• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
logo

আমরা তোমাদের গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবো: মিয়ানমার সেনা কমান্ডার

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ১৪ মে ২০১৮, ২৩:০৪

মিয়ানমারে গত বছরের আগস্টে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের প্রেক্ষিতে লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত লাগোয়া দেশ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। মার্কিন পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের আলোকে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নির্মমতার কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো:

গেলো বছরের আগস্টের শেষদিকে এক রোববার দুপুরের দিকে আহাম্মেদ হোসেন চুট পিন গ্রামে ঝোপ এবং কাঁটায় ঢাকা একটি পুকুরে চার ঘণ্টার জন্য লুকিয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, আমি বন্দুকের গুলি, পুরুষ, নারী ও শিশুদের কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তারা মিয়ানমারের ৩৩ লাইন ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের প্রাণঘাতী বাহিনীর সদস্যদের হাত থেকে পালানোর চেষ্টা করছিলেন।

হোসেন বলেন, ওইদিন গ্রামের চার ভাগের এক রোহিঙ্গা মুসলিম অর্থাৎ সাড়ে তিনশ’র বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গেলো বছর রোহিঙ্গাদের ওপর অভিযান শুরু হওয়ার পর এটি ছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘটিত অন্যতম বড় একটি গণহত্যার ঘটনা। ওই সেনা অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। যেটিকে সাম্প্রতিক সময়ের কুখ্যাত জাতিগত হত্যার সঙ্গে তুলনা করা হয়। যেমনটা করা হয়েছিল কসোভোয় আলবেনীয় এবং ইরাকে কুর্দিদের সঙ্গে।

গুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গ্রামের প্রধান ২৫ বছর বয়সী হোসেন তার লুকিয়ে থাকার স্থান থেকে বেরিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে যান। কয়েক ঘণ্টা আগে হোসেন মুরগি ও সবজি দিয়ে তার স্ত্রী ও তাদের দুই বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে সকালের নাস্তা সারেন। মাত্র তিন সপ্তাহ আগে বিয়ে হওয়া তার ছোট বোনের বাড়িও গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যখন হোসেন পেছনে পুড়তে থাকা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি জানেন না যে তারা বেঁচে আছেন কিনা।

আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর সাত লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইনে ওই অভিযানে কয়েক ডজন গ্রাম ধ্বংস করা হয়। কয়েকটি জায়গা ২৭ আগস্ট চুট পিন গ্রামে যা ঘটেছে প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটে।

পরে মিয়ানমার সরকার চুট পিন ও তার আশপাশের গ্রামে প্রবেশাধিকার সীমিত করে দেয়। তারা সাহায্যকর্মী, জাতিসংঘের তদন্তকারী দল বা পশ্চিমা সাংবাদিকদেরও ওই এলাকায় মুক্তভাবে ঘোরাফেরার অনুমতি দেয়নি।

দুই ডজনের বেশি রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বৌদ্ধদের সঙ্গে কথা বলে চুট পিন গ্রামে গণহত্যার আসল চিত্রটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, নিউ ইয়র্কভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থার ফিজিশিয়ানদের চালানো জরিপ ও ভিকটিমদের গুলির ক্ষতের ফরেনসিক বিশ্লেষণের সঙ্গে ওই সাক্ষাৎকারদাতাদের কথা মিলে যাচ্ছে।

চুট পিন গ্রামে হত্যার পরিমাণ ও ধরন বিবেচনায় নিয়ে মানবাধিকার সংস্থার ফিজিশিয়ানরা বলছেন, এটিকে আন্তর্জাতিক তদন্তের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। গেলো এপ্রিলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একজন কৌঁসুলি রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের ঘটনাকে সম্ভাব্য মানবতাবিরোধী অপরাধ বিবেচনায় তদন্ত শুরু করতে একটি আর্জি দায়ের করেছেন। মিয়ানমারের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র।

মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা রোহিঙ্গা জঙ্গিদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছিলেন এবং চুট পিনে বেসামরিক ব্যক্তির ওপর নৃশংসতার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কর্তৃপক্ষর উল্টো অভিযোগ যে রোহিঙ্গা মুসলিমরা নিজেরাই নিজেদের বাড়ি পুড়িয়েছেন। এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী জানায়, নিরাপত্তা বাহিনী ‘কোনো নিপীড়ন চালায়নি’।

রাখাইন রাজ্য সরকারের মুখপাত্র টিন মং সোয়ে বলেছেন, ওইদিন চুট পিন গ্রামে ১০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়নি এবং কোনো ধর্ষণ বা চুরির ঘটনা ঘটেনি।

চুট পিনের রোহিঙ্গা নেতা হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে থাকা তার সাবেক গ্রামবাসীদের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ কথা বলে হিসাব করে দেখেছেন ২৭ আগস্ট ৩৫৮ রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। আরও ৫৭ জনের মতো মানুষকে বন্দুকের নলে মুখে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এরপর থেকে আর দেখা যায়নি। তিনি বলেন, ওইদিন কমপক্ষে ১৯ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়।

তাদেরই একজন ধর্ষিতা নারী হলেন ২০ বছর বয়সী হাসিনা বেগম। একটি স্কুল ভর্তি নারী যাদের হাত-পা বাঁধা ছিল, তারা নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত হয়। তিনি বলেন, আমি দুই মাস বয়সী শিশুকে আমার শাশুড়ির কাছে রেখে আসি। আর মনে মনে দোয়া করি যেন তারা বেঁচে থাকেন।

সতর্কতা

আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে ৩৩ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সেনারা ওই এলাকায় পৌঁছায়। গেলো বছর এক রিপোর্টে এই সেনা ইউনিটের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের অভিযোগ তোলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। রাখাইন রাজ্যে অপরাধ তদন্তে জাতিসংঘ ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের চেয়ারম্যান মারজুকি দারুসম্যান বলেছেন, লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনগুলো বিশেষ করে ৩৩ ইউনিটকে ‘যথেচ্ছভাবে হত্যা ও নির্যাতনের’ জন্য স্পটলাইটে রাখতে হবে।

চুট পিন গ্রামের বৌদ্ধ অধ্যুষিত অংশে ঘাঁটি বানায় কয়েক ডজন সেনাসদস্য। একসময় এই গ্রামের মুসলমান ও বৌদ্ধরা একসঙ্গে কাজ করেছে, খেলেছে ফুটবল। তবে সেনাসদস্যরা একটি পুলিশ স্টেশন, মঠ ও কয়েকটি ভবনে অবস্থান নেয়।

হোসেন বলেন, বৈঠকের জন্য চুট পিন গ্রামের স্কুলে স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতাদের ২২ আগস্ট ডেকে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, ৩৩ ডিভিশনের আঞ্চলিক কমান্ডার অং মিও থু তাদের বলেন যদি তার আদেশ অমান্য করা হয় তাহলে তাদের গ্রাম ধ্বংস করে দেয়া হবে।

পার্শ্ববর্তী একটি শহরের রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ জানান ওই কমান্ডার তাদের বলেন, আমরা তোমাদের গ্রামকে মাটিতে পরিণত করবো।

হোসেন বলেন, মিয়ানমারের আরও দুটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কথা উল্লেখ করে ওই কমান্ডার বলেন, তোমরা হয়তো কাচিন বা কারেনদের কথা শুনেছো? হত্যা আমাদের কাছে কোনো বিষয়ই না। তাই আমরা যা বলি তা না করলে তোমাদেরও হত্যা করবো।

ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড জারির ব্যাপারে সরকারের একটি পরিকল্পনার সঙ্গে সহযোগিতা করারও আহ্বান জানান ওই কমান্ডার। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বলছে, নাগরিকত্ব পাওয়ার আগে রোহিঙ্গা বাসিন্দাদের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তাদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা পাকাপোক্ত করা হতে পারে এই ধারণা থেকে রোহিঙ্গা গ্রামবাসীরা ওই প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানায়।

কমান্ডার বলেন, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গা বাসিন্দারা তাদের গ্রাম থেকে বের হতে পারবে না: ক্ষেতে কাজ করা যাবে না, গবাদিপশু মাঠে চড়ানো যাবে না।

এর তিনদিন পর রাখাইন রাজ্যের অন্যান্য এলাকার পুলিশ ও সেনাচৌকিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) হামলা চালিয়ে ১২ জনকে হত্যা করে।

পরদিন ২৬ আগস্ট আশপাশের গ্রামগুলোতে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, চুট পিন গ্রামে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিরা হাতের তৈরি বোমা দিয়ে সেনাসদস্যদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তবে রোহিঙ্গা গ্রামবাসী বলেন, এ ধরনের কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি।

পালাও বা লুকাও

২৭ আগস্ট রোববার সকালে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের বড় ছেলে হোসেন তার বাড়িতে বসে সকালের নাস্তা খাচ্ছিলেন। বর্ষাকালের শেষদিকের ওইদিনটিতে খুব বৃষ্টি পড়েছিল। রাস্তা কাদায় তখনও নরম ছিল।

তার স্ত্রী নুর আনকিস আট মাসের গর্ভবতী ছিলেন। এটা তাদের দ্বিতীয় সন্তান ছিল। কয়েক সপ্তাহ ধরেই তিনি তার বাবার বাড়ি যেতে চাইছিলেন। তার ধারণা যে তিনি বাবার বাড়ি গেলে নিরাপদ থাকবেন।

তবে হোসেন তাকে জানায় এই যাত্রাটা নিরাপদ নয়। কয়েক দিন আগেই ৩৩ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের একজন এক সেনা সদস্য তাকে রাইফেলের পেছনে অংশ দিয়ে তাকে আঘাত করে। হোসেন বলেন, সেনাবাহিনী কৃষিজমিতে প্রবেশ সীমিত করেছে সেখান থেকে গবাদিপশু উদ্ধারে আমি রোহিঙ্গা গ্রামবাসীদের সাহায্য করছিলাম।

সকালের খাবারের পর হোসেন শহরের কেন্দ্রস্থল অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলতে যান। তিনি একটি কল পান। তখন তিনি সেটিকে স্পিকারে দেন। ওই কলটা করেছিলেন গ্রামের বৌদ্ধ নেতা অং থেইন মিয়া। তিনি হোসেনকে ওইদিনই সকালেই একটি বৈঠকের জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

ফোনে অং থেইন মিয়া বলেন, তুমি যেখানে আছো, সেখানেই থাকো এবং নিহত হও বা আমাদের এখানে আসো এবং নিরাপদে থাকো। এদিকে সরকারের দেয়া একটি ফোন নাম্বার দিয়ে ওই নেতাকে কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।

তবে হোসেন তার কথায় আশ্বস্ত হতে পারেননি। তিনি তার সদ্য বিবাহিত ১৭ বছর বয়সী বোন রাজুমার বাসায় যান। তিনি বলেন, আমাদের সম্পর্কটা বরাবরই গভীর ছিল। আমি প্রায়ই ওকে কাপড় ও মিষ্টি জাতীয় খাবার কিনে দিতাম। আমি রাজুমার বাড়ি থেকে দুপুর ২টার পর বের হই।

আমি বাইরে দেখি কয়েক ডজন রোহিঙ্গা গ্রামবাসী দৌড়াচ্ছে ও চিৎকার করছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় যুবকরা ধার করা সামরিক পোশাক পরে বৌদ্ধ অধ্যুষিত অংশ থেকে আমাদের দিকে আসছে। এদিকে গ্রামের উল্টো পাশে সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছে। মোহাম্মদ তেহের নামের ২১ বছর বয়সী যুবক দেখেন সেনাসদস্যরা ভারি মেশিনগান তাক করছেন।

তিনি বলেন, সেনাবাহিনী পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলেছিল।

যখন গুলিবর্ষণ শুরু হলো, গ্রামবাসীদের সামনে দুটি রাস্তা খোলা ছিল: হয় লুকাও নয় পশ্চিম দিকে পালাও। কেননা ওই অংশে প্রায় ৬৫০ গজ খোলা ধান ক্ষেতের পর বন রয়েছে।

তেহের বলেন, আমি নিকটবর্তী একটি বাড়িতে আশ্রয় নেই। হোসেন একজন কৃষকের বাঁশের ঘরে আশ্রয় নেন। সেখানকার মানুষরা ঘরটিতে শুয়ে ছিল। যাদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। তিনি বলেন, আমি নারীদের চাপ দেই যাতে তারা কান্নারত শিশুদের থামায়।

ওই রুমে ৫০ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইয়াহিয়াও আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমার কাজিন দৌড়ে পালানোর সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ওই ব্যক্তির স্ত্রী চিৎকার দিয়ে বলেন, ও, আল্লাহ, ওরা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে! পরে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই নারীর শিশুরা তার দিকে ছুটে গেলে তাদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়।

হোসেন ও ইয়াহিয়া বলেন, তার দেখছিলেন যে সেনাসদস্যরা দরজা দরজায় ধাক্কা মেরে যাকে সামনে দেখছিল তাকে গুলি করছিল।

প্রায় ১৫ মিনিট পর সেনাসদস্যরা গ্রামের উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে যেতে যেতে চিৎকার করে বলতে থাকে, বাড়িগুলো পুড়িয়ে দাও! গ্রামবাসীরা বলেন, সেনাবাহিনী দাহ্য তরল দিয়ে বাঁশ ও তালপাতার তৈরি ঘরবাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর অন্য সেনারা রকেট দিয়ে বিল্ডিং উড়িয়ে দেয়।

হোসেন বলেন, আমি চিৎকার করে বলেছিলাম, আমাদের এই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

প্রায় ছয়জন নারী শিশুসহ বেরিয়ে গ্রামের দক্ষিণ দিকে দৌড় দেয়। তারা গুলি থেকে বাঁচতে সক্ষম হয়।

আরেক নারী তার দুই বছর বয়সী ছেলেসহ করবস্থানের দিকে দৌড় দেয়। ওখানে আরও অনেকে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু কয়েক কদম যাওয়ার পর তাকে ও তার সন্তানকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

কিছু লোক ওই কৃষকের কুঁড়ে ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু আগুন জ্বলতে থাকা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন হোসেন। তিনি প্রায় ৩০ ফুট হামাগুড়ি দিয়ে গ্রামের একটি পুকুরে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি প্রায় আরও ছয়জন ব্যক্তির সঙ্গে ওই পুকুরে ডুব দিয়ে থাকেন।

হোসেন বলেন, আগুনের কারণে গরম ধোঁয়ায় বাতাস ধোঁয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যায়। তিনি বলেন, এই কারণেই হয়তো সেনাসদস্যরা তাদের দিকে আসেনি। আমরা খাবি খেয়ে সেখানে অপেক্ষা এবং দোয়া করছিলাম।

এক সময়ের প্রতিবেশী

বহু জাতির সম্মিলনে রাখাইন রাজ্য সামাজিক সংঘাতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোহিঙ্গারা নিজেদের পশ্চিমাঞ্চলীয় মিয়ানমারের স্থানীয় মনে করেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী বিবেচনা করে তাদের নাগরিকত্ব দিতে নারাজ মিয়ানমার সরকার।

২০১৬ সালে অং সান সু চি ডি ফ্যাক্টো নেতা হওয়ার বেশ কয়েক মাস পর অক্টোবরে আরসা নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের প্রথম হামলা চালায়। এরপর প্রাথমিক পর্যায়ে অভিযান চালায় সামরিক বাহিনী।

গেলো বছরের জুনে কৃষি প্রধান চুট পিনে এই দ্বন্দ্বটা নতুন উত্তেজনা লাভ করে। ঢেঁড়স ও করলা চাষাবাদ হওয়া এই গ্রামের নিকটবর্তী পাহাড়ে একটি টানেল, তাঁবু ও অস্ত্রের ছবি প্রকাশ করে মিয়ানমার সরকার। কর্তৃপক্ষ এটিকে একটি জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করে।

এর কয়েক সপ্তাহ পর চুট পিনের একজন শীর্ষ বৌদ্ধ নেতার একজন আত্মীয় বনে খাবার সংগ্রহে গিয়ে নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় ছয়জন বৌদ্ধ গ্রামবাসী রোহিঙ্গা জঙ্গিদের সন্দেহ করে। থান হতয়ে নামের ওই ব্যক্তির খোঁজে এই ছয় জনের মধ্যে তিনজন যোগ দিয়েছিল।

ওই অভিযানের সময় তারা তাঁবু, রান্নার হাঁড়ি ও ভাত খুঁজে পায়। বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা এটি প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করে সন্দেহ করে যে রোহিঙ্গা জঙ্গিরা থান হতয়েকে হত্যা করেছে। তবে তার মৃতদেহ কখনই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

রাখাইন রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন সময় সংঘাত হলেও চুট পিনে কখনও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু গ্রামটির প্রায় চারশ’ বৌদ্ধ ১৪শ’ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভয়ে ভীত ছিল।

২০১২ সাল থেকে রাজ্যটিতে রোহিঙ্গা বাসিন্দাদের জন্য সূর্যাস্ত কারফিউ জারি করে রেখেছে নিরাপত্তা বাহিনী। এমনকি তারা রাতের বেলা বাতিও ব্যবহার করতে পারেন না। চুট পিনে রোহিঙ্গা শিশুরা বৌদ্ধদের সঙ্গে স্কুলে যেতে পারে না।

তবে থান হতয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর স্থানীয় রোহিঙ্গা বাসিন্দারা কঠোর চাপের মধ্যে পড়েন। এক গ্রামে বৌদ্ধরা একটি রোহিঙ্গা পরিবারের বাড়ির বাইরে বাঁশ ও তার দিয়ে বেড়া দিয়ে দেয়, যাতে তারা ঘর থেকে বের না হতে পারে। একইসঙ্গে জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে রোহিঙ্গাদের গ্রেপ্তার করা বাড়িয়ে দেয় নিরাপত্তা বাহিনী।

জুলাই মাসের শেষদিকে চুট পিনের কাছে তিনজন বর্গাচাষীর বিকৃত মৃতদেহ পাওয়া যায়। নিরাপত্তা বাহিনী স্থানীয় বৌদ্ধদের জানায় ওই ব্যক্তিরা পুলিশের সোর্স সন্দেহে তাদের জঙ্গিরা হত্যা করে থাকতে পারে।

যদিও রোহিঙ্গা গ্রামবাসীদের সন্দেহ বৌদ্ধরাই ওই তিন বর্গাচাষীকে হত্যা করেছে। থান হতয়ে-কে হত্যা করা হয়েছে এমন ধারণা থেকেই তারা এমনটি করে থাকতে পারে।

তবে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে চুট পিন থেকে কয়েকটি বৌদ্ধ পরিবার চলে যায়। এদিকে তরুণ বৌদ্ধরা ফেসবুকে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের অস্ত্রের ছবি প্রকাশ করে। একজন ফেসবুক পোস্টে লিখেন, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আরেকজন লিখেন, আমরা সেনা মোতায়েনকে স্বাগত জানাই।

এটা জাহান্নাম

সেনারা চুট পিনে গ্রামবাসীদের ওপর গুলি ছুঁড়লে হাসিনা বেগম তার কোলের শিশুকে নিয়ে কাদাময় ধান ক্ষেতের ওপর দিয়ে বনের দিকে দৌড় দেয়। তার স্বামীও তাদের সঙ্গে দৌড় দেয়। ওইসময় সেনারা গুলি ছুঁড়ে যাচ্ছিল।

হাসিনা বেগম বলেন, আমরা যখন বনের কাছাকাছি পৌঁছাই। তখন দেখতে পাই ধান বনের সঙ্গে ধান ক্ষেতের ধার ধরে সেনারা রাইফেল ও মেশিন গান নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমরা আটকা পড়ে গেলাম। হাসিনা বলেন, ‘এটা জাহান্নাম’।

তারা হামাগুড়ি দিয়ে একটি ছোট নদীর পাশে বড় একটি গাছের পেছনে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সেখানে আরও প্রায় একশ’ ছিল। সংখ্যাটা এতো বেশি ছিল যে, এটা যে কারও নজর এড়াতো না।

হাসিনা বলেন, আমি ছাড়াও সেখানে আরও দুইজন নারী ছিল। সামরিক পোশাক পরিহিত গ্রামের বৌদ্ধ নেতা অং থিয়েন মিয়া হাতে একটি ছুরি নিয়ে সেনা সদস্যদের সঙ্গে আমাদের দিকে এগোতে থাকে।

সেনারা গ্রামবাসীদের হাটু গেড়ে বসিয়ে চেহারা মাটির সঙ্গে মেশাতে বাধ্য করে। পরে চুট পিনে বৌদ্ধ অধ্যুষিত অংশে হাসিনার স্বামীসহ প্রায় ৫০ জন পুরুষকে নিয়ে যায় তারা। এরপর থেকে তাদের আর দেখা যায়নি। গ্রামের একজন প্রতিবন্ধী দোকান যিনি হুইলচেয়ারে ব্যবহার করেন, তাকে মাথায় গুলি করা হয়।

সেনারা নারীদের কানের দুল, নাকের ফুল, ব্রেসলেট ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায়, জানিয়েছে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা।

এরপর তাদের বয়সের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়। যুবতীদের বলা হয় যে, তাদের সন্তানদের অপেক্ষাকৃত বৃদ্ধ নারীদের কাছে হস্তান্তর করতে বা তাদের গুলি করা হবে। হাসিনা বেগম তার সন্তানকে তার শাশুড়ির কাছে দিয়ে দেয়। পরে বয়স্ক নারীদের পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে যেতে বলা হয়।

প্রায় ২০ জন তরুণীকে চুট পিনের বৌদ্ধ অংশে টিনের ছাদ দেয়া সরকারি স্কুলে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

হাসিনা বলেন, সেনা ও পুলিশ মিলিয়ে প্রায় একশ’ পুরুষ একটি ক্লাসরুমের বাইরে জড়ো হয়। রুমের ভেতর তিনজন পুরুষ আমার হিজাব দিয়ে আমার চোখ বেঁধে দেয়। আর দড়ি দিয়ে আমার হাত বেঁধে কংক্রিটের ফ্লোরে ফেলে দেয়। সেখানেই কয়েকজন পুরুষ তাকে ধর্ষণ করেন। তিনি বলেন, আমি জ্ঞান হারাই। আরও দুইজন নারী একইভাবে ওই স্কুলে নির্যাতিত হওয়ার কথা বর্ণনা করেন।

হারানোর পর আবারও খুঁজে পাওয়া

শেষ বিকেলের দিকে ফিরে যায় সেনারা। হোসেন বলেন, তখন প্রায় ৬টা বাজছিল। তখন আমি মানুষের চিৎকার শুনতে পাই: তোমরা জীবিত হলে, গোপন স্থান থেকে বের হয়ে আসো।

হোসেন ও অন্যান্য লোকেরা ওই পুকুর থেকে উঠে আসেন। তারা বহু মৃতদেহ মাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী আহ হতেট নান ইয়ার গ্রামের দিকে রওনা দেয়।

হাসিনা বেগম যিনি স্কুলে অচেতন অবস্থায় ছিলেন, তার জ্ঞান ফিরলে তিনি চোখের কাপড় খুলে ফেলেন। তিনি ফ্লোরে কয়েকজন নারী মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি আরও কয়েকজন বেঁচে যাওয়া নারীর সঙ্গে নগ্ন অবস্থায় স্কুল রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। তার হাত তখনও বাঁধা ছিল।

ওই নারীরা একটি ঝোপে লুকিয়ে ছিলেন। পরে পাশেই লুকিয়ে থাকা একটি ছেলে সাহায্যের জন্য আত্মীয়স্বজনদের ডেকে পাঠায়। হাসিনা বলেন, তার বাবা একটি খুড়ের স্তূপে লুকিয়ে ছিলেন, তাকেসহ তারা আহ হতেট নান ইয়ার গ্রামের দিকে রওনা দেন।

সেখানেই তিনি চুট পিন গ্রামের বেঁচে যাওয়া শত শত বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলিত হন। ওই গ্রামেরই একজন বাসিন্দা ৬০ বছর বয়সী শফি উল্লাহ একজন প্রশিক্ষিত সার্জন। রোগীরা তার বাড়ির ফ্লোরে বিছানা ও কম্বল পেতে শোয়ার ব্যবস্থা করে। তিনি বলেন, আমি ও আমার সন্তানরা মিলে রাতভর ৩৫টি বুলেট বের করি ও ৭০টি ক্ষতস্থানে সেলাই করি। আমার শরীর ও কাপড় রক্তে ভিজে গিয়েছিল।

ওই গ্রামে থাকাবস্থায়ই হাসিনা জানতে পারেন যে তার ছেলে সন্তান এখনও বেঁচে আছে। এমনকি তার দুই বছরের শিশু মেয়েও জীবিত। একজন প্রতিবেশী হোসেনের হাতে তার শিশু মেয়েকে তুলে দেয়। ওই শিশু মাটির মধ্যে একা বসে ছিল। তবে হোসেনের স্ত্রী ও মা নিহত হয়েছে।

হোসেনের ছোট ভাই আরেকটি পুকুরে আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছেন। হোসেনের বাবা ও তার আরেক ভাইকে বন্দুকের নলে ডগায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার বোন রাজুমাকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

হোসেন বলেন, মধ্যরাতের পর আমার প্রতিবেশী মোহাম্মদ ইসমাইল খবর নিয়ে পৌঁছায়। ইসমাইল একটি সেচ কূপের ভেতর লুকিয়ে ছিলেন। ইসমাইল বলেন, সেনারা চলে যাওয়ার পর তিনি হোসেনের বোনকে নগ্ন অবস্থায় দেখতে পান। এসময় তার উরুতে গুলির ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছিল। কিন্তু সে খুব দুর্বল হওয়ায় তাকে বহন করে আনতে পারেননি। কিন্তু রাজুমা এখনও জীবিত।

হোসেন ও তার বেঁচে যাওয়া ভাই চুট পিনে গিয়ে ঝোপের মধ্যে রাজুমাকে খুঁজে পায়। রাজুমাকে একটি সারংয়ে মুড়ে তারা তাকে আহ হতেট নান ইয়ার গ্রামে নিয়ে যায়। পরে তার উরু থেকে বুলেট বের করা হয়। তার পাণ্ডুবর্ণ চেহারা দেখেই বোঝা গেছে যে, তার শরীর থেকে অনেক রক্ত ঝরেছে।

তার ভাইয়েরা তার মাটিমিশ্রিত শরীর পরিষ্কার করে তাকে কাপড় এনে দেয়। রাজুমা জানায় তাকে সেনা সদস্যরা তাকে ধরে ফেলে। তিনি বলেন, আমার উরুতে গুলি করার আগ পর্যন্ত আমি তাদের সঙ্গে লড়াই করি ও তাদের লাথি দেই। কিন্তু পরে ওরা আমাকে ধর্ষণ করে।

হোসেন বলেন, আমি রাজুমাকে রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় তার কাছে ক্ষমা চেয়েছি। কিন্তু সকাল হওয়ার আগেই সে মারা যায়। তার ভাইয়েরা কোদাল খুঁজে পায় এবং আহ হতেট নান ইয়ার গ্রামের একটি জায়গায় রাজুমার জন্য কবর খোঁড়া হয়। তারা রাজুমার মৃতদেহ কবরে রেখে তার জন্য প্রার্থনা করেন। চুট পিনের অন্যান্য পরিবারও তাদের আত্মীয়স্বজনের মৃতদেহ সেখানে দাফন করেন।

পরদিন হোসেন জানতে পারেন যে, তার মা ও গর্ভবতী স্ত্রী বনে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়েছিল। তারা এখনও বেঁচে আছেন।

কিন্তু দ্রুতই গুজব ছড়াতে থাকে যে আহ হতেট নান ইয়ার গ্রাম সেনাবাহিনীর পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু। তখন হোসেন ও তার বেঁচে যাওয়া পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশের পথে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করেন।

কয়েকদিন পর আহ হতেট নান ইয়ার গ্রামও পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়।

এ/জেএইচ

মন্তব্য করুন

daraz
  • আন্তর্জাতিক এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারে দীর্ঘস্থায়ী খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা: এফএসআইএন
রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকা চান হাইকোর্ট
ভাসানচরে রোহিঙ্গা নাগরিককে গলা কেটে হত্যা
৫ মাসের শিশু চুরির ৫ দিন পর উদ্ধার, ২ রোহিঙ্গা গ্রেপ্তার
X
Fresh