• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

আবগারী শুল্ক চান না ব্যাংক গ্রাহকরা

মিথুন চৌধুরী

  ০৫ জুন ২০১৭, ১৫:৪০

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে আবগারী শুল্ক আগেও কাটা হতো, কিন্তু বুঝতেন না অথবা জানতেন না গ্রাহকরা। প্রস্তাবিত বাজেটে বিষয়টি জানার পর রীতিমত সমালোচনার ঝড় চলছে সভা, সেমিনার, সামাজিক মাধ্যমে। বাড়তি টাকা গুনতে হবে এ নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে নতুন শঙ্কা। অনেকের ধারণা, প্রতি লেনদেনে কাটা যাবে কষ্টার্জিত টাকা। ডিপিএসে (মেয়াদি হিসাব) সঞ্চিত অর্থের ওপর প্রতিবছরে ক’বার টাকা কাটা হবে তা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে।

মতিঝিল শাখার সোনালী ব্যাংকে আবগারী শুল্ক নিয়ে জানতে এসেছেন গার্মেন্টস কর্মী রোকসানা বেগম। সন্তানের পড়ালেখার জন্য এ ব্যাংকে ১ হাজার টাকা করে ৫ বছর মেয়াদের ডিপিএস করেছেন তিনি।

রোকসানা বেগম জানালেন, তিনি কমলাপুরের একটি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানে হেলপার হিসাবে কাজ করেন। ওভারটাইমসহ মাসে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা আয় হয়। তাতে কোনোমতে জীবন জীবিকা নির্বাহ করেও বেতন পাবার সঙ্গে সঙ্গে আগে তিনি ডিপিএসের টাকা দিয়ে পরা সংসারের হিসাব করেন। এতদিন তিনি জানতেন না তার হিসাব থেকে বছরে সরকার টাকা কেটে নেয়। প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর সহকর্মীদের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন ব্যাংকে টাকা রাখলে টাকা কেটে নেয়া হবে তাই তিনি ব্যাংকে জানতে এসেছেন এ বিষয়ে। কিন্তু ব্যাংকে এসে শুল্কের বিষয়টি জানতে রীতিমত কাঁদো কাঁদো অবস্থা তার। চোখে মুখে তার বিষাদের ছায়া।

সোনালী ব্যাংকে আবগারী শুল্ক নিয়ে খোঁজ নিতে এলেন অপর গ্রাহক শাহিদুল ইসলাম। জানালেন, পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তিনি। মতিঝিল এজিবি কলোনীতে তার মুদি দোকান রয়েছে। ব্যাংকে তার তিনটি বিভিন্ন মেয়াদের ডিপিএস (মেয়াদি হিসাব) রয়েছে। তার বেশিরভাগ ডিপিএসের মেয়াদ শেষ হতে বসেছে। আবগারী শুল্ক কি তিনি জানতেন না। অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশের পর পত্রিকা পড়ে বিষয়টি জানতে পারেন তিনি। তাই সব খোঁজ নিতে ব্যাংকে এসেছেন।

শাহিদুল আরো জানালেন, ব্যবসায় টাকা কম বিনিয়োগ করে সঞ্চয় করেন। সঞ্চয়ের জন্য তিনি বাড়তি খরচও করেন না। কিন্তু সরকার এতদিন টাকা কেটে নিয়েছে। সামনে আরো বেশি কাটবে শুনে তিনি রীতিমত হতাশ হয়ে পড়েন।

গ্রাহকরা বলছেন, ব্যাংকে কষ্টে অর্জিত সঞ্চয় করে রাখা হয় মোটা অংকের টাকা ও বাড়তি কিছু অর্থের প্রত্যাশায়। কিন্তু তার উপর যদি সরকার টাকা কেটে নেয় তাহলে ব্যাংকে টাকা রেখে লাভ কি ? মাটির ব্যাংকে টাকা রাখাই উত্তম।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চলতি বাজেট (২০১৬-১৭) অনুযায়ী ব্যাংক হিসাবে ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত থাকলে তার ওপর ১৫০ টাকা আবগারী শুল্ক দিতে হচ্ছে।

এদিকে গেল বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রীর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত শুল্ক থাকলে তা শুল্কমুক্ত করা হয়েছে। যেকোন সময় ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা দিলে বা তুললে ৮০০ টাকা আবগারী শুল্ক কেটে রাখা হবে। যা চলতি বাজেটে(২০১৬-১৭) রাখা হয় ৫০০ টাকা।

এছাড়া ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত কোনো হিসাবে জমা দিলে বা তুললে ২ হাজার ৫০০ টাকা কেটে রাখা হবে। যা চলতি বাজেটে (২০১৬-১৭) রাখা হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা হিসাবে থাকলে ১২ হাজার টাকা কেটে রাখা হবে। যা চলতি বাজেটে (২০১৬-১৭) রাখা হয় সাড়ে ৭ হাজার টাকা। ৫ কোটি টাকার বেশির ক্ষেত্রে কেটে রাখা হবে ২৫ হাজার টাকা, যা চলতি বাজেটে (২০১৬-১৭) রাখা হয় ১৫ হাজার টাকা। মেয়াদি হিসাবের (ডিপিএস) ক্ষেত্রে প্রতিবছর জমা হওয়া টাকার পরিমাণের ওপর আবগারি শুল্ক একই হারে কাটা যাবে।

মূলত আবগারী শুল্ক এক ধরনের পরোক্ষ কর যা দেশজ উৎপাদনের ওপর আদায় করা হয়ে থাকে। দেশের ভেতর উৎপাদিত পণ্য কারখানা থেকে খালাসের সময় এই শুল্ক আদায় করা হয়। বাংলাদেশে আবগারী ও লবণ আইন ১৯৪৪ সালে আওতায় আবগারী শুল্ক আদায় করা হয়ে থাকে। জাতীয় সংসদে বিভিন্ন পণ্যের ওপর আরোপণীয় আবগারী শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে আদায়যোগ্যে তথা কার্যকর শুল্ক হার নিরূপণ করে। বাংলাদেশে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে মূল্য সংযোজন কর ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং পর্যায়ক্রমে অধিকাংশ পণ্যের ওপর আবগারী শুল্ক রহিত করে মূল্য সংযোজন কর আরোপ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মানুষকে ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে বিরত রাখতেই এ আবগারী শুল্ক। গরিবের সম্পদ হচ্ছে কিছু নগদ টাকা। সেটি বড়জোর ১ লাখ থেকে তিন-চার লাখ টাকা হতে পারে। এটা গরিবের তিলে তিলে সঞ্চয়, বোনাস কিংবা বাড়তি কষ্টের ফসল। বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় এটা খুবই কম। ফলে তিনি ওই অর্থ দিয়ে কোনো সম্পদ কিনতে পারেন না। এ অর্থের সঙ্গে বাড়তি কিছু পাওয়ার আশায় তারা ওই অর্থ ব্যাংকে রাখেন। এর জন্য ওই টাকার মালিককে যথেষ্ট সম্পদশালী বলাটা একটা অদ্ভুত বিষয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন বলেন, বেশি সমালোচিত হবার আগেই প্রস্তাবিত শুল্ক প্রত্যাহার করা ভালো হবে। কোনো বিবেচনায় ব্যাংকের আবগারী শুল্ক বাড়ানো হলো তা বোধগম্য না।

এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, মূলধন গঠন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তথা সামগ্রিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য গ্রাহকরা ব্যাংক লেনদেন করে থাকেন। বাজেটে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখার ক্ষেত্রে আবগারী শুল্ক বিভিন্ন হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে আমানতকারী আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হবে। এছাড়া অর্থ ব্যাংক চ্যানেলে না গিয়ে ইনফরমাল চ্যানেলে চলে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আবগারী শুল্ক ও বিভিন্ন সাব সার্জ, যেগুলো জনগণের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে সেগুলো প্রত্যাহার করা উচিত।

অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে এক লাখ টাকা পর্যন্ত শুল্ক জিরো শতাংশ করা হয়েছে। ব্যাংকে যাদের এক লাখ টাকার ওপর আমানত আছে শুধুমাত্র তাদের আমানতের ওপরই ৩০০ টাকা আবগারী শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ ব্যাংকে যাদের আমানত আছে তাদের ৮০ শতাংশেরই আমানত এক লাখ টাকার নিচে। এ হিসাবে তারা শুল্ক থেকে উল্টো রক্ষা পেত। তারপরও যেভাবে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে তাতে বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। জাতীয় সংসদে নিশ্চয়ই এটা নিয়ে আলোচনা হবে। সেখানে বিষয়টি নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলব।

সোমবার সংসদে ব্যাংক হিসাবে আবগারী শুল্ক না বাড়িয়ে আগের হার বহাল রাখার দাবি জানিয়েছেন সরকারদলীয় হুইপ শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারী শুল্ক নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। গ্রামের মানুষ এক লাখ, দুই লাখ টাকা ব্যাংকে জমা রাখেন। এখন আতঙ্ক ছড়িয়েছে যে আমানতের টাকা কেটে নেয়া হবে। তাই আবগারী শুল্ক যেন আগের মতই থাকে এ আহ্বান জানাচ্ছি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের(টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আবগারী শুল্ক বাড়ানোর কারণে কালো টাকার বিস্তার ঘটবে। তাই আবগারী শুল্ক প্রত্যাহার করা উচিত।

এমসি/এইচএম

মন্তব্য করুন

daraz
  • অর্থনীতি এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh