• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
logo

শেষ বিকেলের আলো

জান্নাতুল ফেরদৌস রিমু

  ২৬ জানুয়ারি ২০১৮, ১৬:৫৩

আমাদের অতি ব্যস্ত জীবন থেকে দু'মিনিট সময় নিয়ে আসুন আজ একটা গল্প শুনি।

"আন্নেরা কই থন আইসেন আফু? আমগোরে দেখতানি আইসো? কত মাইনসে আহে! হুদা আহে না!"

জীবনসায়াহ্নের এই পড়ন্ত বেলার গল্প শোনার শুরুটা আমাদের এমনই।

কথা বলছিলাম বিনতি সেন বনলতার সাথে। প্রশ্নোত্তর প্রক্রিয়ায় কথা এগিয়ে যাবে এই চিন্তা থাকলেও বনলতা সেন আশ্রমের শেষ বয়েসের হেরে যাবার গল্প শুরু করলেন নিজ থেকেই। নিজ নিয়তিকে মেনে নিয়ে আক্ষেপ করছিলেন সঙ্গের বৃদ্ধার ভাগ্যে ঘটে যাওয়া নির্মমতার কথা মনে করে।

এককথা, দু'কথায় অব্যক্ত কথাগুলো ভাষা পেতে শুরু করে মৃণালিনী দেবীর। শখ করে ছেলের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন বছর দুই পরে, আশ্রমের ছুটি যে সহজে মেলে না। সেবার পূজোর আয়োজন সারা বাড়ি জুড়ে। বউমা কে দেখে আবেগে কেঁদে দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মৃণালিনী দেবী। কতদিন পর দেখা, ছেলে-বউ বাচ্চা মানুষ, কাজের চাপে মাকে ভুলে যেতেই পারে। মৃণালিনী কী করে ভুলেন?

জাপটে ধরার সাথে সাথে বউমা সরে গেলো এক ঝটকায়। বুড়ো বয়েসের শরীরের গন্ধে যদি দামি পারফিউমের ঘ্রাণ ফিকে হয়ে যায়? কোনোরকমে স্টোররুমটা কাজের মেয়েকে দিয়ে পরিস্কার করে থাকার মত করে নিলেন বৃদ্ধা।পূজোর সকাল,সবাই তৈরি ট্রেন্ডি কাপড়ে। মাকে ছাড়া পূজো দেরি হয়ে যাবে এই চিন্তায় কাঁপা হাতে তিন বছর আগে ছেলের দেয়া শেষ শাড়িটা পরে নিলেন মৃণালিনী।

বাড়ির কর্ত্রীকে বাদ দিয়ে ছেলের ইচ্ছায় বৃদ্ধা পুজোর থালি নিতে হাত বাড়ালে বউমা প্রদীপের গরম তেলটা হাতেই ফেলে দিল। কুচকে যাওয়া চামড়া পুড়ে যাওয়ায় এতটুকু কষ্ট হয়নি মৃণালিনীর, যতটুকু অন্তর পুড়েছে ছেলে আর ছেলেবউ এর তাচ্ছিল্য, বকাঝকার তীরে। বুড়ো বয়েসে তার এত আধিখ্যেতা নাকি ছেলের সংসারে অশান্তি ডেকে আনছে।

সেদিন দু'বেলা অভুক্ত, পোড়া হাত দিয়ে খাবার যে জো নেই। মাঝরাতে খিদের জ্বালায় বৃদ্ধা যখন রসুইঘরে, বউমা পুড়ে লাল হয়ে যাওয়া হাতটা এক ঝটকায় টান দিলে মৃণালিনী আছাড় খেয়ে পরলেন সামনের বেদিতে। বুড়ো মানুষ কিভাবে ভুলে গেলেন যে বউ এর জিনিসে বাইরের কেউ হাত লাগালে তার মেজাজ চড়ে যায়। মাঝখান থেকে ছেলেটার মায়ের কাজের জন্য বারবার বউয়ের কাছে মাফ চাইতে হলো।

ছেলেটা বড় বাধ্য ছোটবেলা থেকেই। ঝামেলা একদম সইতে পারে না। তাইতো বৃদ্ধার শেষ ইচ্ছেটা পুরণ করেছিল। পরদিন ভোরেই আশ্রমে রেখে যাবার ব্যবস্থা করেছে তড়িৎ গতিতে। এইখানে যেদিন রেখে যায় সেদিন ছিল বুধবার, ছেলেটা যাবার সময় মৃণালিনী দেবীকে পাঁচশো টাকা হাতে দিয়ে অনুরোধ করেছিল তার সংসারে আর অশান্তি না করতে।

বৃদ্ধা তার কথা রেখেছেন, আজ পাঁচ বছর হল ছেলের সাথে যোগাযোগ নেই। ছেলে বউ নিয়ে শান্তিতে আছে এতেই শান্তি। মরবার আগে এর চেয়ে বেশি আর কী চাওয়ার আছে জীবনের কাছে? উপরের ঘটনাকে কেউ আমার মস্তিষ্ক প্রসূত মনে করলে ভুল করবেন। এই ছিল চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়ায় অবস্থিত "আমেনা বশর বৃদ্ধাশ্রম" এর প্রতিনিয়ত ফেলা দীর্ঘশ্বাস এর কেবল একটি।

আমি কেবল নামটা বদলে দিয়েছি, আশ্রমের দাদুকে যে কথা দিয়েছি তার নাম কেউ জানবে না। এমন হাজার গল্পের সাক্ষী একেকটা আশ্রম। এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের যত্নের কমতি রাখেনি, তবুও ছানি পড়া চোখগুলো প্রতিনিয়ত খুঁজে ফিরে তাদের প্রিয়জনদের হাসিমাখা মুখগুলোকে। একেকটা আশ্রম যেন - পরাজিত মানবতার দুঃসহ কষ্টের, গ্লানির আর কান্নার অসহ্য বেদনার এক নীড়।

যে সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তায় মা-বাবা জীবনের শেষ সম্বলটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন, নিজেদের অস্তিত্বের কথা ভাবেননি। আজ কিনা তাদেরই একটু আদর, একটু সম্মান, সামান্য কথা বলার সময় ভিক্ষা করতে হয় অফিসার, গ্রাজুয়েট ব্যস্ত সন্তানের কাছে ? আমরা আধুনিক হচ্ছি পোশাকে-কলমে, মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ে। আমি এই আধুনিক যুগের সন্তান হতে চাইনা, জীবন সায়াহ্নে এমন সন্তানের মা হতে চাইনা। শেষ বিকেলের আলোয় জয় হোক মানবতার। ভালো থাকুক জগতের সকল বাবা-মা।


জান্নাতুল ফেরদৌস রিমু, শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

মন্তব্য করুন

daraz
  • শিল্প-সাহিত্য এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh