• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
logo
মাদক নিরাময় কেন্দ্র ওয়েসিসে মিলছে আন্তর্জাতিক মানের সেবা
দেশের একটি নামকরা মেডিকেল কলেজের ছাত্র আতিকুর রহমান (ছদ্মনাম)। প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন এক ছাত্রীর প্রেম পড়ে পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে রেজাল্টও খারাপ করেন তিনি। এরপর মানসিক অবসাদে ভুগে ধীরে ধীরে ভয়াবহ মাদকসেবী হয়ে পড়েন আতিক। মাদক সেবনের পাশাপাশি মাদক কারবারেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। আরেকজন যুবকের নাম রানা হোসাইন (ছদ্মনাম)। পড়ালেখার পাশাপাশি গরুর খামার গড়ে অল্পদিনে সফলতা পান তিনি। এরপর নামেন ইজারা ব্যবসায়। স্থানীয় বন্ধুদের মাধ্যমে ফেনসিডিল সেবন শুরু করেন তিনি, কয়েকদিন পর হেরোইনে আসক্ত হয়ে পড়েন রানা। তার পরিবর্তন দেখে পরিবারের লোকেরা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের পর সংসারে দুই সন্তান এলেও তিনি মাদক থেকে বের হতে পারেননি। সেই সঙ্গে ব্যবসায়েও ধ্বস নামে তার। এক যুগ পরে রানা বুঝতে পারেন সকলের ভালোর জন্য তাকে সংশোধন হওয়া দরকার, নিজ উদ্যোগে ভর্তি হন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে।  আতিক ও রানা মাদকের অন্ধকার জগত থেকে ফিরতে চিকিৎসা নেন আড়াই বছর আগে বাংলাদেশ পুলিশের উদ্যোগে নির্মিত ‘ওয়েসিস’ মাদক নিরাময়, পুনর্বাসন ও স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্রে। তাদের মত অনেক মানুষের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে ‘ওয়েসিস’। ‘ওয়েসিস’ এর বাংলা হলো মরূদ্যান। ঊষরপ্রান্তরে মনোরম স্থান; নিরানন্দ জীবনে আনন্দের স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা। দেশের নড়বড়ে মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের বিপরীতে ‘ওয়েসিস’ এসেছে মরুভূমির মধ্যে সবুজ আর বারিবিন্দু নিয়ে মাদকাসক্তদের সেবার প্রতিষ্ঠান হিসেবে। জানা গেছে, পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে ২০২১ সালের অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ‘ওয়েসিস’। অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ও নান্দনিক পরিবেশে উন্নত ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা দেশের একমাত্র অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এটি। এখান থেকে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিকের বেশি মাদকাসক্ত নারী-পুরুষ চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে আছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার  হাবিবুর রহমান।  মাদকাসক্ত সব রোগীই এখানে চিকিৎসা নিতে পারেন। যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের সবসময় কাউন্সিলিং করা হয়। কেন মাদকে জড়ালেন, তাকে যেসব ওষুধ দেওয়া হচ্ছে সব ঠিক মতো কাজ করছে কি না, এসব বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়। চার মাস চিকিৎসা শেষে কেউ ফিরে গেলেই ওয়েসিসের কাজ শেষ হয়ে যায় না। একজন সিনিয়র কর্মকর্তা প্রতিনিয়ত রোগী ও তার স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং তারা ওয়েসিসে এলে বিনামূল্যে ফলোআপ চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। ফলোআপে যদি আমাদের সন্দেহ হয় তাহলে ডোপ টেস্ট করা হবে। এই ভয়ে কেউ পুনরায় মাদকে জড়ান না। ওয়েসিসে একসঙ্গে ৪৬ জন পুরুষ ও ১৪ জন নারী মিলিয়ে মোট ৬০ জনকে একসঙ্গে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এছাড়া বহির্বিভাগে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হয়। তাছাড়া টেলি-মেডিসিনের মাধ্যমেও অনেকে সেবা নেন; যেখানে অভিভাবকরা বেশি ফোন করেন। সন্তান বা পরিবারের কোনো সদস্য মাদক সেবন করছে বা লক্ষ্মণ আছে এমন সন্দেহ থেকে অনেকে ফোন করেন। তখন ওয়েসিসের বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরামর্শ দেন, যা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। প্রতিমাসে দেড় শতাধিকের বেশি মানুষ টেলি-সেবা নিয়ে থাকেন। এজন্য ফোন করতে হয় ০১৯৩০-৪০৪০৪০ এই নম্বরে। ওয়েসিসে চিকিৎসা নেওয়া আতিকের পরিবার জানিয়েছে, আতিকের অবস্থা জানতে পেরে একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়। তবে কিছুদিন পর সেখান থেকে ফিরে সেবনের সঙ্গে মাদক বিক্রিতে জড়িয়ে পড়ে। কয়েকটি নিরাময় কেন্দ্রে তাকে চিকিৎসা করানো হলেও কোনো সুফল পাননি। এরপর তাকে ওয়েসিসে ভর্তি করানো হয়। আতিক বলেন, আমি আমার অতীতের সব ভুল বুঝতে পেরেছি এখানে এসে। এখন আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, হাদিসের বই পড়ি, জিম করি। এখানের খাওয়ার মান উন্নত। এখানকার সবাই খুব ভালো। মনে হয় এখন আমি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই বসবাস করছি। প্রতিষ্ঠানটির মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোর্তজা হাসান বলেন, এখানে বেশিরভাগ হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ হরেক মাদকে আসক্ত রোগীরা আসেন। প্রকারভেদে তাদের বিভিন্ন চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে এখানে ইয়াবা আসক্ত রোগী বেশি। এরপর রয়েছে গাঁজাসেবীরা। ইয়াবা ও গাঁজা বহন করা সহজ, এ জন্য এসব নেশায় মানুষ বেশি আসক্ত হয়। ওয়েসিসের সক্ষমতা নিয়ে তিনি বলেন, দেশের অন্য সব হাসপাতাল বা নিরাময় কেন্দ্রের চেয়ে আমরা বেশি সেবা দিকে পারবো। দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা তুলনা করতে পারি। আমাদের এখানে সপ্তাহে নয়, প্রতিদিন সাইক্রেটিস্টরা রোগী দেখেন। রাতের বেলায়ও চিকিৎসকরা সেবা দেন। অন্য প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিয়ে আসা অনেকে এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা আর এখানকার চিকিৎসা পুরোপুরি ব্যতিক্রম বলে তারাই জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) সরেজমিনে ওসেসিসে ঘুরে দেখা গেছে, সাততলা ভবনটির নিচতলায় নিরাপত্তা কর্মীদের কক্ষ। যেখানে পুলিশও শিফট ভেদে ডিউটি করেন। এরই পাশে আউটডোরে রোগী দেখার রুম ও পাশে রোগীদের জন্য তৈরি রান্নাঘর। ভবনটির ১ থেকে ৩ তলা পর্যন্ত রোগীদের আবাসিক ব্যবস্থায় চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। সর্বাধুনিক প্যাথলজি ল্যাবের পাশাপাশি বিশেষ কেবিন ও ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা ও লাইব্রেরির সুব্যবস্থা আছে। এখানে এসি ফ্লোর, জেনারেল বেডের ওয়ার্ড,  নার্সিং স্টেশন, ফায়ার ফাইটিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে। বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোগীদের ঘোরার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে সুসজ্জিত বাগান। সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোগীদের জন্য ইয়োগা ও মেডিটেশন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বাগানের পাশেই রয়েছে ব্যায়ামাগার। মাদকাসক্তদের পরিপূর্ণ সেবা দিতে সরকারের সব বিধিমালা মেনেই গড়ে তোলা হয়েছে ওয়েসিস নামক প্রতিষ্ঠানটি। এখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসক, সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, ইয়োগা এক্সপার্ট এবং অভিজ্ঞ অ্যাডিকশন কাউন্সিলরদের মাধ্যমে সেবা পাচ্ছেন সেবা প্রত্যাশীরা। প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন পুলিশের পরিদর্শক সুশান্ত নারায়ণ দে বলেন, ‘পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আমরা দেখি মাদক নিরাময়ের নামে রোগীদের আটকে রাখা, নির্যাতন করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের প্রধান লক্ষ্য রোগীদের সেবা দেওয়া। আন্তজার্তিক মানদণ্ড অনুযায়ী একজন রোগীর জন্য যা যা দরকার সবই এখানে আছে। অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান স্যার সরাসরি এটা তদারকি করেন। এখানে কোনো কিছুর ব্যত্যয় যাতে না হয় সেক্ষেত্রে তিনি খুবই কঠোর। আমাদের এখানে বাইরের খাবারের অনুমোদন নেই। টাটকা খাবার এখানেই রান্না করা হয়; যা রোগী ও স্টাফ মিলে প্রতি-বেলায় প্রায় ৭০ জনের। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ওয়েসিসে চিকিৎসার মান ও পরিবেশ আন্তর্জাতিক মানের গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপাশি অনেকে বিসিএস পরীক্ষারও জন্য পড়াশোনা করছেন। নারীদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের কাছে যারা সেবা নিতে এসেছেন তারা চিকিৎসা শেষে ফিরে যাওয়ার পরেও তাদেরকে মনিটরিং করা হয়। ফোনে রোগী বা তার স্বজনদের কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি সুস্থ আছেন কি না। যদি সমস্যা হয় সেটা কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আমরা পরামর্শ দিই তিনি যাতে সুস্থ থাকেন।  তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার এই সময়ে যতটুকু কাজ আমরা করেছি সবই সাক্সসেসফুলি হয়েছে। এটাকে সমাজের পজিটিভ দিক হিসেবে মনে করি যে পুলিশ আইনের প্রয়োগ না করেও এমন কাজে সফল হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান বলেন, ওয়েসিসের কার্যক্রম বড় পরিসরে করার জন্য মানিকগঞ্জে একটি জায়গা নেওয়া হয়েছে। সেখানে রিসোর্ট টাইপের নিরাময় কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। সেখানে খেলার মাঠ, উ-মুক্ত জায়গা ও পাশে কালিগঙ্গা নদীতে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। সেখানকার যে চিকিৎসা পদ্ধতি থাকবে তা সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের। আমরা মনে করি মাদক নিরাময়ের ক্ষেত্রে এটি বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।  
২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:৪৫
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়