• ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
logo

অগ্নিপুরুষ: অক্ষরচিত্রে অগ্নিঝরা ইতিহাস

দীপঙ্কর দীপক

  ১৭ মার্চ ২০১৮, ২১:৫৮

ছয় দফা তথা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অগ্নিঝরা ইতিহাসের শৈল্পিক চিত্রপট ‘অগ্নিপুরুষ’। এ উপন্যাসে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতা থেকে মহানেতা, জনবন্ধু থেকে বঙ্গবন্ধু ও অগ্নিপথিক থেকে অগ্নিপুরুষ হওয়ার কাহিনি সুনিপুণভাবে উঠে এসেছে। উপন্যাসের মহানায়ক তিনিই। খলনায়ক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। তিনি পাকিস্তানের দাপটশালী রাষ্ট্রপতি। তাঁর হাতে রয়েছে ভারি ভারি আগ্নেয়াস্ত্র। লাখ লাখ সেনা-পুলিশের সমারোহ। অন্যদিকে মুজিবের ছিল শুধু অটল বাংলাপ্রেম, অধিকারকামী জনতা, ভরাট কণ্ঠ ও স্ত্রীর অনুপ্রেরণা। এসব মানবিক শক্তি দিয়েই তিনি পরাস্ত করলেন বারুদের মতো বিস্ফোরক এক খলনায়ককে। সেনাসজ্জিত মৃত্যুলোক থেকে তিনি বিজয়ীর বেশে জনতার মাঝে ফিরে এলেন বীরদর্পে। দেশকে স্বাধীনতার দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন জীবনবাজি রেখে।

ইতিহাসের কঙ্কালসারসম এ বিমূর্ত আখ্যানকে আধুনিক উপন্যাসের আঙ্গিকে প্রাণদান করলেন বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল। নাম দিয়েছেন ‘অগ্নিপুরুষ’। হ্যাঁ, শেখ মুজিব অগ্নিপুরুষই বটে। তাঁর কণ্ঠে আছে বারুদসম বিস্ফোরকীয় শক্তি। আগুনের মতো সাহসী তাঁর তেজ। দাবানলের মতো মানবীয় স্ফুরণ। আপসহীন নেতা তিনি। মৃত্যুভয় তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ। শুধু একটি আঙুল উঁচিয়েই তিনি স্বৈরশক্তির দৃঢ় সিংহাসনকে নড়বড়ে করে তোলেন মুহূর্তেই। রাজনীতিবিদ ছাড়াও শেখ মুজিব ছিলেন বইপ্রেমী ও কবিতানুরাগী। সাংবাদিকদের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ। শত জেল-জুলুমের মধ্যেও পরিবারের প্রতি সব ধরনের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেন। কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল অক্ষরচিত্রের মাধ্যমে তাঁর বাস্তবিক চিত্রসম প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করেছেন।

চমকপ্রদ ঘটনাবিন্যাসের মধ্য দিয়ে উপন্যাসটির কাহিনি শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের লাহোরে ছয় দফা ঘোষণা করে শেখ মুজিব স্বস্তির সঙ্গে ঢাকায় পা রাখেন। চলচ্চিত্রের শুরুতে যেভাবে একজন নায়ককে উপস্থাপন করা হয়, ঠিক সেভাবেই উপন্যাসের এ মহানায়ককে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাঙালির মুক্তির সনদ ঘোষণা, বিমানযাত্রা, প্রিয় মাতৃভূমিতে পা রাখা- সবমিলিয়ে নায়কীয় দৃশ্যই বটে। ছয় দফা ঘোষণায় রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সিংহাসন মুহূর্তেই টালমাটাল হয়ে ওঠে। ক্ষমতা ধরে রাখতে চ্যালা-চামুণ্ডাদের সহায়তায় মুজিববিরোধী একের পর এক কূটচাল আঁটতে থাকেন। সেনাপতি মুসা খান ও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এ কাজে যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খান। কিন্তু মুজিবীয় শক্তির কাছে বারবার হেরে যান তারা। অবস্থা বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে ফাঁসিতে ঝোলানোর অপতৎপরতা শুরু করেন। বিশ্বস্ত আইনজীবীসহ জেলের বাইরে থাকা দলীয় নেতাকর্মীদের সহযোগিতা না পেয়ে অনেকটা বিমর্ষ হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তাঁর দৃঢ়প্রত্যয়ী সহধর্মিণী রেণুর গোপন বার্তায় মাথা নত না করার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন। লাখো-কোটি জনতা তাঁর সহসী পদক্ষেপকে স্বাগত জানায়। তাঁরা রাজপথে নেমে এসে সুউচ্চ কণ্ঠে বলেন, ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ সাধারণ জনতার বজ্রশক্তি ও রোষাণল দেখে পুনরায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন ক্ষমতাধর জেনারেল আইয়ুব খান। শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। সবশেষে আইয়ুব খানের বিদায়ের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনিপ্রবাহের সমাপ্তি ঘটে। রাজনীতির পাশাপাশি এ উপন্যাসের আখ্যানভাগে তৎকালীন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, সাহিত্য-সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির নানা দিক ও ইতিহাসের খুঁটিনাটি চিত্রপট সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

‘অগ্নিপুরুষ’ আড়াইশ পৃষ্ঠার সুদীর্ঘ উপন্যাস। ডিজিটাল যুগের এ সময়ে এতগুলো পৃষ্ঠা টানা পাঠ করার ধৈর্য কম পাঠকেরই আছে। কিন্তু ‘অগ্নিপুরুষ’র লেখনির মধ্যে আছে আলাদা সম্মোহনী শক্তি, যা পাঠককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইয়ের পাতায় নিবিষ্ট করে রাখে। এ উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ এমনভাবে সাজানো যে পরবর্তী কাহিনি জানতে পাঠক উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। মোস্তফা কামালের লেখনির মধ্যে যথেষ্ট গতি আছে। এ গতিই উপন্যাসটির পাঠকপ্রিয়তার মূলমন্ত্র।

উপন্যাস যতই ভালো হোক না কেন সমালোচকদের চোখে দু’একটি ভুলত্রুটি ধরা পড়বেই। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে এ উপন্যাসের কয়েকটি দুর্বল দিকও রয়েছে। প্রথমটা হচ্ছে, মনের অজান্তে হলেও লেখক উপন্যাসটি সমাপ্তির ক্ষেত্রে ছোট গল্পের রীতিকে কিছুটা অনুসরণ করেছেন। মাত্র আধা পৃষ্ঠা (শেষ পর্ব) বর্ণনার মধ্য দিয়ে বৃহদাকার এ উপন্যাসের কাহিনি সম্পন্ন করেছেন। দ্বিতীয়ত, ইতিহাসের জঘন্যতম খলনায়ক আইয়ুব খানের পতন মাত্র দুই লাইনে বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয়ত, উপন্যাসের মাঝামাঝিতে লেখক মতিয়া চরিত্রটিকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। তাঁর পরিবারকে কয়েক পর্ব পরপরই উপস্থাপন করে উপন্যাসটির কলেবর বর্ধিত করেছেন। কিন্তু শেষ দিকে এসে মতিয়া চরিত্রটি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তাছাড়া মানিক মিয়া ও বজলুর রহমানের সর্বশেষ অনুভূতি অনেকটা আড়ালেই থেকে গেছে। কাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুসারে শেখ মুজিবের সহযোদ্ধা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমেদের চরিত্র আরেকটু দীর্ঘায়িত করা যেত। প্রতিটি উপন্যাসের অখ্যানভাগে নায়কের পাশাপাশি নায়িকারও যথেষ্ট গুরুত্ব থাকে। কিন্তু এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রটি কিছুটা অবহেলিতই বটে। সেদিক থেকে ফজিলাতুন্নেছা রেণুর চরিত্রটি আরেকটু শক্তিশালী হলে পাঠকের মধ্যে আত্মতৃপ্তি আরও বেড়ে যেত। তাছাড়া উপন্যাসটির আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো, তৎকালীন ইতিহাসকে ঘটনাপ্রবাহ অনুসারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করতে গিয়ে লেখক তাঁর ব্যক্তি জীবনদর্শনকে কদাচিৎ উপস্থাপন করতে পারেননি। অথচ বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মীর মশাররফ কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকদের উপন্যাস বিশ্লেষণ করলে তাঁদের লেখনীর মধ্যে ব্যক্তি জীবনদর্শন তথা নবদর্শনতত্ত্ব পাঠকদের জ্ঞানলোককে মুহূর্তেই বিকশিত করে তোলে।

সর্বোপরি ‘অগ্নিপুরুষ’ স্বার্থক একটি উপন্যাস। এর নামকরণও যথার্থ। ভাষা-ব্যবহারেও সাবলীলতা রয়েছে। সংলাপ বুনন ও চরিত্র চিত্রায়ণে রয়েছে দক্ষতার ছাপ। ঘটনাপ্রবাহ অনুসারে পর্বের ধারাবাহিকতাও চমৎকারভাবে বজায় রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে ‘অগ্নিপুরুষ’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।

পুনশ্চ: সদ্যসমাপ্ত অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে পার্ল পাবলিকেশন্স। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। মূল্য ৪০০ টাকা। বর্তমানে বইটি অনলাইন পরিবেশক রকমারি ডট কমেও পাওয়া যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন

daraz
  • শিল্প-সাহিত্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
ইতিহাস গড়ল ইউএস-বাংলা, আবুধাবিতে বেসরকারি ফ্লাইট চালু
১৯ এপ্রিল : ইতিহাসে আজকের এই দিনে
১৮ এপ্রিল : ইতিহাসে আজকের এই দিনে
১৭ এপ্রিল : ইতিহাসে আজকের এই দিনে
X
Fresh