• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

৩০০ কোটি বছর আগের ঢেউ পৃথিবীতে আসলো গেলো ৪ জানুয়ারি

আরটিভি অনলাইন ডেস্ক

  ০৫ জুন ২০১৭, ১৭:৫৫

আলোর গতিতে ছুটলে প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগেকার ঘটনা। যা টের পাওয়া গেল এই সে দিন! চার মাস আগে।

বিশাল বড় একটা ‘পুকুরে’র মাঝখানে কেউ খুব বড় একটা ‘ঢিল’ ফেলেছিল সেই কবে, আলোর গতিতে ছুটলে প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে! আর বড় পুকুরের মাঝখানটায় ঢিল ফেললে যা হয়, সেই ‘ঢেউ’টা ছড়াতে ছড়াতে পৃথিবীতে পৌঁছল এই সে দিন। এ বছর জানুয়ারির ৪ তারিখে। ভারতীয় সময় বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ। আরও ঠিকঠাক ভাবে বললে, বিকেল ৩ টে ৪২ মিনিটে।

পুকুরটা আমাদের ব্রহ্মাণ্ড। আর ঢিলটা দু’টো ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে ভয়ঙ্কর একটা সংঘর্ষ। এই ব্রহ্মাণ্ডে যে অত ভয়ঙ্কর একটা সংঘর্ষ হয়েছিল দু’-দু’টো রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলের মধ্যে, তা জানতে লেগে গেল আমাদের ৩০০ কোটি বছর! তা কি আদৌ জানতে পারতাম কোনও দিন, যদি না তার ‘ঢেউ’টা এসে ভিড়তো এই পৃথিবীর ‘ঘাটে’! পুকুরে যেটা ঢেউ, আদিগন্ত, অতলান্ত ব্রহ্মাণ্ডে সেটাই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ। যা অনেক দূরের, বহু বহু কোটি বছরের পুরনো খবরাখবর বয়ে নিয়ে আসে। বার্তা বয়ে বেড়ায় ব্রহ্মাণ্ডের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। পৃথিবীর ‘ঘাটে’ তা যে দিন ভিড়েছিল, ২০১৭-র ৪ জানুয়ারি, তা দিয়েই করা হয়েছে তার নামকরণ। ‘গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ’ শব্দ দু’টির আদ্যক্ষর ‘G’ আর ‘W’-র সঙ্গে ৪ জানুয়ারি তারিখটাকে জুড়ে নাম দেওয়া হয়েছে- ‘GW170104’। এই আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্স’-এ।

ব্রহ্মাণ্ডে যে এমন ‘ঢেউ’ আছে, ঠিক এক শতাব্দী আগে, তার খবরটা আমাদের দিয়েছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে। ‘ঢেউ’ তার অনেক পরে এসে আছড়ে পড়েছে পৃথিবীর ‘ঘাটে’! তাই পূর্বাভাস মিলিয়ে দিয়ে সন্দেহ, সংশয়ের পরীক্ষায় আরও এক বার পাশ করে গেলেন আইনস্টাইন। ২০১৫ সাল থেকে এই নিয়ে তিন বার। আমেরিকার দু’টি জায়গা- ওয়াশিংটনের হ্যানফোর্ড আর লুইজিয়ানার লিভিংস্টোনে বসানো ‘লাইগো’ ডিটেক্টরের চোখে ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ (লাইট ইয়ার্স) পর ধরা দিয়ে ওই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ জানিয়ে দিল, হ্যাঁ, অত দিন আগে একটা ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ হয়েছিল এই ব্রহ্মাণ্ডে। আর তা হয়েছিল দু’টো রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলের মধ্যে। তার পর তারা বিলীন হয়ে গিয়ে আরও বড় একটা ব্ল্যাক হোলের জন্ম দিয়েছিল। এর আগে প্রথম দু’বার রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোল জোড়াদের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের টের পেয়েছিলাম আমরা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর আর ডিসেম্বরে। তবে আগের দু’বার তরঙ্গটা পেয়েছিলাম ব্রহ্মাণ্ডের যে-দূরত্বে ব্ল্যাক হোল জোড়াদের সংঘর্ষের জেরে, এ বারের তরঙ্গটা এসেছে তার দ্বিগুণ দূরত্ব থেকে। যার মানে, বিগ ব্যাং-এর সময়ের আরও অনেকটা কাছাকাছি ওই সংঘর্ষের ঘটনাটা ঘটেছিল ব্রহ্মাণ্ডে।

ব্রহ্মাণ্ডে ছড়াতে ছড়াতে এ বার যেটা আমাদের নাগালে পৌঁছেছে, সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গটা পৃথিবীর ‘ঘাটে’ পৌঁছনোর পর বিজ্ঞানীদের চোখে পড়েছিল আরও একটা অদ্ভুত ঘটনা। ভয়ঙ্কর শক্তিশালী একটা আলোর ঝলসানি। যা থেকে সন্দেহ ইতিউতি উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছিল, ওই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আর সেই শক্তিশালী আলোর ঝলসানিটা বোধহয় কোনও একই ঘটনার ফলাফল! হয়তো একটার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যোগসাজশ রয়েছে অন্যটির।

কিন্তু সেটা যে ভুল, সবই ভুল, তা জানিয়ে গোটা বিশ্বের সংশয় কাটিয়ে দিল কে জানেন?

মহাকাশে ভারতের ‘সচিন তেন্ডুলকর’, ইসরোর পাঠানো গর্বের উপগ্রহ ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’। জানিয়ে দিল, ওই আলোর ঝলসানিটা আদতে গামা রে’ বার্স্ট (জিআরবি)। যার সঙ্গে পৃথিবীর ‘ঘাটে’ এসে পৌঁছনো মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কোনও সম্পর্ক নেই। ওই আলোর ঝলসানিচা আসছে একেবারেই অন্য কোনও জায়গা থেকে। অন্য কোনও মহাজাগতিক ঘটনার জেরে। ফলে, এই আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে গেল ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর নামও। ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর যাবতীয় সায়েন্স অপারেশনের প্রধান পুণের ‘আয়ুকা’র জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘লাইগোর দু’টি ডিটেক্টরের পাওয়া তথ্যের সঙ্গে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর পাওয়া সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি দেওয়া-নেওয়া করার জন্য একটি ‘মউ’ রয়েছে। এই দেওয়া-নেওয়ার কাজটা আগামী দিনেও চলবে।’’

তবে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭, এই সময়ে আইনস্টাইনকে তিন তিন বার পরীক্ষায় পাশ করালো যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, তা একই সঙ্গে যেমন ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস, ভবিষ্যত জানার জন্য আমাদের সামনে সম্পূর্ণ নতুন একটা জানলা (উইন্ডো) খুলে দিল, তেমনই তুলে দিল কিছু প্রশ্নও। আগামী দিনে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে যে আরও কঠিন পরীক্ষায় বসতে হবে, তার সম্ভাবনাকে আরও সুনিশ্চিত করে দিল। সেগুলি কী কী, এ বার একটা একটা করে বলা যাক।

এত দিন আলোকতরঙ্গকে (দৃশ্যমান, অতিবেগুনি ও ইনফ্রারেড, এদেরই মধ্যে পড়ে এক্স-রে ও গামা রে) ‘হাতিয়ার’ করেই ব্রহ্মাণ্ডের অজানা, অচেনা বস্তু খুঁজে বেড়াতাম আমরা। কোন উৎস থেকে সেই আলো বেরিয়ে আসছে, তারই পথ ধরে খুঁজে নিতাম তা ব্রহ্মাণ্ডের ঠিক কতটা দূরত্বে ঘটছে, বিগ ব্যাং-এর ঠিক কত দিন পর সেই সব ঘটনা ঘটেছিল ব্রহ্মাণ্ডে। কিন্তু ব্ল্যাক হোল বা নিউট্রন নক্ষত্রের মতো মহাজাগতিক বস্তুগুলি কবে, কখন তৈরি হয়েছে, কত কোটি বছর আগে তাদের শরীর কী ভাবে গড়ে উঠেছিল, তার কিছুই আমরা খুব সঠিক ভাবে বলতে পারতাম না। কারণ, অসম্ভব জোরালো অভিকর্ষ বলের জন্য ব্ল্যাক হোল থেকে তেমন ভাবে কোনও আলোই বেরিয়ে আসে না। যেটুকু আলো বেরিয়ে আসে, তা আসে ব্ল্যাক হোলের অ্যাক্রিশন ডিস্ক থেকে। আমরা যেমন থালার কানায়, কোণায় এঁটোকাঁটা ফেলে রাখি, সব কিছু গিলে খাওয়ার পর, তেমনই কিছু ‘এঁটোকাঁটা’ ওই অ্যাক্রিশন ডিস্কে ফেলে, ছড়িয়ে রাখে ব্ল্যাক হোল। তাদের থেকে বেরিয়ে আসে আলোকতরঙ্গ। তারই সূত্র ধরে মেলে ব্ল্যাক হোলের হদিশ।

এ বার আমাদের হাতে এল ব্রহ্মাণ্ডে নতুন নতুন বস্তু খুঁজে বের করার নতুন ‘হাতিয়ার’। যার নাম- মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। যা দু’টো ব্ল্যাক হোল বা একটা ব্ল্যাক হোলের সঙ্গে একটা নিউট্রন নক্ষত্র বা দু’টো নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে তৈরি হয়। সেই সংঘর্ষের ‘ঢেউ’ (মহাকর্ষীয় তরঙ্গ) পৃথিবীতে এসে পৌঁছলেই আমরা জানতে পারব, ঠিক কোথায় সেটা ঘটেছে বা ঠিক কত কোটি বছর আগে সেটা ঘটেছে। তিন তিন বার যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলির হদিস পেয়েছি আমরা, সেগুলি এই ভাবেই আমাদের ব্ল্যাক হোলগুলি কোথায় রয়েছে, কত দিন আগে তারা আরেকটি ব্ল্যাক হোলের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটিয়েছে, তার খবর বয়ে নিয়ে এসেছে আমাদের কাছে। হালের খবরটা এসে পৌঁছল ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্ব থেকে। ফলে, ব্রহ্মাণ্ড-তল্লাশে এ বার নতুন ‘হাতিয়ার’ হয়ে উঠল মহাকর্ষীয় তরঙ্গ।

পুণের ‘আয়ুকা’র জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জিত মিত্র বলছেন, ‘‘আমাদের জোরালো আশা, ওই সংঘর্ষগুলি থেকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পাশাপাশি আলোর মতো তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গেরও (ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক কাউন্টারপার্ট) হদিশ আমরা পাব। যা আমরা এখনও পাইনি। তা হলে কি ওই সব ব্ল্যাক হোলের অ্যাক্রিশন ডিস্ক নেই? তাই কি সেখান থেকে আলোর মতো কোনও তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ বেরিয়ে আসতে পারছে না? মনে হচ্ছে যে, ভাত খেয়ে যেখানে এঁটোকাঁটা ফেলে ব্ল্যাকহোলগুলো সেই এঁটোকাঁটাও শেষ মুহূর্তে তারা খেয়ে নিচ্ছে!’’

নৈনিতালের আর্যভট্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট অফ অবজারভেশনাল সায়েন্স (অ্যারিজ)-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এ বার আরও একটা জিনিস দেখে অবাক হয়ে গিয়েছেন গবেষকরা। দেখা গিয়েছে, সংঘর্ষের ঠিক আগের মুহূর্তে খুব কাছে এসে যাওয়া দু’টি ব্ল্যাক হোলের একটির স্পিন অ্যাঙ্গুলার মোমেন্টাম বা ঘূর্ণির কৌণিক ভরবেগের দিক আর দু’টো ব্ল্যাক হোল কাছাকাছি এসে যাওয়ার পর যে সিস্টেমটা তৈরি হল, তাদের কৌণিক ভরবেগের দিকগুলো একে অপরের সঙ্গে মিলছে না। এর কারণটা কী, এখনও তা বুঝে ওঠা যায়নি।’’

ওই সংঘর্ষগুলি থেকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ‘কাউন্টারপার্ট’ তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গটিকে খুঁজে বের করতেই এখন বেশি উৎসাহী বিজ্ঞানীরা। পুণের ‘আয়ুকা’র জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক সুকান্ত বোসের বলছেন, ‘‘আমার আশা, এ বার দু’টো নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে তৈরি হওয়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গেরও হদিশ পাব আমরা। আর হয়তো সেখানেই খুঁজে পাব মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ‘কাউন্টারপার্ট’ তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গটিকেও।’’

সেই তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গটাকে যে খুঁজে পাওয়াটা খুব জরুরি, তা স্বীকার করে নিয়েছেন কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স’-এর অধ্যাপক সৌমিত্র সেনগুপ্তও।

সৌমিত্রবাবুও জানিয়েছেন, সামনের দিনগুলি আরও কঠিন আইনস্টাইনের জন্য। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের জন্য। কারণ, ব্ল্যাক হোলের একেবারে কাছে, ভীষণ জোরালো অভিকর্ষ বলের (স্ট্রং গ্র্যাভিটি) জন্য যেখানে ব্রহ্মাণ্ডের স্পেস-টাইম ভয়ঙ্কর ভাবে বেঁকেচুরে যায়, সেখানেও তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ খাটে কি না, এ বার সেই ভীষণ কঠিন পরীক্ষায় বসার সময় হয়ে গিয়েছে আইনস্টাইনের। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের।

আনন্দ বাজার থেকে নেয়া

এমকে

মন্তব্য করুন

daraz
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh