• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
logo

ঘুর্ণিঝড় 'মোরা'র আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি কতটা?

সিয়াম সারোয়ার জামিল, কক্সবাজার থেকে ফিরে

  ৩১ মে ২০১৭, ১৯:৫১

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মঙ্গলবার ভোরে আঘাত হানে ঘুর্ণিঝড় 'মোরা'। এতে বেশি প্রাণহানি না ঘটলেও অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন স্থানীয়রা। ঘরবাড়ি ও গাছপালা বিধ্বস্ত হওয়া ছাড়াও লবণের ঘের, পানের বরজ, খামারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ভয়াবহ।

ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে কুতুবদিয়ার কাছ দিয়ে কক্সবাজার-চট্রগ্রাম উপকূল অতিক্রম করে। এজন্য সোমবার রাতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়েছিল।

ঝড়ের পরে সরেজমিনে দেখা গেছে, কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, চকরিয়া, টেকনাফ ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। পুরো এলাকার রাস্তাঘাটে গাছ ভেঙে পড়ে পথ আটকা রয়েছে অসংখ্যা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পথ চলাচল স্বাভাবিক রাখতে এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখলেও তা দরকারের তুলনায় ছিল খুবই অপ্রতুল।

ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে অধিকাংশই এখন গৃহহীন। নষ্ট হয়েছে আমের বাগান। সবচেয়ে বিপদে পড়েছে পানের বরজ ও খামারিরা। তারা বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হন। প্রায় প্রতিটি খামারেই সিংহভাগ গবাদিপশু-হাস-মুরগী মারা গেছে। এতে পথে বসেন স্বচ্ছল ব্যবসায়ীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতি কয়েকশ' কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

আশ্রয়হীন ১ লাখ, ক্ষতিগ্রস্থ ৬ লাখ

সরকারি তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ৫৪ হাজার ৪৮৯টি পরিবারের ২ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৫ জন মানুষ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপকূলীয় ৩১ উপজেলার ১০৬টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ৫৪ হাজার ৪৮৯টি পরিবারের ২ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৫ জন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তবে স্থানীয় এনজিওগুলো বলছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি। অন্তত ৬ লাখ মানুষ ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।

জানা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে উপকূলের বেড়িবাঁধ। ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে ৫০ হাজার মানুষ। রেখে গেছে তাণ্ডবের ক্ষতচিহ্ন।

জেলার সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও পেকুয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলার সব উপজেলা মোরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লক্ষাধিক গাছপালা বাতাসে ভেঙে গেছে। ন

২০ হাজার ঘরবাড়ি বিদ্ধস্ত ঘূর্ণিঝড়ে ১৯ হাজার ৯২৯টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং ৩৯ হাজার ৫৯৯টি ঘরবাড়ী আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তুবদিয়ার বড়গুফ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মানুষের আবাসস্থলে। কাঁচা ঘরবাড়ি বেশী নষ্ট হয়েছে। সামনে বর্ষা। তাই প্রথম কাজ হবে তাদের গৃহ নির্মাণে সহায়তা করতে হবে। আর দ্বিতীয় হলো বেড়িবাঁধ - কিছুকিছু জায়গায় খোলা আছে। বাঁধ মেরামত না হলে বর্ষাকালে নোনা পানি ঢুকে যাবে, চাষাবাদ হবেনা।


পথে বসছেন পানের বরজ ও খামারিরা

এক হাজার ৫৯২ একর জমির পানের বরজের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সহস্রাধিক খামারি পরিবার।

মহেশখালপাড়ার তোহশিল আলম জানালেন, তার খামারের মূলধন ছিল প্রায় ৩৪ লাখ টাকার। ঝড়ে খামার বিদ্ধস্ত হয়েছে। মারা গেছে সিংহভাগ হাস-মুরগী।

টেকনাফের আব্দুল হামিদ জানান, তার ৫ বিঘা জমিতে পানের বরজ ছিল। সেসব ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছ। এখন সে পথে বসার জোগাড়।

পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর আরটিভি অনলাইনকে জানালেন, পানের বরজ ও খামারিরাই মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঝড়ে তাদের নিশ্চিহ্ন হবার দশা।

হোয়াইংকং ইউপি চেয়ারম্যান নূর আহমেদ পাটোয়ারী জানান, এলাকার মানুষের স্বাপ্নের জায়গা ছিল খামার। অথচ ঝড়ে সেই খামারই এখন নিশ্চিহ্ন প্রায়।

স্থানীয় প্রশাসন বলছে, উপকূলে মোরার ক্ষতি প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।


মোরা'য় ঝরেছে ৮ প্রাণ

ঘুর্ণিঝড়ে ৮ জনের প্রাণ গেছে। এরমধ্যে কক্সবাজারে ৫ জন এবং রাঙ্গামাটিতে ২ জন মারা গেছেন। এছাড়া ভোলায় ১ জন।

কক্সবাজারে নিহতরা হলেন, চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজরা গ্রামের রহমত উল্লাহ (৫০), পূর্ব বড়ভেওলা গ্রামের সায়রা খাতুন (৫৫), পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া গ্রামের আবদুল হাকিম (৬৫), সদরের ইসলামাবাদের শাহীন আকতার (১০)।

রাঙ্গামাটিতে জাহিদা সুলতানা (১৪) ও হাজেরা বেগম (৪০) মারা গেছেন।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ঝড়ে আহত হয়েছেন ৬১ জন। এরমধ্যে কক্সবাজারে ৬০ জন এবং রাঙ্গামাটিতে একজন রয়েছেন।

এদিকে শনিবার নৌবাহিনী দাবি করেছে, বঙ্গপোসাগরে ৫৫ জেলে নিখোঁজ রয়েছে। তাদের উদ্ধার অভিযান চলছে।

ভেঙেছে বাঁধ, এখনো পানিবন্দি মানুষ

ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রায় ৫ কিলোমিটার ভাঙা বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় জোয়ারের প্লাবনে ৪০ গ্রামের কয়েক শ' ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে আড়াই কিলোমিটার, মহেশখালীর ধলঘাটা ইউনিয়নে দেড় কিলোমিটার, মাতারবাড়ি ইউনিয়নে ১০০ মিটার ও কক্সবাজার সদর উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নের গোমাতলীতে ৮০ মিটারসহ পাঁচ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেছে।

এ ছাড়া জেলার পেকুয়া, কুতুবদিয়া উপজেলায় আরও সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।

পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান আরটিভি অনলাইনকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোরার প্রভাবে ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে কয়েকটি ইউনিয়নের ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এখনো পানিবন্দি আছে কিছু এলাকার মানুষ। আমরা চেষ্টা করছি বাঁধ মেরামতের।

ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ সামান্যই

উপকূলের সিংহভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হলেও বরাদ্দ হয়েছে সামান্যই। যা বরাদ্দ হয়েছে সেটাও পৌঁছায়নি ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে। দুর্গত মানুষেরা ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, মহেশখালীর মাতারবাড়ি, ধলঘাটা, কুতুবদিয়া উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকায় সরকারি কোনও ত্রাণ পৌঁছেনি।

তবে কয়েকটি উপজেলার কিছু কিছু এলাকায় নগদ অর্থ ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

সরকারি তথ্যমতে ৬ জন নিহত হয়েছেন। বিধান অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে ৬ জনের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে।

প্রশাসন বলছে, বাকি যে দুজন নিহত হয়েছেন, তদন্ত সাপেক্ষে তাদেরকেও সহায়তা করা হবে।

ঘূর্ণিঝড় 'মোরা'য় ক্ষতিগ্রস্ত কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরিশাল, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনা, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট এবং রাঙ্গামাটি জেলায় এক হাজার ৭০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ সব জেলায় এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ঘর নির্মাণের জন্য বুধবার কক্সবাজারে ৩০০ বান্ডিল ঢেউটিন এবং ৯ লাখ টাকা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন আরটিভি অনলাইনকে জানান, ‘ঘূর্ণিঝড় কবলিত দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। ধীরে ধীরে সব ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা হবে। দুই দিনে ১১৯ মেট্রিক টন ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। পরে পর্যায়ক্রমে আরো ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হবে।’

দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বপ্রাপ্ত গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘সব জেলা প্রশাসকদের সাথে সার্বক্ষণিকভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি। যেখানে যা দরকার আমরা সেই সাহায্য তাদের দেব। আমরা সবাই সময় সময় তাদের (ক্ষতিগ্রস্তদের) সঙ্গে আছি।’

এসজে

মন্তব্য করুন

daraz
  • এক্সক্লুসিভ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh