• ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
logo

বটতলার অসাধারণ প্রযোজনা : শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্ণেল

শাহরিয়ার মাহমুদ প্রিন্স

  ২০ জুলাই ২০১৭, ২০:৩৫

এক

শাহাদুজ্জামান আমাকে চমৎকৃত করেন; খুবই প্রামাণ্য তার কথাশিল্পের উপকরণ। ইতিহাসের পটভূমিকে তিনি গদ্যে আনেন অদ্ভূত এক ভালোবাসায়, মুগ্ধ করে রাখেন তার পাঠকদের। সাহিত্যকে এমন একনিষ্ঠ চিত্তে, ভক্তিতে, দরদে এবং গভীরতম মমতায় ঘিরে রাখবার কৌশল সবার থাকে না, শাহাদুজ্জামান পেরেছেন। নিমগ্ন রেখেছেন তার পাঠককূলকে।

শাহাদুজ্জামান সত্যের সহযোগে থাকেন সর্বদা। অনিবার্যভাবে তাই তার কথাশিল্প সত্য প্রকাশের এক দালিলিক প্রমাণের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। কুট রাজনীতিবিদ ও অপরাজনীতির নোংরা ইতিহাস বিনষ্টকরণ কৌশলকে তীক্ষ্ম এবং তীব্রভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি অনবদ্য সত্য প্রকাশকে উপজীব্য করে তোলেন তার রচনায়।

শাহাদুজ্জামানের এমনই এক কথাশিল্পের নাম ‘ক্রাচের কর্ণেল’। পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধ শাহাদুজ্জামান ইতিহাস অনুসন্ধান করে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ করে ক্রাচে ভর করে চলা এক অদম্য দেশপ্রেমী সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল তাহেরের জীবনচিত্র এঁকেছেন এ উপন্যাসে। নিঁখুত প্রমাণ ও সমকালীন রাজনীতির ধারাবাহিকতাকে একটা ফ্রেমে এনে ব্যতিক্রমী মানুষ কর্ণেল আবু তাহেরকে তিনি পাঠকের সামনে হাজির করেছেন।

প্রায় ৪০ বছর ধরে যে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বির্তকিত করা হয়েছে- যার অসামান্য অবদানকে অস্বীকার করে ইতিহাস থেকে উহ্য করে রাখা হয়েছে- সেই অমিত তেজ্বদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তাহেরকে লেখক ইতিহাসের স্বার্থেই প্রকাশ করেছেন। প্রকাশিত হয়েছে তাহেরকে নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে চলমান অমীমাংসিত বির্তকিত অসংখ্যা প্রশ্নের যর্থাথ সমাধান। খুঁজে পাওয়া গেছে ক্রাচের কর্ণেলের সময়কে, স্বপ্নকে এবং আকাংখাকে।

ক্রাচের কর্ণেল সম্পর্কে শাহাদুজ্জামান জানান, ষাট দশকে যখন পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রী ধারায় বিশ্ব বিভক্ত তখন তৃতীয় বিশ্বের অগনিত তরুণ-তরুণী সমাজ পরিবর্তন করে একটি বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর ছিলো। এ তারুণ্যই নানামুখী কর্মযজ্ঞে সমাজতন্ত্র কায়েমের ক্ষেত্র প্রস্তুতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কর্ণেল আবু তাহরে ছিলেন সেই প্রজন্মের এক অকুতভয় লড়াকু।

কৈশরেই তিনি মাক্সীয় ভাবধারায় তাড়িত হয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম বা প্রতিষ্ঠার তাবিজ বুকে ধারণ করেছিলেন। যোগদিয়েছিলেন রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। এখানে তার তেজদ্বীপ্ত নেতৃত্ব, তীক্ষ্ণমেধা এবং সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের দৃঢ়তা পাক সেনা মহলেও প্রশংসিত ছিলো। তারপর যখন অপারেশন সার্চ লাইটের নামে ঢাকায় নিষ্ঠুর গণহত্যা শুরু হলো কর্ণেল আবু তাহের এক দুঃসাহসিক অভিযানের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্ট থেকে তখন পালিয়ে এসে যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে দুধর্ষ এক অপারেশনে হারালেন একটি পা। ক্রাচে ভর করেই স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে কাজ শুরু করেছিলেন তাহের। সেনাবাহিনীকে পিপুলস আর্মি হিসেবে ভাবতে ভালোবাসতেন তিনি। আর এ জন্যই ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে পড়েছেন বহুবার।

জাতির ক্রান্তিকালে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অপশক্তির হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে সাধারণ সিপাহীদের নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন এক ব্যতিক্রমী অভ্যূত্থানের। মুক্ত করেছেন জেনারেল জিয়াকে। কিন্তু নিষ্ঠুর নির্মম জিয়া এ অভ্যূত্থানের নায়ককেই উপমহাদেশের ঘৃণিত এক রাজনৈতিক ফাঁসির মধ্য দিয়ে হত্যা করে।

শাহাদুজ্জামান এখানেই থেমে থাকেননি। একজন সচেতন রাজনৈতিক পর্যাবেক্ষক হিসেবে তিনি কর্ণেল তাহেরকে ঘিরে জন্ম নেয়া নানা কুয়াশা সরিয়ে প্রামাণ্য এবং দালিলিক সত্যটি উম্মোচন করেছেন। উম্মোচনের এ কাজটি শুধু পাঠকের প্রতি লেখকের দায়বদ্ধতা দিয়ে ভাবলে চলবে না- এটি বরং আমাদের ইতিহাসের অমীমাংসিত ঘটনার প্রামাণ্য উদাহরণ হিসেবে দেখা উচিত।

‘ক্রাচের কর্ণেল’ পড়ে মনে হতে বাধ্য হয়েছি, অন্তর জুড়ে যে জ্বালা ছিলো-শাহাদুজ্জামান সেই জ্বালাকে নেভানোর জন্য ইতিহাস ও রাজনীতির শেকড়ের সন্ধানে গিয়ে প্রকাশ্য, প্রচ্ছন্ন নানা চরিত্রকে ঘটনাকে খুঁড়ে বের করেছেন। আর এ খননের কাজ খুব নিমগ্নচিত্তে করেছেন- শাহাদুজ্জামান। মুগ্ধ হয়েছি, খুব মুগ্ধ হয়েছি।

দুই

শাহাদুজ্জামান ‘ক্রাচের কর্ণেল’ এখন মঞ্চে। এমন প্রামাণ্য ইতিহাস নির্ভর আখ্যানকে মঞ্চে এনে দর্শক উপজীব্য করার কাজটি নিঃসন্দেহে একটি জটিলতম উদ্যোগ। আর এ জটিলতম উদ্যোগটি খুব সফলতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে নাটকের দল বটতলা।

বহু বিতর্কিত ও অসীমাংসিত ঘটনার কালপর্বে সংঘটিত নানাবিধ রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত এবং এক অকুতভয় দেশপ্রেমী কর্নেলের আত্মভাবনা ও জীবনচিত্র এ নাটকে উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের সেই ক্রান্তিকালে নানা চরিত্রের উত্থান ও সেই সব চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্ব এবং মতাদর্শিক অবস্থানের নিখুঁত চরিত্রায়ন ঘটেছে এ নাটকে। মূল কাহিনির প্রমাণ্য তথ্যকে অবিকল রেখে এখানে স্বরচিত কোনো বিবরণ অনুসৃত হয়নি বলে একে মৃত্তিকাসংলগ্ন প্রযোজনায় মনে হয়েছে।

‘ক্রাচের কর্ণেল’র নাট্যরূপ দিয়েছেন সৌম্য সরকার এবং অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা, নিদের্শনা মোহাম্মাদ আলী হায়দার, এরা সকলেই রাজনৈতিক মতাদর্শে সম্ভবত: বামপন্থী ভাবধারায় বিশ্বাসী। এজন্য তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, অসম্প্রদায়িতক চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের আর্দশ অগ্রসর সমাজ ভাবনা এবং তীক্ষ্ম ও উদ্ভাবনী চিন্তা নাটকের মঞ্চকে ঘিরে রেখেছে। তাই আমার বিশ্বাস এ নাটক দর্শকে শিহরিত করবে, আলোড়িত করবে দর্শক সত্ত্বাকে।

মঞ্চভাবনা, পোষাক, কোরিওগ্রাফি, আলো এবং আবহ সঙ্গীতের সমম্বয়ে এ নাটক শাহাদুজ্জামানের কথাশিল্পের কালটিকে স্পর্শ করতে চেয়েছে। মোটামুটিভাবে তারা যে সার্থক হয়েছে তা বলা বাহুল্য। হয়তো বাংলাদেশের মহড় ব্যবস্থার দীনতা না থাকলে বটতলা তাদের প্রয়োজনাটিকে আরো উৎকর্ষে নিতে পারতো।

নাটকের নির্দেশক মোহাম্মদ আলী হায়দার কর্নেল তাহেরের চরিত্রটিকে উপস্থাপনে বীরোচিত ও তেজদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবিটি সফলভাবে দেখাতে পেরেছেন। ১২ জন অভিনয় শিল্পীর বিপুল শারীরিক শ্রম ও কসরত আছে এ নাটকে। সেটিও খুব স্পট করে দেখা যায়। অভিনয়ে মুন্না, রুমা, নিত্রা, তৌফিক, বাকীরুল, পংকজ, ইভান, সাঈদ, বিন্দু, রনি, মাসুম ও নাফিউল প্রশংসনীয় কাজ করে দক্ষতা দেখিয়েছেন।

তবে খুব ধন্যবাদ দিচ্ছি কাজী রুমা, নিত্রা ও মুন্নাকে। এক কথায় বলি, খুব কাঁদিয়েছেন আপনার- এমনটা আর করবেন না।

আবহ সঙ্গীতের দায়িত্ব নিয়ে সফলকাম হয়েছেন পিন্টু। নিত্রা কোরিওগ্রাফ নিজে করেছেন। এ নাটকের তিন মাধ্যমে তাকে খুঁজে পাই– অভিনয়, নাট্যরূপ দান এবং কোরিওগ্রাফি। নিত্রা কোনো কাজ করলে সেখানে গামছা বেঁধে নেমে পড়েন। মানিক্য উদ্ধার না করে তিনি ফেরেন না, করেছেনও তাই এখানে।

কয়েকটি বিষয়ে একটু সদয় দৃষ্টি দিতে বলবো নাট্য নির্দেশক মোহাম্মদ আলী হায়দারকে। বিভৎস খুনি নরখাদক মুস্তাকের চরিত্রটির রূপায়ন ঘটেছে একটি ফানি ক্যারেক্টর হিসেবে। ইতিহাসের প্রামাণ্যকরণে এই খুনি চরিত্রটির নিষ্ঠুরতা ও নির্মম তৎপরতাকে একটু গভীর ভাবে প্রকাশ করা বাঞ্চনীয় ছিলো।

বুদ্ধিজীবীদের নাম বলবার সময় মনে হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম ছুটে গেছে। এ বিষয়ে একটু লক্ষ করবেন।

নাটকের শেষের দিকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় কর্ণেল তাহের পক্ষের প্রধান আইনজীবী জনাব আতাউর রহমান খানের সঙ্গে গাজিউল হক, জুলমত আলী খান, আমিনুল হক, সিরাজুর হকের নাম অন্তত: একবার করে হলেও উচ্চারিত হওয়া উচিত ছিলো। কর্ণেল তাহেরের পক্ষে এরাই তো আদালতে লড়েছিলেন- মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।

সবমিলিয়ে অসাধারণ এক প্রযোজনা ক্রাচের কর্ণেল। ধন্যবাদ বটতলাকে এমন একটি প্রামাণ্য কথাশিল্পকে মঞ্চে আনবার জন্য। তরুণ্য নিশ্চয় আপনাদের কাজকে খুঁজে খুঁজে বের করবে। নাটক দেখবে, ইতিহাসকে জানবে, খুঁজে পাবে শেকড়কে। আর তখনই বটতলা সত্যিকার অর্থেই সার্থক হয়ে উঠবে নামে ও কাজে।

(প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। আরটিভি অনলাইনের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এই লেখাটির জন্য আরটিভি অনলাইন কর্তৃপক্ষ লেখকের লেখার বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের দায় নেবে না)।

এইচএম

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিনোদন এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh