• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

'দেশে পাঠালে আত্মহত্যাই করবো'

আরটিভি অনলাইন রিপোর্ট

  ২২ মার্চ ২০১৭, ২২:৪৮

পাপুয়া নিউগিনির ছোট্ট দ্বীপ মানাস আইল্যান্ড। গেলো চার বছর ধরে এ দ্বীপের এক শিবিরে বন্দী জীবন পার করছেন জীবন রাসেলসহ ৭০ জন বাংলাদেশি। আছেন ইরানি, ভারতীয়, পাকিস্তানি, সোমালি, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাসহ অসংখ্য মানুষ।

রাসেল মাহমুদ বাংলাদেশ থেকে পাপুয়া নিউগিনির মানাস আইল্যান্ডের এ জীবনে কীভাবে এসে পড়লেন, সেই কাহিনি অনেক দীর্ঘ এবং গা শিউরে ওঠার মতো ভয়ংকর।

কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে ফিরতে চান না তিনি। এ নিয়ে মানাস আইল্যান্ডে শরণার্থীদের জন্য তৈরি এক শিবির থেকে তিনি ফোনে লন্ডনে বিবিসি বাংলা বিভাগের দপ্তরে আকুতি জানান যেনো তাদের অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় দেয়া হয়।

তিনি আরো বলেন, 'আমি দেশে ফিরে যেতে চাই না। যদি আমাকে জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়, আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। আমি আত্মহত্যাই করবো।'

রাসেলের বাড়ি বাংলাদেশের বগুড়ায়। সেখানে তাঁর বাবা-মা এবং এক ছোট ভাই আছেন। ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি সেখানেই কাটিয়েছেন। পড়াশোনা করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। এরপর কনস্ট্রাকশন খাতে ছোটখাট সাপ্লায়ারের ব্যবসা করতেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল অস্ট্রেলিয়া বা কানাডার মতো কোন দেশে যাবেন।
২০১৩ সালের জানুয়ারিতে রাসেল মাহমুদ বাংলাদেশ থেকে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়া যান।

সেখানে এক সপ্তাহ থাকার পর যোগাযোগ হয় মানব-পাচারকারী একটি চক্রের সঙ্গে। তাদের অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। দিতে হয় ৭ হাজার মার্কিন ডলার। এ অর্থ তিনি নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে।

একটি উপকুলীয় এলাকা থেকে নৌকায় করে তারা প্রথমে ইন্দোনেশিয়া রওনা হন। প্রায় ১৮ ঘন্টা নৌকায় ছিলেন। সহযাত্রীদের মধ্যে ছিলেন অনেক রোহিঙ্গা, সোমালি, ইরানি। তাদের নৌকা ইন্দোনেশিয়ার উপকুলে পৌঁছায়। মেডান শহরে তাদের একটি বাড়িতে রাখা হয় এক সপ্তাহ। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় জাকার্তায়।

জাকার্তা থেকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় সুরাবায়া শহরে। সেখান থেকে আবারও নৌকায়। এবারের গন্তব্য অস্ট্রেলিয়ার উপকুল। নৌকায় ছিল প্রায় একশ' মানুষ। মাঝারি সাইজের নৌকা। ঘুমাতে হতো নৌকার পাটাতনে। ৯ দিন ৯ রাত সাগরে ছিলেন।

সাগরের মাঝখানে দূর থেকে দেখা গেল, এগিয়ে আসছে অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনীর জাহাজ। রাসেল মাহমুদ এবং তাদের সঙ্গীরা ছিলেন উল্লসিত। এবার তাদের নিশ্চয় উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হবে অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু তাদের ভাগ্য ছিল খারাপ।

'অস্ট্রেলিয়ান নেভীর শিপে ওঠার পর ৩দিন বাদে আমাদের ক্রিসমাস আইল্যান্ডে নিয়ে যায়। অনেক বড় দ্বীপ। একশ ফুট উঁচু। এয়ারপোর্ট আছে। দ্বীপ বড় বড় লাল কাঁকড়া আছে।' বলছিলেন তিনি।

রাসেল আরো বলেন, সেখানে আমাদের ডিটেনশন সেন্টারে রাখে। ক'দিন থাকার পর আমরা যখন স্বাভাবিক হলাম, তখন আমাদের বললো তোমাদের আশ্রয় দেয়া হবে না। আমাদের বলা হয় অস্ট্রেলিয়া সরকারের নীতি বদলে গেছে। ১৯ জুলাই এর আগে যারা এসেছে, তাদের অস্ট্রেলিয়া আশ্রয় দিয়েছে। ১৯ জুলাইর পর থেকে এরা আর শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে না।'

ক্রিসমাস দ্বীপ থেকে একদিন তাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় অনেক দূরে পাপুয়া নিউ গিনির এক ছোট্ট দ্বীপ মানাস আইল্যান্ডে। সেখানেই গেলো চার বছর ধরে তাদের বন্দী জীবন।

মানাস দ্বীপে অস্ট্রেলিয়া এ শিবির তৈরি করেছে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছে এমন আশ্রয় প্রার্থীদের আটকে রাখার জন্য। অস্ট্রেলিয়ার নেভী বা কোস্টগার্ড নৌকায় করে তাদের দেশে যাবার চেষ্টার সময় লোকজনকে আটক করে এখানে নিয়ে আসে। এরপর এখান থেকে তাদেরকে যার যার দেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার এই কার্যক্রম, তীব্র সমালোচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তরফ থেকে।

কীভাবে এ দ্বীপে ৪ বছর কাটিয়েছেন তা নিয়ে রাসেল মাহমুদ বললেন, ‘আমাদের ক্যাম্পে সবই আছে। থাকার জায়গা। খাবার জায়গা। দু’হাজার সিকিউরিটি গার্ড পাহারা দেয় এই ক্যাম্প। প্রায় এক হাজার মানুষ এখানে আটকে রাখা হয়েছে।’

গেলো ৪ বছর ধরে ক্যাম্পে রাসেল মাহমুদের জীবন একই রুটিনে বাঁধা। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা। এরপর সবাইকে জিমনেশিয়ামে গিয়ে একটু শরীরচর্চা করতে হয়। সেখান থেকে ফিরে গোসল করে যেতে হয় ক্লাশে। সেখানে তাদের ইংরেজী শেখানো হয়। ফিরে এসে দুপুরের খাবার। বিকেলে একটু ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা। ফিরে এসে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাওয়া।

ভালো আচরণের জন্য তাদেরকে পয়েন্ট দেয়া হয়। সেই পয়েন্ট দিয়ে তারা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারেন। ক্যাম্পের ভেতর বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে। টিভি, সিনেমা দেখতে পারেন। কিন্তু তারপরও ভালো নেই রাসেল মাহমুদ এবং তার সঙ্গীরা। সবসময় টেনশনে আছেন তারা।

রাসেল বলেন, মানাস দ্বীপের বন্দী শিবিরে এখন যে এক হাজারের মতো বন্দী আছেন, তাদের মধ্যে ২০৫ জনের আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে অস্ট্রেলিয়ার কর্তৃপক্ষ। এদের মধ্যে ৫০ জনের মতো বাংলাদেশি আছেন। তবে ২০ জন বাংলাদেশির আশ্রয়ের আবেদন গৃহিত হয়েছে।

রাসেল আরো বলেন, যখন টেলিফোনে বাবা-মার সঙ্গে কথা হয়, তখন তারা দেশে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু আমি কীভাবে যাবো। ১২ লাখ টাকা খরচ করে ফেলেছি অস্ট্রেলিয়া যাবার জন্য। এখন কোন মুখে দেশে ফিরে যাবো? কীভাবে তাদের মুখ দেখাবো। আমি দেশে ফিরে যেতে চাই না। আত্মহত্যা ছাড়া আর উপায় নেই। শুধু আমি না, আমার সঙ্গে যারা আছেন, তাদেরও একই চিন্তা। আপনি লিখে রাখেন, আমি রাসেল মাহমুদ, যদি আমাকে দেশে ফেরত পাঠায়, আমি আত্মহত্যাই করবো।’

এপি/এসজে

মন্তব্য করুন

daraz
  • আন্তর্জাতিক এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh