• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

নায়িকা থেকে আম্মা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, আরটিভি অনলাইন

  ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১১:০৫

সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে চিরবিদায় নেন ভারতের তামিলনাড়ু অঙ্গরাজ্যের ছ’বারের মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা। সোমবার মাঝরাতে তার মৃত্যুর কথা ঘোষণা করে চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতাল। আড়াই মাস ধরে সেখানেই ভর্তি ছিলেন ৬৮ বছর বয়সী তামিলের আম্মা। গেলো ২২ সেপ্টেম্বর জ্বর ও ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে পুরো তামিলনাড়ুজুড়ে। কান্নার রোল পড়েছে ঘরে ঘরে।

সাফল্যে-ব্যর্থতায়, উত্থানে-পতনে, সুখে-দুঃখের মধ্যে নিজেকে শীর্ষে নিয়ে যেতে পারাটা সহজ কথা নয়। ১৯৮১ সালে রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে ২০১৬ সালে শেষ অসুস্থতা পর্যন্ত তিনি দাপটের সঙ্গে রাজ্যকে পরিচালনা করেছেন, পাশাপাশি বিতর্কও ছিল তার প্রাত্যহিক সঙ্গী। জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা থেকে জনপ্রিয় নেত্রী হয়ে ওঠার পেছনে অবশ্য ছিল রাজ্যের জনগণই।

রাজ্যজুড়ে পুজোপাটের মেলা। জয়ললিতা তো কেবল নেত্রী নন, শুধু আড়াই দশকের অনেকটা জুড়ে মুখ্যমন্ত্রী নন, তিনি গোটা তামিলনাড়ুর ‘আম্মা’। তামিলরা তাকে পূজা করেন দেবী রূপে, ‘অধিপরাশক্তি’ নামে। নামটা অবশ্য ১৯৭১ সালে জয়ললিতারই অভিনীত একটি তামিল চলচ্চিত্র থেকে নেয়া। তাতে কী, সে দিনের ‘দেবী’ অভিনেত্রী যে আজ জনগণের ‘মা’, তা কি কাকতালীয় হতে পারে? আসলে বিশ্বাসে মিলায় ভক্তি। আর এই ভক্তির জোয়ারে রাজনীতির অর্থই যায় পাল্টে।

১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মাইসোরের মেলুকোটে তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয় জয়ললিতার। বাবা জয়রমন এবং মা ভেদাভাল্লি। ১৯৬১ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন জয়া। ‘এপিস্টল’ নামে একটি ইংরেজি ছবিতে প্রথম শুটিং শুরু করেন। এরপর কন্নড় ও হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেন। ১৯৬৪ সালে কন্নড় ছবি ‘চিন্নাদা গোম্বে’ তে প্রথম মুখ্যচরিত্রে তার আত্মপ্রকাশ। ১৯৬৫ সালে তামিল ছবি ‘ভেন্নিরা আদাই’ তে প্রথম মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন জয়ললিতা। একই বছরে তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে জয়ললিতার রাজনৈতিক গুরু এমজি রামচন্দ্রনের বিপরীতে প্রথম অভিনয় করেন। এরপর জয়ললিতা-রামচন্দ্রনের দু’যুগের রঙিন সম্পর্কের সূচনা হয়।

১৯৭৩ সালে একসঙ্গে ২৮টি ছবিতে অভিনয় করার পরে পার্টি কর্মীদের চাপে এমজিআর জয়ললিতার সঙ্গে অভিনয় করা বন্ধ করে দেন। ১৯৮০ সালে ৩শ’র বেশি ছবিতে অভিনয় করার পরে জয়ললিতা নিজেকে সিনেমার জগৎ থেকে সরিয়ে নেন। ১৯৮২ সালে রাজনীতির জগতে প্রবেশ করেন। এম জি রামচন্দ্রনের এইআইডিএমকে পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালে এইআইডিএমকে’র প্রচারসচিব হিসেবে নিযুক্ত হন।

অনেকেই বলেন এমজিআর’র ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবে জয়ললিতার রাজনীতিতে আবির্ভাব। এমজিআর’র মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী জানকী রামচন্দ্রনকে সরিয়ে এআইএডিএমকে দলের প্রধান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন আম্মা। রাজনীতির সুতো টানাটানি করলেও বিরাট ব্যক্তিগত ক্যারিসমা ছাড়া তিনি এমন নেত্রী তৈরি হতেন না। প্রথম থেকেই তার রাজনীতি সংগ্রাম-কণ্টকিত। ভক্তির ক্যারিসমায় ভর না করলে এ সুদীর্ঘ সংগ্রাম তিনি পার হতে পারতেন কি? ভারতীয় রাজনীতিতে বড় নেত্রীরা বেশির ভাগই উঠে এসেছেন কোনো না কোনো বড় নেতার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে। জয়ললিতার উত্থান কিন্তু পুরোটা সেই ছকে পড়ে না। এমজিআর প্রথমে তাকে মঞ্চে জায়গা দিলেও নেত্রী হিসেবে তার আসল উত্থান বহু কাঠকয়লা পার করেই। ভারতে, বিশেষত দক্ষিণ ভারতের মতো সমাজে পুরুষতন্ত্রের শক্ত দুর্গে ফাটল ধরাতে ভক্তিবাদ ছাড়া নিশ্চয়ই তার অন্যপথ খোলা ছিল না।

লবণের প্যাকেট থেকে শুরু করে ক্যান্টিনের দরজা, মিনারেল ওয়াটার থেকে চব্বিশ ঘণ্টা কল সেন্টার, সবকিছুতেই যেন আম্মা। যদিও ফোন বা এসএমএস’র ওপারে থাকতেন না জয়ললিতা। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেন যে তিনি আছেন, থাকবেন, এর সাহায্যে তারা আম্মার কাছেই পৌঁছাচ্ছেন। জনতার কাছে নিজেকে মেলে ধরতে তিনি প্রথম থেকেই সফল। আর সেই শক্তি নিয়েই তিনি শাসন করে গেছেন যুগের পর যুগ।

দুর্নীতির বিশাল অভিযোগ মাথায় নিয়ে সঙ্কটসাগর পার হতেও সেই ভক্তির ভেলা সাহায্য করেছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে অতিরিক্ত সম্পদ আহরণের অভিযোগে তাকে বন্দি করা হয়। তবু আম্মার জনপ্রিয়তায় এতটুকু টোল পড়েনি। জনতার মত, দেবীদের তো ধনসম্পদ থাকবেই! তাই বেশিদিন তাকে আটকে রাখা যায়নি। ২২ দিন কারাবাসের পর সুপ্রিম কোর্টে জামিন পেয়ে ছাড়া পান। যখন জয়ললিতা বাড়ি ফিরছিলেন, তখন বাজি-আলো-উল্লাস আর উৎসবে মেতে ওঠে জনতা; যেন সোজা স্বর্গ থেকে নামলেন তাদের দেবী!

তামিলনাড়ুর এই মুখ্যমন্ত্রী ক্রমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও ছিল। জয়ললিতাই একমাত্র সাম্প্রতিক নেত্রী, যাকে ঘিরে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রিত্বের জল্পনা-কল্পনা হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও তৃতীয় ফ্রন্টের রাজনীতিতে তিনি অন্যতম প্রধান চরিত্র। তাকে ঘিরে যতোই ফিসফাস গুঞ্জন থাকুক, তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে কেউই বেশি চর্চা করেন না। রাজনীতির সঙ্গে সেই জীবনের ঘনিষ্ঠ যোগ থাকলেও না। সব ছেড়ে থেবর সম্প্রদায় থেকেই বহুদিনের সঙ্গিনী শশিকলার ভ্রাতুষ্পুত্রকে দত্তক নেন আম্মা। তবে অনেকেই বলেন, এটার পেছনে আম্মার স্বার্থ রয়েছে। মূলত ব্রাহ্মণসন্তান হয়েও অব্রাহ্মণ জাতগুলোকে নিজের ভোটব্যাংক করার জন্যই তিনি এ কাজ করেছেন!

তাকে ঘিরে প্রশ্ন রয়েছে অনেক। কিন্তু প্রতিকূল শক্তির সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে ধরে রাখা যে কতটা কঠিন, তা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছেন জয়ললিতা। অনেক আক্রমণ, অনেক কুৎসার বিরুদ্ধেও লড়েছেন। তিনি তার রাজনৈতিক চেতনা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে সেই লড়াইটা জিতেছেন। নারী রাজনীতিক হিসেবে ইতিহাসে এটা হয়ে থাকবে তার উজ্জ্বল অবস্থান।

এস

মন্তব্য করুন

daraz
  • আন্তর্জাতিক এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh