• ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
logo

অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

আরটিভি অনলাইন ডেস্ক

  ২৩ অক্টোবর ২০১৮, ১২:২৫
ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশকে একসময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। তার ওই অপবাদ অনেক আগেই ঘুচিয়েছে বাংলাদেশ। এরপরও ভারতের সাথে বাংলাদেশকে প্রায়ই তুলনা দেয়া হতো। বলা হতো, বাংলাদেশ হলো ভারতের গরিব ও পিছিয়ে পড়া প্রতিবেশি।

কিন্তু গত কয়েক বছরে চিত্র পাল্টে গেছে। বাংলাদেশ এখন আর গরিব-পিছিয়ে পড়া প্রতিবেশি নয়, বরং বিভিন্ন সূচকে ভারতের চেয়ে এগিয়েছে ছোট এই দেশটি। ফলে ভারতীয় অর্থনীতিবিদরাও বাংলাদেশের প্রশংসা করছেন এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রাখছেন।

চলতি মাসে ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য প্রিন্টের এক প্রতিবেদনেও এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশ ইজ বেটার অব দ্যান ইন্ডিয়া, নট অ্যা পুওর, বেকওয়ার্ড নেইবর অ্যানিমোর’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হলো-

দ্রুত বর্ধনশীল অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশ ভারত। দেশটিকে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তির কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু দ্রুতই এই অবস্থা পাল্টে যেতে পারে।

ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সামাজিক সূচকে এগিয়ে থাকা ভারতের প্রতিবেশি বাংলাদেশ অর্থনীতিতেও নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পূর্বাভাস বলছে, ২০১৮-১৯ সালে ভারতের ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে যাচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর ওই সময়ে ভারতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ।

বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের তুলনায় ৩ গুণ দ্রুততার সাথে বাড়ছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন শীর্ষক সম্মেলনে বলা হয়, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ভারতের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ। একই সময়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩৯ শতাংশ।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, আগামী দুই বছর মোট জাতীয় আয় (জিএনআই) ও জিডিপি বৃদ্ধির এই গতি ধরে রাখতে পারলে ২০২০ সালের মধ্যে ভারতের মাথাপিছু আয়কে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ।

দীর্ঘ পথচলা

পাকিস্তানের সবচেয়ে গরিব অঞ্চলগুলোর একটি থেকে জন্ম বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসেছে দেশটি।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল নিম্নগামী। যার পরিমাণ ছিল মাইনাস ১৪ শতাংশ। দুই বছর পর ৯ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে দুর্দান্ত গতিতে এগোতে থাকে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্ভিক্ষের কারণে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ মারা যাওয়ায় আবারও অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়ে। তখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাইনাস ৪ শতাংশে নেমে যায়।

দুর্ভিক্ষের পর আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তার সাহায্য নিয়ে নতুন করে উন্নয়ন শুরু হয়। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও এগিয়ে আসে। এ সময় উচ্চ ফলনশীল ধান ও গম চাষ শুরু হওয়ায় কৃষিতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়ে যায়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এখন বাংলাদেশ রোলমডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ যেমন নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাখাতে গুরুত্ব দেয়ায় এ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।

ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অর্থনীতিবিদ ও সিনিয়র ফিলো জয়শ্রী সেনগুপ্তা বলেন, রেমিটেন্স ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতি এতটা শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। এছাড়া তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ভারতের মতো বাংলাদেশও একটি শ্রমবহুল দেশ। কিন্তু ভারতের মতো এখানে শক্ত শ্রম আইন নেই। স্বাধীনতার আগে ১৯৪৭ সালে ভারতে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপুটস অ্যাক্ট’ পাস হয়। এতে কর্মজীবী ও শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়।

ভারতের মতো পাকিস্তানেও এই আইন পাস হয়। কিন্তু তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের ট্রেড ইউনিয়নের সাথে মত পার্থক্যের কারণে ১৯৫৮ সালে আইনটি বাতিল করে সামরিক সরকার। পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার পরও এই আইনটি বাংলাদেশের ছিল না। যা দেশকে সস্তা শ্রমের আবাসভূমি হিসেবে গড়ে তুলতে ও কারখানার বিস্তৃতিতে সহায়তা করে।

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় পরিচালন শক্তি হচ্ছে এর গার্মেন্টস শিল্প। এতে সব মিলিয়ে ৪৪ লাখ মানুষ কাজ করছে; যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৭ শতাংশ। গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করা ৪৪ লাখের ৩০ লাখই নারী। সস্তা শ্রমের কারণে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করতে পারছে বাংলাদেশ।

বর্তমান ভারত

তেলের দাম বৃদ্ধি, রপ্তানিতে মন্দাভাব এবং মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় ভারতের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে এশিয়ার মধ্যে রুপির মান সবচেয়ে কমে যায়। দেশটির ইতিহাসে এই প্রথম ডলারের বিপরীতে রূপির মূল্য ৭৪-এ নেমে আসে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সিনিয়র অর্থনৈতিক কর্মকর্তা অভিজিত সেনগুপ্ত বলেন, এই অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে আমরা ৮ দশমিক ২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। গত বছরের শক্ত অবস্থানের কারণে এটা সম্ভব হয়। পরবর্তী ত্রৈমাসিকগুলোতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমবে।

সেনগুপ্তা বলছেন, ভারত যদি বাংলাদেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চায় তাহলে অবকাঠামো, উৎপাদন, সেবাখাত এবং রপ্তানি আরও গতিশীল করতে হবে। তার ভাষায়, উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখতে রপ্তানির পাশাপাশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

সামাজিক পদক্ষেপ

সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বিশেষ করে গড় আয়ু, নবজাতকের মৃত্যুহার এবং লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধন করেছে বাংলাদেশ। মেডিকেল জার্নাল দ্য লেনসেটে প্রকাশিত ‘হিউম্যান ক্যাপিটাল’ নামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই ক্ষেত্রগুলোতে বাংলাদেশের নিচে তলানিতে অবস্থান করছে ভারত।

মানব সম্পদের উন্নয়ন পরিমাপ করতে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে ১৯৫টি দেশের ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যকার তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে নবজাতক মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৭। ভারতে এই হার ৩২। বাংলাদেশে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৫৮ বছর যেখানে ভারতের গড় আয়ু ৬৮ দশমিক ৮ বছর।

বাংলাদেশের আরও একধাপ উন্নয়ন

বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীদের ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ ডিজিটাল ট্রানজেকশন করেছে। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ায় এই হার গড়ে ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ।

জিডিপি প্রতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যয় ভারতের চেয়ে কম। তারপরও শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন পদ্দক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।

প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া মেয়েদের উপবৃত্তিসহ স্কুলজীবনের সব পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। নারীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জোরদারের অংশ হিসেবে ৪ থেকে ৬ মাসের বেতনসহ মার্তৃকালীন ছুটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া তালাকপ্রাপ্ত ও নিঃস্ব নারীদের জন্য বরাদ্দ দিচ্ছে সরকার।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে ৭০ শতাংশ এবং মৎস্যশিল্পে ৬০ শতাংশ নারী কাজ করছে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। ২০১৬ এবং ১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) র‍্যাংকিংয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জেন্ডার সমতা বিধানে শীর্ষস্থানে রয়েছে দেশটি।

দারিদ্র্য বিমোচনেও অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এখানে সাফল্য দেখিয়েছে ভারতও। রাজনীতিতে নারীদের উপস্থাপনে ডব্লিউইএফ সূচকে ৭ নম্বর অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারত এখানে রয়েছে ১৫ নম্বর অবস্থানে।

এর কারণ হলো বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ৩৫০ আসনের মধ্যে ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ মোট আসনের ১৪ শতাংশ নারীদের জন্য সংরক্ষিত। অন্যদিকে ভারতে ২০১৪ সালে ৫৪৩ জন সাংসদের মধ্যে ৬২ জন নারী নির্বাচিত হন, যা মোট আসনের ১১ শতাংশ। দেশটিতে এখনও পর্যন্ত নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ আইন আলোর মুখ দেখেনি।

উন্নয়ন বিষয়ক অর্থনীতিবিদ ড. একে শিভকুমার বলেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের গড় আয়ু বেড়েছে ও শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। ১৯৯০ এর দশকে এটা এমন ছিল না। তার মানে এক্ষেত্রে উন্নয়ন করেছে বাংলাদেশ।

অন্য এক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের মেয়ে ও নারীরা যে স্বাধীনতা ভোগ করে এই কারণে সামাজিক পরিবর্তন এসেছে যা ভূমিকা রাখছে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে।

কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বলছেন, বাংলাদেশের এই উন্নতিতে বেসরকারি খাতের উদ্যোগও ভুলবার নয়।

খোলা জায়গায় মলত্যাগের ঘটনা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য ২০১৭ সালে থেকে প্রশংসিত হয়ে আসছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে সমস্যাটি সমাধানে হিমশিম খাচ্ছে ভারত। ২০০৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে খোলা জায়গায় মলত্যাগের পরিমাণ ৪২ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নেমে এসেছে।

আরও পড়ুন :

ডি/এসআর

মন্তব্য করুন

daraz
  • অর্থনীতি এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
মিশা-ডিপজলকে জয়ের মালা পরিয়ে দিলেন নিপুণ (ভিডিও)
শিল্পী সমিতির নির্বাচনে জিতে যা বললেন মিশা সওদাগর
নির্বাচনে জিতে যা বললেন ডিপজল (ভিডিও) 
নির্বাচনে হেরে যা বললেন নিপুণ
X
Fresh