• ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
logo

কারবালার মহাবিপ্লবকে বুঝতে হলে জানতে হবে নবী পরিবারকে

আরটিভি অনলাইন ডেস্ক

  ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৯:২৯

কারবালার মহাবিপ্লবকে বুঝতে হলে এর মহানায়ক ও তাঁর সহযোগীদের পরিচয় আর মর্যাদা জানা যেমন জরুরি, তেমনি কারবালায় বাতিল ও মিথ্যার পক্ষের পতাকাধারীদের তথা বনি-উমাইয়াদের নানা কুকীর্তি এবং বিশেষ করে তাদের চরম অনৈতিক, অমানবীক, পাশবিক ও খোদাদ্রোহী চরিত্র সম্পর্কেও সম্যক ধারণা থাকা জরুরি।

আসলে আরবের কোন গোত্রই বনি উমাইয়্যার মত স্বার্থপর ও অহঙ্কারী ছিল না। এ গোত্র বেড়েই উঠেছিল উগ্র স্বভাব, স্বার্থান্বেষী মনোবৃত্তি, বিলাসিতা ও আনন্দ-ফূর্তির কুশিক্ষা নিয়ে। জাহেলী যুগে ও ইসলামি যুগেও এরা ছিল অর্থসম্পদ,শাসন-ক্ষমতা ও পদমর্যাদার কাঙ্গাল। ইসলামের আগমনের পর দীর্ঘ একুশ বছর ধরে এ গোত্রই ছিল ইসলামের প্রধান ও প্রকাশ্য শত্রু এবং ইসলামকে ধ্বংসের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। মক্কা বিজয়ের পর এ গোত্র পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করলে রাসূল (সা.) তাদের ‘তোলাকা’ বা মুক্ত যুদ্ধবন্দী বলে ঘোষণা করেন।

ইসলামের আবির্ভাবের পরও তারা দুনিয়াবি ফায়দা নেই এমন কোন কাজ আত্মনিয়োগ করতে রাজি হত না। ইসলাম তাদের কাছে একটাই অর্থ বহন করত। আর তা হল বনি উমাইয়্যার ওপর মহানবীর (সা.) গোত্র তথা বনি হাশিমের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বিস্তার এবং রাসূলের নবুওয়াতকেও তারা এ দৃষ্টিতেই দেখত। তাই আবু সুফিয়ান হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর বিজয় ও মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তার দেখে হযরত আব্বাস (রা.)-কে বলেছিল : ‘তোমার ভাতিজার রাজত্ব তো বিশাল রূপ ধারণ করেছে!’ তাই প্রথম থেকেই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ছিল এ কর্তৃত্বকে ছিনিয়ে এনে নিজেদের হস্তগত করা।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বনি উমাইয়্যার নেতৃস্থানীয় কোন ব্যক্তিকে কোন প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ করতেন না। কিন্তু রাসূলের ওফাতের পর দামেশ্‌ক বিজিত হলে বনি উমাইয়্যা প্রশাসনিক পদ লাভ করে। দ্বিতীয় খলিফার সময় দীর্ঘ প্রায় দশ বছর মু‘আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান দামেশ্‌কের গভর্নর থাকায় বনি উমাইয়্যা তার মদদ পেত। তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমানের (রা.) বার বছরের শাসনকালে মুআবিয়া আরও স্বাধীনতা পায়। মুহাজির ও আনসারদের ঐকমত্যে খেলাফত যখন হযরত আলী (রা.)-এর হাতে আসে, তখন বনি উমাইয়্যা দীর্ঘদিনের প্রতিহিংসার আগুন প্রজ্বলন করে এবং তৃতীয় খলিফার রক্তের দোহাই দিয়ে ফেতনা ছড়াতে থাকে। এ জন্য তারা প্রথমে আমিরুল মুমিনীন আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পটভূমি রচনা করে। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পবিত্র কোরআনকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে ও কুটচালের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতাকে সরল মুসলমানদের সামনে বৈধ বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় এবং সফলও হয়। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসাবে আলী (রা.)-এর পক্ষ থেকে নিয়োজিত গভর্নর ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী-সাথীদের হত্যার প্রক্রিয়া শুরু করে। যেমন আলী (রা.)'র নিযুক্ত মিশরের গভর্নর মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকরকে একটি মৃত গাধার চামড়ার মধ্যে ঢুকিয়ে ও পুড়িয়ে এবং অপর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী মালিক আশতারকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।

উমাইয়্যা আমলে সাধারণ জনজীবন, বিশেষ করে শাম তথা বৃহত্তর সিরিয়া ও মিশরের জনসাধারণের নৈতিকতার এত বেশি স্খলন হয় যে, বিখ্যাত ঐতিহাসিক মাসউদীর ভাষায়: ‘তারা কোন অসঙ্গত কাজ থেকেই বিরত থাকত না, দীনদারকে কাফের বানাতে তাদের কোনোই দ্বিধা ছিল না।

নবী-বংশ বিরোধী প্রচারণায় সিরিয়রা এতো বেশি ধোঁকা খেয়েছিল যে হযরত আলী (রা.) যখন কুফার গ্রান্ড মসজিদে ঘাতকের হামলার শিকার হন তখন সিরিয়ার জনগণ বিস্মিত হয়েছিল। তাদের অনেকেই তখন বলেছিল, আলী কি নামাজ পড়তো নাকি? সে মসজিদে কিভাবে হামলার শিকার হলো!?

ইমাম হুসাইন (রা.) তৎকালীন জনগণের নৈতিক অধঃপতনের প্রতি ইশারা করেছেন এভাবে :

‘আল্লাহ্‌র কসম! হে জনগণ! যা কিছু উত্তম ও সঙ্গত তা তোমাদের মাঝে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হয়েছে, আর তোমাদের জীবনের শিকড় গেড়েছে সেই লাঞ্ছনার ভূমিতলে।’

অবস্থা এতটা শোচনীয় হয়েছিল যে, যখন উমাইয়্যা শাসনের পতন ঘটে ও আব্বাসীয় খলিফা আবুল আব্বাস সাফফাহ্ শামের ক্ষমতা দখল করে, তখন আবদুল্লাহ্ ইবনে আলী, শাম বাহিনীর নেতৃস্থানীয়দের ধরে সাফফাহ্‌র কাছে নিয়ে যায়। সে সময়ে তারা সবাই কসম করে বলতে থাকে যে, তারা বনি উমাইয়্যা ছাড়া কাউকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)- এর পরিবারের সদস্য তথা তাঁর আহলে বাইত হিসেবে চিনত না!

এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, বনি উমাইয়্যা কীভাবে জনসাধারণের অজ্ঞতা ও মূর্খতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছিল। উমাইয়্যা যুগের দরবারি আলেম ও খতীবরা জনগণকে ইসলামের সঠিক হুকুম-আহকাম ও দীনের দর্শন শিক্ষা না দিয়ে আলী (রা.) এর বিরুদ্ধে অভিশাপ ও গালি দেয়ার বুলি শেখাতেন, ফলে মানুষ এভাবে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে বাদ দিয়ে বনি উমাইয়্যাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আহলে বাইত বলে ভাবত, ও আলীর অনুসারীদের বলত ‘কাফের’ বা‘জিন্দীক’। এ অবস্থা এত দীর্ঘকাল বজায় ছিল যে আবদুল মালেক ইবনে মারোয়ানের শাসনামলে দশ বারো বছরের এক শিশু রাজদরবারে এসে কাঁদতে কাঁদতে নিজের বাবার বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে বলে যে, আমার বাবা এত বড় জালিম যে তিনি আমার নাম রেখেছেন আলী!

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর নবী-পরিবারের সদস্যদের বন্দী হয়ে শামে নীত হবার পর যখন এক বৃদ্ধ অবগত হয় যে, বন্দী হয়ে আসা লোকগুলো রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সন্তান, তখন ওই বৃদ্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। কারণ, তার ধারণাও ছিল না যে, মহানবী (সা.)-এর কোন সন্তান বেঁচে রয়েছেন। হয়ত এ কারণেই ইমাম যায়নুল আবেদীন (রা.) ইয়াজিদের দরবারে ভাষণ দানকালে সর্বপ্রথমে নিজের বংশ-পরিচয় তুলে ধরেছিলেন।

ইমাম হুসাইন (রা.) বেশ কিছু কাল ধরে উমাইয়্যাদের চিন্তাধারার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। প্রায়ই তিনি বিপদ সংকেত দিয়ে বলতেন , ‘নিজের নীরবতার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চাই।’ কেননা, ইমাম জানতেন যে, কোরআন ও ইসলামের টিকে থাকা নির্ভর করছে তাঁর আত্মত্যাগ ও শাহাদাতের ওপর। কারণ, বনি উমাইয়্যা ইসলাম বলতে রাজত্ব ও ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই বুঝেনি। ইয়াজিদ যেমন অন্তরে ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রাখত না, তেমনি বাহ্যিকভাবেও তা মেনে চলত না। কিন্তু ইমাম হুসাইন (রা.) ছিলেন ঈমান ও হাকীকতের বাস্তব প্রতীক এবং দীনের প্রতি গভীর বিশ্বাস তাঁর সমস্ত শিরা-উপশিরায় বেগবান রক্তের মত ঢেউ খেলে যেত।

এমকে

মন্তব্য করুন

daraz
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh