারগাঁওয়ে সরকারি এক একর জমির উপর অবস্থিত বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান (বাইগাম)। বাংলাদেশ সরকারের তৈরি করে দেওয়া স্থাপনায় এবং সরকারি বরাদ্দকৃত টাকায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, বাইগাম এ বিগত কয়েকটি কার্যনির্বাহী কমিটির দূর্নীতি ও অনিয়মতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতায় প্রতিষ্ঠানটি আজ ধ্বংসের পথে। লাগামহীন দূর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি যখন বন্ধ হবার উপক্রম সেই মুহূর্তে আশার আলো হয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর এগিয়ে আসে এবং একজন প্রশাসক নিয়োগ দেবার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত টিকে আছে এবং দুর্নীতিমুক্ত করতে কাজ এখনো কাজ চলছে।
প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ফান্ডের অর্থ (লটারি ফান্ড ৪ কোটি ১০ লক্ষ এবং মেম্বার সাবক্রিপশন ফান্ড ৮৮ লক্ষ টাকা) বিগত কমিটিগুলো পূর্বেই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে তসরুপ করে খরচ করে ফেলেছে। এখন শুধুমাত্র কর্মচারিদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাগুলো জমা রয়েছে। কার্যনির্বাহী কমিটিগুলোর লাগামহীন দুর্নীতি (৭২ লক্ষ টাকা সাব-স্টেশন স্থাপন বাবদ, ৪৩ লক্ষ টাকায় পিকনিক বাবদ, ২৫ লক্ষ টাকা কার্যনির্বাহী কমিটির সিটিং ও মিটিং ভাতাবাবদ, ২২ লক্ষ টাকা এজিএম বাবদ, ৬৮ লক্ষ টাকা ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন বাবদ, ২২ লক্ষ টাকা প্যাথলজি বিভাগে মেশিন ক্রয় বাবদ এবং কোটি টাকার নিয়োগ বানিজ্য ও ২০২৫ সালের লটারি দূর্নীতি ৪৭ লক্ষ টাকা) এবং তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারনে গত দুই অর্থ বছর ধরে বাইগাম এর জন্য বরাদ্দকৃত সরকারী অর্থ এখন পর্যন্ত ছাড় দেয়নি। ফলশ্রুতিতে আমরা বাইগামের কর্মকর্তা কর্মচারিরা গত ১ (এক) বছর যাবৎ বেতন ভাতা পাচ্ছি না। ভবিষ্যতে আমাদের কি অবস্থা হবে সে বিষয়েও আমরা চিন্তিত।
বাইগাম আগারগাঁয়ে সরকারি ১(এক) একর জমির উপর সমাজসেবা অধিদফতর এর পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত ভবনে এবং সরকারি বরাদ্দকৃত টাকায় পরিচালিত হচ্ছে। বাইগামের প্রবীণ নিবাসকে (বৃদ্ধাশ্রম) সাধারণ মানুষসহ সরকারি নানা মহলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবীণ নিবাস হিসেবেই চিনে থাকেন। বর্তমানে আমরা মাত্র ৪০ জন প্রবীণকে প্রবীণ নিবাসে জায়গা দিতে পারছি। কিন্তু প্রতিদিনই প্রবীণ আসছে এখানে আশ্রয়ের আশায়, আশাহত হয়ে দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে তারা অজানার উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে, আমরা কিছুই করতে পারছি না।
বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বাড়ছে, বর্তমানে জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ প্রবীণ। গবেষণা বলছে ২০৪০-৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যায় ২২ শতাংশ প্রবীণ জনগোষ্ঠী থাকবে। আরও ভয়ংকর তথ্য হলো ইউনিসেফের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ঝুঁকিতে ২য় স্থানে রয়েছে। সে গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৯ সালে বাংলাদশ প্রবীণপ্রবন সমাজে পা দিতে যাচ্ছে এবং ২০২৯ সালে বাংলাদেশ প্রবীণ প্রধান দেশে পরিনত হবে। রাস্ট্রীয়ভাবে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বাইগামকে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রথম সারির প্রবীণ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বন্ধপ্রায় প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন রুপে সাঁজিয়ে এখানে ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।
এমতাবস্থায়, বাইগামে কর্মরত আমরা কর্মকর্তা-কর্মচারিরা গত ১ বছর ধরে বেতন না পেয়ে মানবেতরভাবে দিনপার করছি। আমরা বিশ্বাস করি, কার্যনির্বাহী প্রথা সিস্টেমটি বিলুপ্তি করে প্রতিষ্ঠানটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হলে এটি একসময় বাংলাদেশে প্রবীণকল্যাণে রাস্ট্রীয়ভাবে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। প্রবীণদের কল্যাণে তৈরি করা এই প্রতিষ্ঠানটিতে ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ তৈরির মাধ্যমে প্রবীণ কল্যাণে কার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান রুপান্তিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করার সময়ে এসেছে।
‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ নির্মাণ করতে আগারগাঁওয়ের বিভিন্ন সরকারি অফিসে এবং ঢাকায় ৫ হাজার খোলা চিঠি বিতরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়সহ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা আপনার দিকে পথ চেয়ে বসে আছি। আমরা চাই উন্নত বিশ্বের আদলে দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সেবায় ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ আপনি আমাদের উপহার হিসেবে তৈরি করে দিবেন এবং আমাদের চাকুরীসহ বেতন ভাতার নিশ্চায়তা প্রদান করবেন।
‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ নির্মানের মাধ্যমে প্রবীণসেবায় রোল মডেল হিসেবে যে সমস্ত কাজ প্রতিষ্ঠানটি শুরু করতে পারে এবং আমাদের চাওয়াসমূহ –
১. বাইগাম পরিচালিত প্রবীণ নিবাসে (বৃদ্ধাশ্রম) বর্তমানে মাত্র ৫০ জন প্রবীণ বসবাস করার সুযোগ পাচ্ছে, যা বর্তমান চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। প্রতিদিনই অসহায় প্রবীণ এখানে আসছে, আবাসনের অভাবে তাদের আমরা রাখতে পারছি না। অসহায় প্রবীণরা ব্যাগ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি থেকে অজানা ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে ফিরে যাচ্ছে। তাই এখানে ২০০ শয্যা বিশিষ্ট প্রবীণ নিবাস তৈরি করার আবেদন/অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রবীণ নিবাসে বসবাস করার বর্তমান নিয়ম হচ্ছে, যাদের বয়স ৬০ এবং যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ প্রবীণ কেবলমাত্র তারাই থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু যারা শারিরীক ও মানসিক ভাবে সুস্থ নয়, তাদেরও থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
২. ‘লং টার্ম কেয়ার সেন্টার’ তৈরি করা - উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও বাড়ছে ৮০ বছরের উর্ধ্বে বয়স্ক প্রবীণের সংখ্যা। এই বয়সে গেলে বেশিরভাগ মানুষই বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং তার পৃথিবী তৈরি হয় শুধুমাত্র একটি বিছানাকে কেন্দ্র করে। তাকে বিছানাতেই ফিজিওথেরাপি, খাওয়ানো, গোসল করানো ও টয়লেটিংয়ের ব্যবস্থা করাসহ অন্যান্য দৈনন্দিন কাজের দায়িত্ব যেটাকে বলা হয় কেয়ার গিভিংয়ের দায়িত্ব নেবার পাইলট প্রকল্প চালু করে উন্নত বিশ্বের মতো একটি মডেল চালু করার সময় এসেছে এবং এই মুহূর্তে এটি বাংলাদেশে খুবই প্রয়োজন।
৩. প্রবীণ হাসপাতালের মাধ্যমে প্রবীণদের জন্য আউটডোর চিকিৎসাসেবা এবং আগারগাঁয়ে নির্মিত সরকারি টারশিয়ার লেভেলের হাসপাতালগুলোর (পঙ্গু হাসপাতাল, নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল, কিডনি হাসপাতাল, মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল দেশের উন্নয়নের অবকাঠামোতে যথারীতি রয়েছে) সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে প্রবীণ নিবাসে বসবাসরত প্রবীণদের জন্য দ্রুত চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং এখানে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট প্রবীণ হাসপাতাল পরিচালনা করা।
৪. প্রবীণদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার, ইন্ড লাইফ (মৃত্যপথ যাত্রী) কেয়ার সেন্টার ও গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা।
৫. প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তা কেন্দ্র স্থাপন করা এবং প্রতিষ্ঠানটি থেকে সরকারি হটলাইন নম্বরের মাধ্যমে দেশের যেকোনো স্থানে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বিপদে পড়লে পিতা-মাতার ভরণপোষন আইন-২০১৩ এর প্রয়োগ করা এবং সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা।
৬. ঢাকায় বসবাসরত অসুস্থ প্রবীণদের বাসায় গিয়ে কেয়ার গিভিং হোম সার্ভিসের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৭. প্রবীণদের জন্য স্বল্পমূল্যে বিশেষায়িত ফিজিওথেরাপি সার্ভিস ও এম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করা যেতে পারে।
৮. দক্ষ প্রবীণবান্ধব সেবাকর্মী (জেরিয়েট্রিক কেয়ার গিভার) তৈরির উদ্দ্যেগ গ্রহন করা এবং বাংলাদেশে প্রবীণ সেবাকর্মীর চাহিদা মিটিয়ে উন্নত বিশ্বে দক্ষ জনবল হিসেবে তরুণদের কাজ করতে প্রেরণ করা। বাংলাদেশ থেকে উন্নতবিশ্বে এই জনবল পাঠানোর চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। কিন্তু সঠিক ট্রেনিংয়ের উদ্দ্যেগ গ্রহণের অভাবে আমরা প্রবীণ সেবাকর্মী এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পারছি না, এই উদ্যোগ গ্রহণ করাও এখন সময়ের দাবি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে (বাইগাম) এ বর্তমানে ১২০ জন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা ও কর্মচারি প্রবীণ সেবায় দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারি এক একর জমির উপর সরকারি অনুদানে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত দূর্দশার ভিতর দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে। কিন্ত গবেষণা ও তথ্য বলছে আগামীর বাংলাদেশ প্রবীণ নির্ভর বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে। তাই প্রতিষ্ঠানটিকে ‘ বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্সে’ রুপান্তরিত করে প্রবীণ কল্যাণে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন করে পুরোপুরি সরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ প্রতিষ্ঠানটিই হবে বাংলাদেশের প্রবীণকল্যাণে জন্য একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও, প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইন-২০১৮ পাশ হয়েছে, ভবিষ্যতে ভিন্ন আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি না করে বাইগামে ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ তৈরি করে প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশনটিও এখানে পরিচালনা যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সকলের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। আমাদের সদিচ্ছা এবং বাস্তবমূখী নানা পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবীণদের বর্তমান ও ভবিষ্যত সমস্যার ব্যাপকতা কমিয়ে আনা অনেকাংশেই সম্ভব। তাই এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে এবং গতিশীল পরিকল্পনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সস্তিময় বার্ধক্যের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তরুনদের প্রবীণ কল্যাণে কাজ করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে আজকের তরুনই আগামীকালকের প্রবীণ। সকলেরই বার্ধক্য সস্তিময় ও শান্তিময় হোক। আধুনিক বাংলাদেশ নির্মানের রুপকার গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, আমরা বিশ্বাস করি আপনার হাত দিয়েই বাংলাদেশের সেকেন্ড ক্যাপিটাল খ্যাত আগারগাঁয়ে সরকারী এই ১(এক) একর জমির উপর তৈরি হবে বাংলাদেশের স্থপতি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নামে ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’।
লেখক : বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষক/ উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী ওজরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান (বাইগাম)
১৩ মার্চ ২০২৪, ১৭:৪৯