• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
logo

‘নায়করাজ তোমাকে ভালোবেসে অঝরে কেঁদেছে ভাদ্রের আকাশ'

সজল অনিরুদ্ধ

  ২২ আগস্ট ২০১৭, ২৩:০৫

নায়ক রাজের মরদেহ তখন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে গুলশান আজাদ মসজিদের পথে। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক জগতের গুণীজনেরাও বাড়ির পথ ধরেছেন। ভক্তবেষ্টিত সুপারস্টার শাকিব খানের পাজেরো গাড়িটি এগিয়ে চলছে শম্ভুক গতিতে। ততক্ষণে ঢাকার আকাশ থেকে মেঘগুলোও যেন উড়ে গেছে কোন সুদূরে । প্রখর রৌদ্রের তাপে ভিজে যাচ্ছে ক্লান্ত মানুষের কপাল। প্রতিদিনকার মতোই রাজধানীর ব্যস্ত মানুষেরা কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে চলে যাচ্ছেন গন্তব্যের দিকে। তাহলে কি ক্ষণিক সময়েই নির্বাপিত নায়করাজ?

চিত্রটি এখানে শেষ হলে বলাই যেত রাজ্জাক অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু শহিদ মিনারের কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে গিয়ে দেখা গেলো ভিন্ন এক চিত্র। গালে হাত দিয়ে এক প্রৌঢ়া বসে আছেন রাজ্যের সব বেদনা নিয়ে।

আক্ষেপ একটাই, শেষবারের মতো নায়করাজকে দেখা হয়নি তার। জিঞ্জিরা থেকে গাড়ির পর গাড়ি টপকিয়ে শহিদ মিনারে আসতে আসতে রাজ্জাকের মরদেহ চলে গেছে মহাপ্রস্থানের দিকে।

না শুধু প্রৌঢ়া আঙুরবালাই নন। শহিদ মিনারজুড়ে তখনো হাজার দুয়েক মানুষ। চারদিক থেকে ক্যামেরাগুলো ক্লিক করে উঠছে। একের পর এক মানুষ সান্ত্বনা হিসেবে রাজ্জাকের কফিন রাখা বেদীতেই ফুলের তোড়া দিয়ে যাচ্ছেন। আবেগে আপ্লুত মানুষগুলো সবাই নিজের মতো করে নায়ক রাজকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন।

এরই মধ্যে শহিদ মিনারের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া এক রিকশাচালক তার যাত্রীর সঙ্গে বয়ান করে বলছেন, ভাই ‘বাবা কেন চাকর’ ছবির বাবাটা মরে গেছে। তার লাশ নিয়া আইছিল। এজন্যই এতো ভিড়।’ বুজাই যাচ্ছিল রিকশার ওই যাত্রী জানেন না কিছুক্ষণ আগে শহিদ মিনারে এসেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মহারাজ রাজ্জাক।

শহিদ বেদীর কাছে এগিয়ে যেতেই দেখা হলো এক তরুণীর সঙ্গে। হাতে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল নিয়ে এদিকওদিক হাঁটছিলেন। সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, ‘এসে কী লাভ হলো। দেখতেই যখন পারলাম না। চল ফুলগুলো শহিদ বেদীতে রেখে চলে যাই।

তরুণীর নাম আফসানা। পড়েন নার্সিং কলেজে। রাজ্জাকের ছবি যে খুব দেখেছেন এমন নয়। তবে নায়করাজকে অন্য সবার মতোই ভালোবাসেন। প্রশ্ন করলে তিনি আরটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘না উনার ছবি খুব বেশি দেখিনি। তবে ‘আয়নাতে ওই মুখ..।’ গানটাতে ওনাকে অসাধারণ লাগে। অসাধারণ উনার এক্সপ্রেশন।’

তিনি বলতে থাকেন, কাছেই হোস্টেলে থাকি। তাই নায়করাজের মরদেহ শহিদ মিনারে নিয়ে আসা হয়েছে শুনে চলে এসেছি। কিন্তু আফসোস উনাকে দেখতে পারিনি। গোলাপ ফুলগুলোও দিতে পারিনি। আমি তো কোনো সংগঠনের সঙ্গে আসিনি, তাই মানুষের ভিড় ঠেলে কফিনের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি।’

বেলা তখন দু’টা। ততক্ষণে হয়তো নায়করাজের মরদেহ আজাদ মসজিদে পৌঁছে গেছে। কিন্তু শহিদ মিনারের ভিড় একটুও কমেনি। সবাই ভিড় ঠেলে যেতে চাইছেন নায়কের মরদেহ রাখা বেদীটিতে। তারা জানেন, এই প্রতীকী বেদীতে নায়কের মরদেহ নেই। তাতে কী? একটু আগেই তো এখানে তিনি কফিনের ভেতর শুয়ে ছিলেন।

পোস্তগোলা থেকে এসেছেন মরিয়ম বেগম। বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। অগণিত মানুষের ভিড় ঠেলে যেতে চাচ্ছেন প্রতীকী বেদীটির দিকে। ছুঁয়ে দেখতে চান বেদীটি।

তিনি আরটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের সময়ে নায়ক বলতে রাজ্জাককেই বুজতাম। তার ছবি অনেকবার হলে গিয়ে দেখেছি। তখন তো সবার ঘরে ঘরে টিভি ছিলো না। কোনো ছবির নাম মনে আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক বয়স হইছে, ছবির নাম মনে নাই। তবে নায়ক রাজ্জাকের কথা স্পষ্ট মনে আছে। তার হাসি, তার চাহনির কথা মনে হলে এখনো বুকটা কেমন করে ওঠে। সেইসব দিন কি আর আছে? তিনি আরো বলেন, এখন আমার নাতি-নাতনিরা কিসব ছবি দেখে, ভালো লাগে না। রাজ্জাক সাবের মতো নায়ক আর হবে না।’

মরিয়মের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই প্রতীকী কফিনের দিকে এগিয়ে আসেন হিজাব পরিহিত এক নারী। তার আশপাশে শ’খানেক মানুষ। সবাই তার কাছাকাছি যেতে চাইছেন। সব ক্যামেরা তার দিকে তাকানো। ভিড় ঠেলে একপলক দেখেই চেনা গেল মানুষটিকে। ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছেন রাজ্জাকের এক সময়ের নায়িকা রোজিনা। যানজটের কারণে সঠিক সময়ে আসতে পারেননি। যে কারণে প্রতীকী বেদীতেই শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হলো।

পরে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, রাজ্জাক ভাই শুধু আমার নায়কই নন। তিনি আমার শিক্ষকও। প্রথম তার সাথে অভিনয় করার সময় আমি ভয়ে কাঁপছিলাম। তিনি আমার কাছে এসে বললেন, ভেব না তুমি পারবে রোজিনা। তোমাকে দিয়ে হবে। তিনি আরো বলেন, রাজ্জাক ভাইর মতো অভিনেতা আর আসবে না। রাজ্জাক বাংলা চলচ্চিত্রে একজনই।

নায়করাজ রাজ্জাকের প্রতি এই ভালোবাসা শুধু রোজিনা, আঙুর বালা, আফসানা, মরিয়মের নয়। এমন হাজারো মরিয়ম আর আঙুরবালাদের হৃদয়ে স্থান করে আছেন মহান এই কিংবদন্তি।

আমরা জানি না কফিনে শুয়ে থাকা মানুষের কাছে পৃথিবীর ভালোবাসা পৌঁছায় কিনা? তবু একটি কথা আমরা রক্তাক্ত বুক নিয়ে বলতেই পারি- ‘নায়করাজ তোমাকে ভালোবেসে অঝরে কেঁদেছে ভাদ্রের আকাশ। ভালোবাসা আর বিষাদে স্তব্ধ হয়েছে ‘এফডিসি’ থেকে ‘শহিদ মিনার’।

জেবি/সি/এমকে

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিনোদন এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh