• ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
logo

অন্যরকম ক্যাম্পাসের গল্প

সৈয়দ তাওসিফ মোনাওয়ার

  ১৭ জুন ২০১৭, ১৬:৪৭

ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ক্যাম্পাস। ব্যস্ত ঢাকা শহরের বাইরে ছায়া সুনিবিড় সবুজে ও সুন্দরে সাজানো ব্যতিক্রম ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার পাশাপাশি আড্ডা-গল্পে সময় কাটান। ব্র্যাকের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি সেমিস্টার এখানে থেকে পড়াশোনা করা বাধ্যতামূলক। বছরের তিনটি সেমিস্টারের প্রতিটিতেই পর্যায়ক্রমে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী এখানে আসেন; কেবল পড়াশোনা নয়, ব্যতিক্রমী কিছু সময় উপভোগ করে স্মৃতির খাতায় একগুচ্ছ মধুর মুহূর্তও সঙ্গে নিয়ে ফিরতে হয় এখান থেকে।

যেভাবে শুরু
২০০১ সালে বিবেকবান দেশপ্রেমী প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। উদ্দেশ্য ছিল মানসম্মত শিক্ষা , বিজ্ঞানসম্মত পাঠ্যক্রম পরিচালনা ও শিক্ষার্থীদেরকে নতুন জ্ঞান আহরণে উদ্বুদ্ধ করা। স্যার আবেদ ভাবলেন, দেশে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষায় বেশি জোর দেয়া হলেও জীবনমুখী ও প্রায়োগিক শিক্ষা তেমনটা দেয়া হয়না বললেই চলে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেন নৈতিকবোধসম্পন্ন ও নেতৃত্বদানের গুণাবলী অর্জন করে বেড়ে ওঠে, সেই লক্ষ্যেই ২০০৩ সালে যাত্রা করে সাভার ক্যাম্পাসের আবাসিক সেমিস্টার। এখানে নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদেরকে দীক্ষা দেয়া হয়।

ক্যাম্পাসের আদ্যোপান্ত
ক্যাম্পাসের মূল ফটক দিয়ে ঢোকবার পর চোখে পড়ে শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য নির্মিত দু’টি ডরমেটরি। ছেলেদের জন্য ‘নিকুঞ্জ’, মেয়েদের ‘মালঞ্চ’। সোজা ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে একাডেমিক ভবন ‘অন্বেষা’। ভেতরের ডানপাশের রাস্তা ধরে হাঁটলে চোখে পড়ে ‘সঞ্জীবন’, ‘সূর্যোদয়’, খাবার ঘর তৃপ্তি, কস্তুরি, সুরভী, সুগন্ধা, তুষ্টি ইত্যাদি। ক্যাম্পাসের মাঝখানে মধ্যমণি সবচেয়ে পুরনো একাডেমিক ভবন ‘শাল্লা’। ক্যাম্পাসের পশ্চিমে বিস্তৃত খেলার মাঠ, দুর্বার ও দূরন্ত। একপাশে আছে আনন্দপুর, যেখানে শিক্ষার্থীরা ইনডোর গেমসের পাশাপাশি গল্পে-গানে সানন্দে আড্ডা দিতে পারেন। প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার জন্য আছে মেডিকেল সেন্টার রূপান্তর। আছে ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি।
শিক্ষক, কর্মকর্তা, চিকিৎসক, কর্মচারি, সেবাকর্মীসহ সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসে কাজ করছেন প্রায় দেড়শো জন।

মানবিকতার সুখপাঠ
শিক্ষার্থীদের এই আবাসিক সেমিস্টারে তিনটি বিষয় পড়ানো হয়। বাংলাদেশ স্টাডিজ, এথিক্স অ্যান্ড কালচার এবং ইংরেজি। সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের নানা গল্প, দেশ ও সমাজের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা দিতে সাজানো হয়েছে বাংলাদেশ স্টাডিজ কোর্সটি। এই বিষয়ের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদেরকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, লালবাগ কেল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়। একদিন শশাঙ্ক’র শাসন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনাবলী নাটক আকারে প্রদর্শন করেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া তৃণমূল পর্যায়ের গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা, সংগ্রাম সরাসরি দেখানো হয় শিক্ষার্থীদেরকে। পরবর্তীতে এ সম্বন্ধে গবেষণা করে তা উপস্থাপন করেন শিক্ষার্থীরা। এথিক্স এন্ড কালচারে শেখানো হয় মানবিকতা ও নীতিনৈতিকতার নানা বিষয়। বিভিন্ন দার্শনিকের জীবনী তুলে ধরে দেয়া হয় মানুষের কল্যাণে কাজ করার অনুপ্রেরণা। এই বিষয়ের অধীনে শিক্ষার্থীরা সোশ্যাল লার্নিং ল্যাব নামে আরেকটি কার্যক্রমে অংশ নেন, যেখানে একদিনের জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কেউ বাগানের মালী, কেউ পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কেউ নিরাপত্তাকর্মী, কেউবা সেবাকর্মীদের দায়িত্ব পালন করেন। আর বাংলা ভাষা চর্চার পাশাপাশি বৈশ্বিক পরিবর্তনে খাপ খাওয়ানোর জন্য রয়েছে ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় বিশেষ জোর। নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে সচেতনতামূলক নানা সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম। প্রতিদিনের কার্যক্রম শুরু হয় সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে।

শিক্ষার্থীদের নানা কার্যক্রম
পড়ালেখার পাশাপাশি নিয়মিত চলছে সহ-শিক্ষা কার্যক্রম। সৃজনশীল লেখা, দাবা খেলা, বিতর্ক, সাধারণ জ্ঞান, আবৃত্তি ও উপস্থাপনা, শরীরচর্চাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদেরকে সম্পৃক্ত করে দেয়া হচ্ছে সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ। ক্যাম্পাসের এক কর্মকর্তা বকুল হোসেন বললেন, এখানে শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে নানা কাজ করেন। এতে একে অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করা ও গুরুত্ব দেয়া শিখতে পারছেন। আর আবাসিক সেমিস্টারে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী একইসঙ্গে মিলেমিশে থাকার ফলে তৈরি হচ্ছে পারস্পরিক সহমর্মিতা।

ছবি: ফারহান জামান অর্ণব

স্বপ্নপূরণের পথে যাত্রা
দেখা পাওয়া গেল স্থাপত্য বিভাগের ক’জন শিক্ষার্থীর। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, ক্লাস শেষ করে বেরিয়েছেন তারা। বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছেন। কথা হল বিভাগটির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফেরদৌস বিন মাসুদের সাথে। তিনি বলেন, “আমরা দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ। এই ক্যাম্পাসে আমাদেরকে সেই শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। এখানে এসে আমরা নিত্যনতুন নানা বিষয়ে শিখতে পারছি, যা আমাদের জীবনের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে ও স্বপ্নপূরণে এগিয়ে নেবে। এছাড়া এখানে আড্ডা-গল্পে কাটানো মুহূর্তগুলো আমাদের স্মৃতি হয়ে থাকবে।”

নৈতিক শিক্ষায় বিশেষ জোর
ক্যাম্পাস সুপারিন্টেন্ডেন্ট রেহান আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাভার ক্যাম্পাস অনন্যসাধারণ । প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী এই ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করেছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই ক্যাম্পাসের আবাসিক সেমিস্টারের মাধ্যমে আমরা আলোকিত প্রজন্ম গড়বার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এখানে নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় বিশেষ জোর দিচ্ছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ, নীতিতে অবিচল ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার স্বপ্ন আমাদের। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদেরকে আরো বেশি সামাজিক ও কল্যাণমুখী কাজে সম্পৃক্ত করার জন্য চেষ্টা করে যাব আমরা।”

এপি

মন্তব্য করুন

daraz
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh