• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

সরকারের ৩ বছর ছিল অর্থনীতির গ্রীন কার্ড

মিথুন চৌধুরী

  ০৪ জানুয়ারি ২০১৭, ২০:৩৭

গ্রামীণ উন্নয়ন, দারিদ্র্য মোচন, প্রবৃদ্ধি, অর্থনীতির সূচক, রিজার্ভ আর মূল‌্যস্ফীতির পরিসংখ‌্যানে দেশের অর্থনীতি দেখেছে স্থির মুখ। বিশ্বব্যাপী মন্দা থাকলেও দেশের অর্থনীতির চাকা ছিল সচল। বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে মধ্য আয়ের দেশে রূপ নেয়ার। ২০১৬ সালে অনেক স্বস্তির খবর পেলেও সবকিছু ছাপিয়ে মানুষের আস্থার জায়গা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে আর্থিক খাতে হ‌্যাকারের হানা। কিন্তু তবুও রিজার্ভ এর পরিমাণ ছিল বেশ।

এর আগে ২০১৫ সালে ৯০ দিন হরতাল অবরোধের কয়েকশতাধিক মানুষের মৃত্যু ও অর্থনীতিতে শীতলতা বয়ে এনেছিল। পদ্মা সেতু, ফ্লাইওভার, রামপাল বিদুৎ কেন্দ্র, ঢাকা-চট্টগ্রামের চার লেনের রাস্তাসহ নানামুখী উন্নয়ন ছিল গেলো ৩ বছর ধরে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং বিশ্ব ব‌্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমও এ বছর বাংলাদেশে এসে অগ্রগতির প্রশংসা করে গেছেন।

এদিকে, বিশ্বের স্বল্পোন্নত ৪৮টি দেশের জাতীয় আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আংকাটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ স্বল্পন্নোত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে মধ্য আয়ের দেশের জন্য বিবেচিত হবে। ২০২৪ সালে এ তালিকা থেকে বের হয়ে আসবে। অর্থনীতিবিদরা বলছে, বিশ্বের অনেক দেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের কাছাকাছি গিয়েও পারেনি। কারণ তাদের সামাজিক স্থিতিশীলতা ছিল না।

বাজেট:

দেশের উন্নয়নের সাথে প্রতিবছর বাড়ছে বাজেট। সূক্ষ্ণ পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বাজেটের ওজন। আসন্ন বাজেটেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মাল আব্দুল মুহিত তা পেশ করেন। যাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। এর আগে চলতি অর্থবছরের(২০১৫-১৬ অর্থবছর) বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা।

মাথাপিছু আয়:

বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু জাতীয় আয় এখন এক হাজার ৩১৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে। যা ২০১৫ সালে ১ হাজার ৩১৪ ডলার। ২০১৪ সালে ছিল ১ হাজার ৮৬ ডলার। এদিকে, আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলারের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।

মূল্যস্ফীতি:

অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। যা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ। যা ২০১৪ সালে ছিল গড় মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের বেশি।

রিজার্ভ:

অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বিদেশি মুদ্রার মজুদ। হ্যাংকিং এর মাধ্যমে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে নিলেও বছর শেষে ৩২ বিলিয়ন ডলার হয় রির্জাভ। ২০১৫ সালে রিজার্ভ ছিল ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪ সালে রিজার্ভ ছিল ২২ দশমিক ৩৫ ডলার।রেমিটেন্স:

বৈশ্বিক মন্দায় ২০১৬ সালে রেমিটেন্স কম আসলেও গেলো কবছরে রেমিটেন্স আদায় ছিল রেকর্ড আকারের। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছে বিকাশসহ হুন্ডি সিন্ডিকেটও এর জন্য দায়ী। ২০১৬ সালে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে। আর ২০১৫ সালে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৫৩১ কোটি ২১ লাখ ডলার, যা ২০১৪ সালে আসা রেমিট্যান্স থেকে ৩৬ কোটি ৯৫ লাখ ডলার বা ২.৪৭ শতাংশ বেশি।

প্রবৃদ্ধি:

২০১৬ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম প্রবৃদ্ধির দেশ। এই বছরটিতে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে যাবে চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হারকেও। নতুন বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তবে তা গেলো অর্থবছরের চেয়ে কম হলেও সামষ্টিক বৈশ্বিক অর্থনীতির তুলনায় ভাল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

রাজস্ব আদায়:

২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান প্রত্যাশা করছেন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি অায় হবে এ বছরে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সব মিলিয়ে এক লাখ ৫৪ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭শ' কোটি টাকা।

আমদানি-রপ্তানি-ভারসাম্য:

২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে আমদানি ব‌্যয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪২ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি।২০১৪-১৫ অর্থবছর আমদানি খাতে ব্যয় হয়েছিল ৩ হাজার ৭৬৬ কোটি ৬২ লাখ ডলার।

অন‌্যদিকে, রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা ২০১৬ সালেও ধরে রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩ হাজার ৪২৪ কোটি ১৮ লাখ ২০ হাজার ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ৮৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার।

বিনিয়োগ:

বিশ্ব অর্থনীতির ভঙ্গুরতা, চাহিদা কমে আসা ও মন্থর প্রবৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। ২০১৬ সালে এফডিআই ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার আশঙ্কা করে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আংকটাড)। তবুও বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন বিনিয়োগ বোর্ডে। এর আগে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অংশীদার হতে বিশ্বের বড় বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। এর আগে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে ২২৩ কোটি ডলার। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৫২ কোটি ডলার।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতাদেশ ও সংস্থা বাংলাদেশকে এখন অন্য দৃষ্টিতে দেখে। ৬ শতাংশের বৃত্তে আটকে থাকা জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবছর ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছে। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যয়েই আটকে রাখা গেছে। বাড়ছে বিদেশি ঋণ-সহায়তা; রাজস্ব আদায়ের গতিও ভালো। ২০১৬ বছর জঙ্গিবাদের নতুন উত্থান চোখ রাঙালেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ‘সাফল‌্যে’ অর্থনীতিকে খুব বেশি ভুগতে হয়নি। ব্রেক্সিট এখন পর্যন্ত কোনো বিপদ ঘটাতে পারেনি। ২০১৫ সালে টানা তিন মাসের অবরোধ-হরতালের পর দেশে নতুন করে আর রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি না হওয়ায় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে। দেশের বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটতে শুরু করেছে।

এমসি/ডিএইচ

মন্তব্য করুন

daraz
  • এক্সক্লুসিভ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh