• ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
logo

ভিনদেশী স্যাটেলাইটের আগ্রাসনের বিপরীতে আমাদের করণীয় : কয়েকটি প্রস্তাব

আলী ইমাম

  ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ২১:৪২

সামগ্রিক অবস্থা সবিস্তারে পর্যালোচনা করে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, টেলিভিশনের বিশ্বজয় সম্পন্ন হয়েছে। পৃথিবীজুড়ে এই ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমটি অব্যাহতভাবে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে। অপ্রতিহত তার ক্ষমতা। অপ্রতিরোধ্য তার বিস্তার প্রক্রিয়া। আর এই প্রক্রিয়াটি অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বাস্তবায়িত হয়েছে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মহা শক্তিশালী প্রযুক্তির মাধ্যমে। পৃথিবীর অধিকাংশ দর্শককে এই চরম আগ্রাসী প্রচারণার আওতায় এনে দর্শকদের চিন্তাশক্তিকে তীব্রভাবে আচ্ছন্ন করে এই প্রক্রিয়াটি কার্যকর হয়েছে। মানুষের চিন্তাশক্তি ও বোধশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সমাজবিদেরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছেন স্যাটেলাইট টিভির আগ্রাসন ব্যবস্থাকে। এর ভয়ঙ্কর প্রভাব অবলোকন করে আতঙ্কিত হয়েছে বুদ্ধিজীবী সমাজ। বহু ক্ষেত্রে অশুভ শক্তির সর্বগ্রাসী সম্প্রসারণ ঘটেছে। শুভকর চেতনার অবসান হয়েছে। এই প্রযুক্তির ধারণাটির উদ্ভাবক প্রখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনি রচয়িতা আর্থার সি ক্লার্ক। তিনি ধারণা করেছিলেন উপগ্রহের মাধ্যমে এক শক্তিশালী সংযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার। ১৯৪৫ সালে ‘স্যামসটস’ সাময়িকীতে তার ধারণাপ্রসূত রচনাটি প্রকাশিত হয়। তার মতে, পৃথিবী থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে কৃত্রিম উপগ্রহের পক্ষে প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় একটি আবর্তন সম্পূর্ণ করা সম্ভব। আর একটি সঠিক কক্ষপথে ১২০ ডিগ্রি ব্যবধানে তিনটি উপগ্রহ ষ্টেশন স্থাপন করা গেলে সেগুলোর সাহায্যে পুরো পৃথিবীজুড়ে টেলিভিশন সম্প্রচারের যোগাযোগ ব্যবস্থা অতি সহজে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। ক্লার্ক হিসেব করে দেখেছিলেন, বিষুবরেখার ২২,৩০০ মাইল উপর বরাবর কক্ষপথে একটি উপগ্রহের পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার গতি পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতির সঙ্গে মিলে যায়। অর্থাৎ পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে উপগ্রহটির অবস্থান সবসময় একই স্থানে থাকবে। এই নির্দিষ্ট এলাকাটির পরিচয় হলো ‘ভূ-সমলয় কক্ষ’।

ক্লার্ক ধারণা দিলেন উপগ্রহ মারফত যোগাযোগ পদ্ধতির। যাতে পৃথিবীর কোন স্থান থেকে কিভাবে শব্দ, ছবি প্রেরণ করা যেতে পারে তার রূপরেখা ছিল। প্রথমে নিকটবর্তী উপগ্রহ যোগাযোগ ভূ-কেন্দ্রের অ্যান্টেনাতে তা ধরা হয়। তারপর সেটি পাঠানো হয় উপগ্রহে। যেটি স্থাপিত রয়েছে মহাকাশে। সেই উপগ্রহ ক্ষীণ সঙ্কেত বার্তাকে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ আকারে শক্তিশালী করে। এমনকি এই কম্পনাঙ্ক পরিবর্তন করে পৃথিবীরই অন্য প্রান্তের কোনো উপগ্রহ যোগাযোগ ভূ-কেন্দ্রে পাঠায়। সেই গ্রাহক কেন্দ্রের অ্যান্টেনাতে ধরা পড়ে সঙ্কেত বার্তা। সেখান থেকে তা তখন নিকটবর্তী বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়। ১৯৬৩ সালে সফলভাবে প্রথম কক্ষপথে সিনকম-২ উপগ্রহ পাঠানো হয়। ১৯৬০ সালে ‘আর্লি বার্ড’ নামে উপগ্রহ প্রেরণ করা হয় যা সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আন্তঃমহাদেশীয় টেলিভিশন যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করে। সেই অগ্রগতির পথ ধরে দূরদেশীয় টেলিযোগাযোগের বিশাল অংশ সম্পন্ন হয়েছে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে।

বিজ্ঞান কল্পকাহিনির শ্রেষ্ঠ লেখক আর্থার সি. ক্লার্ক ধারণা দিয়েছিলেন উচ্চ বিষুবীয় কক্ষপথে স্থাপিত কয়েকটি কৃত্রিম বস্তুর মাধ্যমে বেতার সঙ্কেতের দিক পরিবর্তন করে সমস্ত পৃথিবীজুড়ে চিত্র প্রেরণ করা সম্ভবপর। বিজ্ঞান কল্পকাহিনি রচয়িতার সেই উত্তেজনাময় কল্পনাটি বাস্তবায়িত হলো। আর তার ফলে টেলিভিশনের পর্দা পরিণত হলো মানুষের চোখ এবং কানে। উপগ্রহ টিভি প্রযুক্তি কল্পনাতীত দ্রুততায় চলমান চিত্র প্রেরণ শুরু করল। অবিশ্বাস্য রকমের ক্ষমতাশীল হয়ে উঠল এই প্রচার কার্যক্রম। পৃথিবীর টিভি দর্শককুলকে গেঁথে ফেলল এক যোগসূত্রে। বহু যোজন দূরে সংঘটিত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে উঠল মানুষ।

ষাটের দশকে কানাডার মন্ট্রিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ম্যাকলুহান সর্বপ্রথম বিশ্বকে ‘ইলেক্ট্রনিকস ভিলেজ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বিশ্ব রূপান্তরের পালাকে সার্থকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। পুরো পৃথিবী পরিণত হয়েছে ‘বিদ্যুৎ গ্রামে।’ একথা স্বীকৃত হলো যে মানুষের মনে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারে পারঙ্গম টিভি মাধ্যম। স্যাটেলাইট প্রক্রিয়াতে সংযুক্তকরণের ফলে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান প্রচার কার্যক্রমে নব-তরঙ্গ সঞ্চারিত হয়ে একে করে তুলল আগ্রাসী মনোভাবসম্পন্ন। এতে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব ঐতিহ্যকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক বোধের ওপরে প্রচ- রকমের হামলা হলো। স্বকীয় সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে উঠল। দর্শকদের মনোজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করল এই ধারা। এই আগ্রাসন প্রক্রিয়া বহু দেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে গভীরতর সঙ্কটের সৃষ্টি করল। তারুণ্যকে বিভ্রান্ত করল। স্বাতন্ত্র্যবোধ বিনষ্ট হলো। ‘আত্ম-পরিচয়’ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করল। রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলল। এই সঙ্কট এমনই এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করল যে এর স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে ‘মিডিয়া সন্ত্রাস’ শব্দটি ব্যবহৃত হলো।

এক সমালোচক এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আরশিনগর তৈর হয় না কার? যাকে দেখা না-যায় একদিনও তার খোঁজে দিন যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন খবর হয় ঐ নগরের মালিক ‘আমি’ নয়, ‘প্রভু’Ñ গ্রামময় রাষ্ট্র হয়। আয়নায় আবছা হয় ‘আমি’ পড়শি ভেসে ওঠে। আমার বাইরের অথচ আমারই অস্তিত্বের, অর্থাৎ ‘আমাদের’, ইতিহাস কখনো সমাজ কখনো অচেতন কখনো বা রাষ্ট্রের জামা গায়ে দিয়ে টেলিভিশনে হাজির হয়। তখন তাহাকে বলে তাঁহার প্রভুর স্বর। বকধার্মিক সময় দাঁড়িয়ে থাকে এক পায়ে, আর ঝিম মারা সতর্কতায় বোঝে ‘এইখানে শিকার বোধহয় বসে থাকে শিকারির খোঁজে।’ পর্দা থেকে বিড়াল বেরিয়ে আসে রাস্তায়, ইঁদুর লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ে পিকচার টিউবে।’

এই স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সাহায্যে পৃথিবীর উন্নত, অতি উন্নত দেশের অনুষ্ঠান সমূহ অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রচারিত হয়ে দারুণ প্রভাব ফেলল। পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সমাজের দর্শন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মূল্যবোধকে অনায়াসে বিপর্যস্ত করল। সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী জীবনধারা দর্শনে দর্শককুলের মৌলিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে চিড় ধরল। মানবিক বিশ্বাসে ফাটল ধরল। বেনিয়া সমাজের বিনিয়োগকৃত অর্থে নির্মিত অনুষ্ঠানের অনেক ক্ষেত্রে উদ্দেশ ছিল বাজার-অন্বেষা। দর্শকদের ক্রেতা হিসেবে ভাবা হয়েছে। এ যেন ছিল সুচারুরূপে বিপণন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া।

মিডিয়া সন্ত্রাসে কবলিত হলো পৃথিবীর টিভি সম্প্রচার ব্যবস্থা।

বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কির মতে, সন্ত্রাস অন্য ভাবেও কাজে আসে এবং সন্ত্রাস ক্ষমতাশালীদের একটা অস্ত্র। সন্ত্রাসকে দুর্বলদের অস্ত্র হিসেবে সচরাচর যেভাবে বলা হয় সেভাবে বললে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একটি মারাত্মক ভুল থেকে যায়। সহিংসতার অন্যান্য হাতিয়ারগুলোর মতো সন্ত্রাসও প্রধানত ক্ষমতাশালীদের অস্ত্রÑঅভাবনীয়ভাবেই।’

স্যাটেলাইট টিভির কল্যাণে এক দেশের অনুষ্ঠান ভিন্ন দেশে প্রচারিত হয়ে দর্শকদের মন-মানসিকতা, ধ্যান-ধারণাকে অনেক ক্ষেত্রে পাল্টে দিল। চিন্তা-চেতনার জগৎকে পরিবর্তন করল। বুদ্ধিবৃত্তির বিন্যাসকে বিশৃঙ্খল করল। সা¤্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বিযুক্ত করে পশ্চিমা মিডিয়া এমন ছবি দর্শকদের সামনে বিজ্ঞাপনের মতো অবিরতভাবে তুলে ধরেছে যা বিভ্রান্তিকর।

এরূপ মিডিয়া সন্ত্রাসের উৎস কি? কোনোরূপ ভিসা বা প্রবেশানুমতির তোয়াক্কা না করে এক দেশের টেলি অনুষ্ঠান ঢুকে পড়ছে ভিন্ন দেশে। টেলিভিশনের বিশ্বায়ন হলো।

আমাদের দেশে বছর কয়েক আগে যখন ডিশ অ্যান্টেনা প্রথম চালু করা হলো তখন ব্যাপারটিকে ধনীলোকদের শখ হিসেবে ধারণা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ টেলিভিশন বিবিসি ও সিএনএন সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে তার স্বাদ পৌঁছে দিল সাধারণ মানুষের কাছে। টেলিভিশনের দর্শক মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর মানুষ অবলোকন করল আন্তর্জাতিক মানের প্রচার মাধ্যমের রূপরেখা। কিভাবে সংবাদ তৈরি হয়ে পরিবেশিত হয় তা জানা গেল। নানা ধরনের ব্যক্তিত্বকে কিভাবে সর্বসাধারণের মুখোমুখি করানো যায় তা দেখানো হলো। এতে জনমত গঠনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ধারণা হলো, অতি দ্রুত ছোট হয়ে এসেছে পৃথিবী। এই প্রযুক্তিকে বর্তমানে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চলছে। টেলি-ব্যবসা এক বিশাল রূপ পরিগ্রহণ করেছে। জরিপে জানা গেছে যে বর্তমান পৃথিবীতে এক বিলিয়ন টিভি সেট রয়েছে। প্রতিবছর চাহিদাজনিত কারণে টেলিভিশনের সংখ্যা শতকরা পাঁচটি করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর সমগ্র জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি লোক এশিয়া অঞ্চলে বসবাস করে। সেখানে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পাবে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় যে প্রতি বছর টেলি অনুষ্ঠান নির্মাণের পেছনে ৬৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়িত হয়। প্রতি বছর এই ব্যয়ের পরিমাণ শতকরা দশভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে সর্বোচ্চ টেলি অনুষ্ঠান উৎপাদক দেশ। সে দেশের অর্ধেক লোক জন্ম থেকে বাড়িতে টিভি সেট দেখছে। গোটা পঁচিশেক চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখতে অভ্যস্ত। সেখানে শিশুদের নিকট টেলিভিশন ‘থার্ড প্যারেন্ট’ বলে পরিচিত। দেশটি টিভি অনুষ্ঠান বিভিন্ন দেশে অবাধে রপ্তানি করে প্রতি বছর প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার আয় করছে। তারা সৃষ্টি করেছে টিভি সা¤্রাজ্যবাদ।

বর্তমানে ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে ৪০০ টি চ্যানেলে স্যাটেলাইট সম্প্রচারিত হচ্ছে। এর অর্ধেকেরও বেশি হচ্ছে আমেরিকান। পৃথিবীর প্রায় ১৪০ টি দেশের অধিবাসীরা নিয়মিত সিএনএন-এর অনুষ্ঠান দেখে থাকে। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের এই যুগে মিডিয়া বহুভাবে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান অনুসন্ধানী টিভি প্রতিবেদকেরা মিডিয়াকে ভাঁওতাবাজ হিসেবে বিবেচনা করে। তারা মিডিয়াকে ভায়োলিনের মতো ব্যবহার করতে জানে। সেই চেষ্টায় তারা তৎপর থাকে।

মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারণার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন, ‘তিরিশের দশকে প্রচারণা প্রত্যয়টি সকলেই ব্যবহার করত। জনসংযোগের শিল্পগুলো প্রচারণা ব্যবহারের পক্ষে ওকালতি করত। মিডিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বেশ সহজসাধ্য।

সূচি নির্ধারক মিডিয়াগুলো অন্য সকলের জন্য আলোচনা-সমালোচনার কাঠামো নির্ধারণ করে দেয়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মতোই তাদের নিজস্ব পণ্য ও বাজার রয়েছে। তাদের বাজার হলো বিজ্ঞাপনওয়ালারা। তাদের পণ্য হলো তুলনামূলকভাবে বেশি সুযোগ-সুবিধাভোগী অডিয়েন্স। বৃহদাকার কর্পোরেশনগুলো এমন অডিয়েন্সকে অন্য কর্পোরেশনগুলোর কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে।

যেকোনো প্রযুক্তির মতোই ইন্টারনেটও দ্বিমুখী করাত। ইন্টারনেটও মুক্তির সম্ভাবনাকে ধারণ করে কিন্তু একই সাথে এটি দমনমূলক সম্ভাবনাও ধারণ করে। এখন কোন পথে ইন্টারনেট যাবে তা নিয়ে একটা লড়াই চলছে। টেলিভিশন নিয়েও চলেছিল।

ইন্টারনেট গণতন্ত্রায়নের সম্ভাবনাকে ধারণ করে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপুল অগ্রগতি ঘটেছে। এটা আকাশ থেকে পড়া কোনো দান নয়। এটা হলো জনগণের একত্রিত হওয়া এবং স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানানোর ফল।

টেলিভিশনের বিশ্বায়ন মিডিয়ার প্রভাবশালীত্বকে প্রতিষ্ঠিত করল। টেলি সভ্যতা দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ল। মানবমনে সবচাইতে অধিক পরিমাণে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হিসেবে স্বীকৃত টিভি মাধ্যমের দিগি¦জয় সম্পন্ন হলো। টেলি শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো। এর অমোঘ আকর্ষণকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা সকলের নেই। যে কারণে গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে লোকজন অতি প্রয়োজনীয় ফ্রিজ ক্রয় করার পূর্বে টেলিভিশন ক্রয়ের কথা ভাবে।

স্যাটেলাইট টিভি প্রবল দাপটের সাথে তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে লাগল। পাশ্চাত্যের পপ সঙ্গীতের চ্যানেল, নানা স্বাদের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আগ্রাসী ভূমিকায় নেমে পড়ল এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। অনেকটা যেন থাবা বিস্তার করল। সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় বিপন্ন করে তুলল এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে। ঐতিহ্যকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক চেতনার মূল উপড়ে তুলে উন্মূল করা হলো। শেকড়বিহীন অবস্থায় পতিত হলো সুস্থ সাংস্কৃতিক বিশ্বাস। এসব দেশের তারুণ্যদীপ্ত সংস্কৃতিকে একাকার করে ফেলার যাবতীয় উপাদান এনে দিল। এটি আবার শুধুমাত্র শহুরে মধ্যবিত্তের তরুণ অংশের মধ্যেই প্রধানত সীমাবদ্ধ রইল না। প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে সহজলভ্য হওয়াতে সার্বিক মননে তার প্রভাব পড়ল। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত আক্রান্ত হলো। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তার কুপ্রভাব থেকে বাদ পড়ল না। যার অনেকটাই ছিল অপচয়। ক্ষতিকারক দিক ক্রমশ প্রকটতম হয়ে উঠল। বিশ্বায়নের অনিবার্য ফল এটি। অবশ্য এর অগ্রগতির ইতিবাচক দিকও রয়েছে। এই অনিবার্য প্রবণতার সুযোগ প্রযুক্তিকে এনে দিয়েছে ক্রমাগত সহজলভ্য করে পাওয়ার ক্ষমতা। ক্যাবল টিভি অতি স্বল্পমূল্যে বাণিজ্যিকভাবে এই সুবিধাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে।

১৯৯৫ সালে ভারতে সুপ্রীম কোর্টের এক আইনি লড়াইতে সম্প্রচার তরঙ্গকে জনগণের সম্পত্তি বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। য়ুনেস্কো থেকে ঘোষিত হলো, ‘তথ্য জানা মানুষের মৌলিক অধিকারের পর্যায়ভুক্ত।’ যে চারটি মৌলিক অধিকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আশ্রয়, খাদ্য স্বীকৃত ছিলো তাতে সংযোজিত হলো তথ্য। এর সুযোগ গ্রহণ করে শত শত টিভি চ্যানেল বিকশিত হয়ে উঠল। অবাধ তথ্য প্রবাহে সম্পৃক্ত হয়ে তারা অনেক ক্ষেত্রে বিকৃত অপ-সংস্কৃতির প্রচার শুরু করল। স্যাটেলাইট টেলিভিশনের একটি প্রধান কার্যক্রম হয়ে উঠল অপ-সংস্কৃতির প্রসার।

পাশ্চাত্যে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গমালা এক দারুণ সম্পদ। যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গমালার অবদান প্রচুর। পুরো দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের দু থেকে তিন শতাংশ।

টিভি বহুল দেশগুলোর সাংস্কৃতিক জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় টেলিভিশনের মাধ্যমে। দৈনন্দিন জীবনধারাও বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনও ঘটে। জাপানি গৃহে বাথরুমের চাইতে টেলিভিশনের সংখ্যা বেশি। ব্রাজিলের অধিকাংশ লোক টিভিকে ফ্রিজের চাইতে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করে। থাইল্যান্ডের লোকজন ফ্যান ক্রয় করার পূর্বে টেলিভিশন ক্রয় করে থাকে। কুয়েতের বাড়ির ছাদগুলোকে অনায়াসে স্যাটেলাইট অ্যান্টেনার সাগর বলে মনে করে। পোল্যান্ডে গত তিন বছরে শতকরা কুড়ি ভাগ বাড়ির ছাদ স্যাটেলাইট অ্যান্টেনা স্থান করে নিয়েছে।

পোল্যান্ডে যখন কম্যুনিজম সরকারের পতন ঘটল তখন শ্রমিক নেতা থেকে নির্বাচিত পোলিশ রাষ্ট্রপতি লেভ ওয়ালেসাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলÑ এই পতনের কারণ কি? ওয়ালেসা তখন তার পাশে রাখা টেলিভিশনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেছিলেনÑ এটার কাজ।

বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জীবন বর্তমানে টেলিভিশনের দুর্দমনীয় প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। টেলিভিশনের এই বিশাল পরিব্যাপ্ত প্রভাবের মূল্যায়ন করতে গিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানী টিমোথি অ্যাশ টেলিভিশন কার্যক্রমকে ‘পরাশক্তি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

ফ্রান্সের লোকজন তাদের কর্মস্থলে যে পরিমাণ সময় অতিবাহিত করে তার চাইতে অধিক সময় কাটায় টেলিভিশনের সামনে। টেলিভিশনের কারণে মানুষের পাঠাভ্যাস আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। যার ফলে মেধাসঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। বহু দেশে সেন্সরবিহীন সংবাদের প্রবল ¯্রােত অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে।

বর্হিবিশ্বের এই প্রবহমান তীব্র ¯্রােতকে রোধ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। এভাবে স্যাটেলাইট টিভি রাষ্ট্রীয় সীমানাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সিএনএন-এর। এখন তার অনেক প্রতিযোগী গজিয়ে উঠেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য জাপান সংবাদ সম্প্রচারের বিশাল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আফ্রিকার জন্য সার্বক্ষণিক টেলি অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা নিয়েছে পাশ্চাত্যের কয়েকটি টিভিকেন্দ্র। এর পেছনে রয়েছে আফ্রিকার জনজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা। এভাবে স্যাটেলাইট টিভির আগ্রাসী ভূমিকায় বিপন্ন হয়েছে মাইক্রোনেশিয়া, পলিনেশিয়ার দ্বীপাঞ্চলের শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রা। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, হাইতির জনজীবন।

রাজনীতিবিদরা স্যাটেলাইট টিভির ব্যাপক এবং ফলপ্রসূ প্রভাব লক্ষ্য করে এটাকে যাবতীয় উপায়ে ব্যবহারের জন্য চেষ্টা করেছেন। নিজেদের ইমেজকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন টিভির মাধ্যমে। ডিপ্লোম্যাসির ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখায় টিভি সম্পর্কে ‘টেলিপ্লোম্যাসি’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে।

স্যাটেলাইট টেলিভিশন এশিয়ার জীবনে এক ব্যাপক পরিবর্তনের বিপ্লব এনেছে। বদলে দিয়েছে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা। নড়বড়ে করে দিয়েছে সনাতন বিশ্বাস। মূল্যবোধকে করেছে বিপন্ন। এ সম্পর্কিত জরিপে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

ভিয়েতনামের হ্যানয়ের কম্যুনিষ্ট পার্টির নীতি নির্ধারকেরা সিএনএন এর সংবাদ দেখে থাকে স্যাটেলাইট অ্যান্টেনার সাহায্যে। এতে জীবনবোধের ওপরে প্রচ- প্রভাব পড়ে। শ্রেণি বৈষম্যের সমাজে এই প্রভাব মারাত্মক পর্যায়ে উপনীত হয়। ধনী শ্রেণির জীবনাচরণ এবং মতাদর্শকে সমাজে গ্রহণযোগ্য স্বাভাবিক আচরণ বলে গণ্য করা হয়। যে সকল দেশে বিত্তহীনেরা সবচাইতে বড় জনগোষ্ঠী তাদের জীবনাচরণ এবং মতাদর্শকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়। অস্বাভাবিক বলে ধারণা করা হয়। পৃথিবীর সকল ধনিক শ্রেণির একই চাল। এর একটা কারণ, ব্যবহৃত সম্পদ, সুবিধাদি ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে অর্থাৎ কাঠামোগতভাবেই সমস্ত পৃথিবীর ধনীদের জীবনযাপন প্রণালি কমবেশি একই ধরনের। ঐ কাঠামোর সাথে আরো ফ্যানটাসি সর্বজনীন ও রঙ মিশিয়ে সেটাকে মানবজীবনের আদর্শ প্রণালি হিসেবে সমস্ত পৃথিবীর মানুষের কাছে তুলে ধরে মিডিয়া।

স্যাটেলাইট টেলিভিশনের বিরতিহীন প্রবাহ-পদ্ধতি-প্রচারণা। অধিপতি শ্রেণি থেকে আসে মিডিয়ার আধিপত্যের কর্তৃত্ব। পশ্চিমা টেলিভিশনের প্রচারণা সামাজিক সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে।

এক সমালোচনায় উল্লেখিত হয়েছে, ‘আফগানিস্তানের যুদ্ধপীড়িত, না খেতে পাওয়া, গরিব ও নিরীহ শত শত বেসামরিক মানুষের ওপরে নির্বিচারে বোমা হামলা করে দেশটাকে তামা-তামা করে ফেলার পক্ষে পৃথিবীজোড়া জনমত গড়ে তুলতে পারা সম্ভব হলো কীভাবে, কোন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায়? তা কি ঐ টেলিভিশন নামক ভীষণ জাদুর বাকসের ভেলকিতে, যার সাথে তাল লয় সঙ্গত করল মুদ্রণ টেলিভিশন?

পশ্চিমা প্রচারণা বলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের ব্যবসায়িক বড়লোক শাসক শ্রেণির কর্পোরেট মিডিয়াকে বোঝানো হয়েছে।

পশ্চিমা প্রচারণা পদ্ধতি অত্যন্ত দক্ষ ও সূক্ষ। সমস্ত পৃথিবীর লোক ঐ পদ্ধতিটাকে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও দায়িত্ববান তথ্য ব্যবস্থা হিসেবে মনে করে। আর সেটাকে গরিব দেশগুলোর জন্য অনুকরণযোগ্য আদর্শ বলে মনে করে। পশ্চিমের ধনিক শ্রেণি তাদের নিজেদের মতো করে নিজেদের সুবিধানুযায়ী তথ্যশাস্ত্র গড়ে তুলেছে। এই শাস্ত্রের মূল্যবোধগুলোকে ইতিহাসের ধ্রুব সত্য বলে গণ্য করা হয়েছে। সাধারণ জনগোষ্ঠীর নিকটে বার্তা ও প্রতীকসমূহ কম্যুনিকেট করার জন্য একটি পদ্ধতি হিসেবে এই ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমটি কাজ করে থাকে। তাদের প্রধান কাজ হলো মানুষকে আমোদ-প্রমোদ-বিনোদন দেয়া। তথ্য জ্ঞাপন করা। তাদের মনের মাঝে এমন সব মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও আচরণবিধিকে প্রোথিত করে দেয়া। যা তাদের বৃহত্তর সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সমগ্রতার মধ্যে সমন্বিত করে। যে পৃথিবীতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত এবং যে জগৎ শ্রেণিস্বার্থের সংঘাতে আকীর্ণ সেখানে মিডিয়ার ঐ রকম ভূমিকা পালন করতে গেলে পদ্ধতিগত প্রচারণার প্রয়োজন হয়।

হংকং-এ বৈদেশিক মুদ্রার শেয়ার বাজারের কর্মকর্তারা কাজের শেষে সিএনএন খুলে ইউরোপ-আমেরিকার শেয়ার মার্কেটের সাম্প্রতিকতম খবর জেনে নেয়। সে সময় গৃহে তাদের সন্তানেরা আমেরিকার মিউজিক চ্যানেল এমটিভিতে পশ্চিম হার্ড মেটালিক রক সঙ্গীতে মত্ত হয়ে থাকে।

পশ্চিমা পুঁজিবাদী সমাজ সর্বব্যাপী ব্যবসামুখী। স্বয়ংক্রিয় ধাঁচের টেকনোলজি নির্ভরতা হচ্ছে এই সমাজের প্রধান চালিকাশক্তি।

স্যাটেলাইট টেলিভিশনের চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠানসমূহ উন্নয়নশীল দেশের দর্শকবৃন্দের কাছে ফ্যানটাসির মোহময় ভুবনকে উপস্থাপিত করে থাকে।

ইন্দোনেশিয়ার ধান উৎপাদক চাষিরা সন্ধেবেলা গ্রামের টিভি সেটের সামনে ভিড় জমায় মার্কিন সোপ অপেরার পরবর্তী পর্ব দেখার জন্য। সিংগাপুর এবং থাইল্যান্ডে ‘হোম বক্স অফিস এশিয়া’ চ্যানেল হলিউডের সাম্প্রতিকতম ছবি দেখাচ্ছে। এশিয়ার বাজার দখল করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে আরো কয়েকটি সংস্থা।

বর্তমানে এশিয়ার সবচাইতে টেলি কোম্পানী ‘স্টার টিভি’ স্যাটেলাইট টেলিভিশনে ১৯৯১ সালে তিনশো মিলিয়ন ডলার মূলধন নিয়ে কাজ শুরু করেছে।

ভিনদেশী স্যাটেলাইট টেলিভিশনের ভয়াবহ আগ্রাসনে এখন আক্রান্ত আমাদের দেশ। স্টার টিভির সিরিয়ালসমূহের দুর্দান্ত জনপ্রিয়তা এখন শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের কাছে মহা আতঙ্ক হয়ে বিরাজ করছে। কারণ এসব অধিকাংশ সিরিয়ালের মূল থিম হচ্ছে অনৈতিকতা। জনপ্রিয় কয়েকটি সিরিয়ালের কাহিনির পরিকল্পক একতা কাপুর। তাকে এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছিল। তার কাহিনিসমূহ মোহজাল বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল বহু পরিবারে। প্রায় আফিমের মতো নেশাসম্পন্ন এ সকল সিরিয়ালের কাহিনি। সূক্ষ কৌশলে এর মাধ্যমে বিজাতীয় অপচেতনা বিস্তারিত হচ্ছে এ দেশে। যাতে পারিবারিক সম্পর্ক বহু ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। নানাবিধ জিজ্ঞাসা ঘনীভূত হচ্ছে অনৈতিক কার্যকলাপের পৃষ্ঠপোষকতায়। এমন কথাও প্রচলিত রয়েছে যে এ সকল সিরিয়ালের ক্ষেত্রে বোম্বের বস্ত্র ব্যবসায়ীরা পুঁজি বিনিয়োগ করে থাকে। সিরিয়ালের মাধ্যমে ফ্যাশন শিল্পের এক চাহিদা সৃষ্টি হয়। সে চাহিদার প্রেক্ষিতে বস্ত্রসম্ভার এ দেশে সরবরাহ করা হয়। খাদ্যাভাস পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। খাদ্যাভাসের সাথে সে দেশের সংস্কৃতি জড়িত।

আমরা ধানসংস্কৃতির দেশ। গাঙ্গেয় অববাহিকার বিশাল বদ্বীপ অঞ্চল হিসেবে আমাদের দেশটি পরিচিত। নবান্ন কেন্দ্রিক আমাদের উৎসব। জলজ সংস্কৃতি আমাদের বৈশিষ্ট্য। সেখানে ভিনদেশী স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ‘পিৎজা সংস্কৃতি’কে বিস্তারিত করেছে। ইতালির কর্সিকাতে প্রথম তৈরি হয়েছিল পিৎজা। যে অঞ্চলটি মাফিয়া সংস্কৃতির জন্য কুখ্যাত। সেই পিৎজা সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের মধ্য দিয়ে এ দেশে অপশক্তি ক্রমাগত পুষ্ট হচ্ছে।

আমাদের এই টিভি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এক ঐতিহ্যকেন্দ্রিক গর্বিত সাংস্কৃতিক চেতনার উত্তরাধিকার।

জাতিসংঘের পঁচিশতম প্রতিষ্ঠা-বার্ষিকী উপলক্ষে সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়ে ছিলেন ময়নামতিতে প্রাপ্ত একটি টেরাকোটা। পোড়ামাটির কারুকাজে খোদিত ছিল নীলপদ্ম ও হাঁস। সেই অনন্য শিল্পকর্মটি জাতিসংঘের দেয়ালে সংস্থাপিত করার সময় মহাসচিব কাফি আনান মন্তব্য করেছিলেন, ‘যে জাতি এমন সময়কালে এটি নির্মাণ করেছিল যখন য়ূরোপ-আমেরিকার অনেক অঞ্চলের অধিবাসীরা বুনো ছাগলের চামড়া পরিধান করে ঘুরে বেড়াত।’

স্যাটেলাইট টিভির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের মেধাবী টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতাদের নবতর সৃজনশীলতায় উদ্ভাসিত হতে হবে। শৈল্পিক, নান্দনিক অনুষ্ঠান নির্মাতারা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই সংগ্রামে অবতীর্ণ হবেন। স্বপ্ন সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলবেন। তাদের নির্মাণশৈলীতে আরোপ করবেন শৃঙ্খলা। এ কথা অনুধাবন করতে হবে যে, জগৎ সংসারের যা কিছু শুভ তাকে সম্ভব করেছে শৃঙ্খলা।

স্যাটেলাইট টেলিভিশনের আগ্রাসনের মতো অনিয়ম এবং অরাজকতাকে বাধা দিতে পারে এই শৃঙ্খলাপদ্ধতি। আমাদের শিল্প সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম নির্যাসকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে।

‘ধানের দেশ গানের দেশ’ বলে পরিচিত এ দেশের লোকায়ত সুরকে সর্বাধুনিক আঙ্গিকে পরিবেশন করতে হবে। য়ূনেস্কো বাংলার মরমী সঙ্গীতকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের দেশেই বর্তমানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর।

এর গুণগত উৎকর্ষতা এবং সাফল্যের কথা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এই ধারার অনুষ্ঠানসমূহ গুরুত্বের সাথে আমাদের দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারের ব্যবস্থা নিতে হবে। ধ্রুপদী সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজক কর্তৃপক্ষ এই প্রস্তাব দিয়েছেন। আমাদের দেশে অতি দ্রুততার সাথে ছড়িয়ে পড়া অপসঙ্গীতের অনুষ্ঠানসমূহের ক্ষতিকারক প্রভাব-এর প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এই প্রচার কার্যক্রম সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এতে ব্যক্তির মনোজগতে উন্মোচিত হবে বিশ্বপট। খোঁজ করতে হবে বিকল্প সংস্কৃতির। সাম্প্রতিক পৃথিবীর বাণিজ্যিক মূল ¯্রােতের বিপরীতে প্রবাহিত হচ্ছে এক বিকল্প সংস্কৃতির ¯্রােত। যেখানে আমাদের দেশে স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা রাখছে পথনাটক। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। এসব ধারা থেকে পরিশীলিত রূপ নিয়ে অনুষ্ঠান নির্মাণ করা যেতে পারে।

আজকের অহং সর্বস্ব, অবক্ষয়ী, বাণিজ্যিক পৃথিবীতে বিকল্প সংস্কৃতির চর্চা ক্রমশ দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। এর পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে টিভি চ্যানেলগুলো।

টেলিভিশন তৈরি করেছে এক ইলেক্ট্রনিক বিশ্ব-গ্রাম। টিভির ছোটপর্দায় বিশ্বকে অবলোকন করা হচ্ছে। মানুষের প্রাত্যহিক রুটিন হয়েছে টিভিতে অস্বাভাবিক ভয় বা অস্বাভাবিক জয় দেখে যাওয়া। সামাজিক জীবন এখন টিভিকে অনুসরণ করে। বিনোদন পরিণত হয়েছে সর্বগ্রাসী ক্ষুধায়। বিনোদন এখন চব্বিশ ঘণ্টার অবসেশন। টেলিভিশন বিপদ দেখায়, যার ফলে নতুন করে নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। উত্তেজনা দেখায়, যার ফলে নিষ্ক্রিয়তা অনুভূত হয়। মিডিয়াকে বিশ্বাস করতে শেখায়। টেলিভিশন অনেক সময় ছদ্মবেশে নিয়ন্ত্রণ করে চিন্তাকে। যেখানে অনভিজ্ঞতাকে অভিজ্ঞতা, অজ্ঞানতাকে জ্ঞান হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে। আমাদের সংস্কৃতি ও শিক্ষা মিডিয়ার ওপর প্রবল আস্থা সৃষ্টি করতে শেখায়। আমরা আত্মোপলব্ধির জন্য মিডিয়ার দ্বারস্থ হই। আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিগুলির জন্যও মিডিয়ার স্বীকৃতি আকাঙ্খা করি। মিডিয়াকে আমরাই ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন রূপে তৈরি করেছি। অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়া দানবে পরিণত হয়েছে।

প্রখ্যাত সাংবাদিক টড গিফলিন বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত একটি ঘটনা (প্রতিষ্ঠান, চিন্তা, নীতি, গতি) মিডিয়ার চৌহদ্দি পেরিয়ে না আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেটি আমাদের কাছে বায়বীয় বাস্তব। আমাদের সারা পৃথিবী ঢেকে আছে মিডিয়ার ত্বকে। একমাত্র যার চৌহদ্দিতেই সুপ্ত রয়েছে সকল স্বীকৃতি। টেলিভিশনের পৃথিবী হয়ে উঠেছে পৃথিবী। অজ্ঞতা এবং নিষ্ক্রিয়তা আমাদের আবদ্ধ রাখে অন্ধ গুহাতে। গুহার অন্ধকার ছেড়ে সূর্যালোকে দৃষ্টি প্রতিস্থাপন করতে ভুলে গেছি। মানুষের দিকে মুখ না ফিরিয়ে তার ছায়াতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে শিখেছি।

স্যাটেলাইট টেলিভিশনের আগ্রাসনের এই বিপন্ন সময়ে আমাদের টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতাদের প্রধান অবলম্বন হবে শুভকর মূল্যবোধ। বিশ্বাস রাখতে হবে এক ভিন্ন জীবনপথের পরিব্রাজক হিসেবে আমরাও ইতিহাস হব।

আমাদের স্বপ্ন, আমাদের দর্শন বেঁচে থাকুক অতীত সুখস্মৃতি হয়ে। মনের গভীরে বীজ হয়ে বেঁচে থাকুক। নতুন আঙ্গিকের টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণ করে আগ্রাসনের সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ অনুসন্ধান করতে হবে। ডিজিটাল ভিডিওতে বহু নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে, ইউটিউবের মাধ্যমে, ক্যাবল টিভির মাধ্যমে এই নব ধারার অনুষ্ঠানকে ছড়িয়ে দিতে হবে।

ডিভি ক্যাম কর্ডারে উন্নতমানের চিত্রায়ন করা সম্ভব হচ্ছে।

পার্টিসিপেটরি ভিডিও নির্মাণ করতে হবে। যা হচ্ছে এক ধরনের চিত্রনাট্যবিহীন ভিডিও প্রডাকশন প্রক্রিয়া। তৃণমূল স্তরের কিছু মানুষের যৌথ পরিচালন প্রক্রিয়া। তাদের ইন্টার অ্যাকশন। এই পদ্ধতিতে মানুষ তার অবরুদ্ধ কণ্ঠস্বরকে নিনাদিত করতে পারে।

আমাদের টিভি অনুষ্ঠানের সৃজনশীল নির্মাতারা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুক যে শূন্য থেকে অবশ্যই উত্তরিত হতে হবে।

মন্তব্য করুন

daraz
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh