• ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
logo

ঈদ নেই হাওরপাড়ে, শিশুদের বায়না মেটাতে পারছেন না অভিভাবকরা

আবেদ মাহমুদ চৌধুরী, সুনামগঞ্জ

  ২৬ জুন ২০১৭, ১০:১০

হাওরের জেলা সুনামগঞ্জ। এখানের কৃষকরা একমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। বোরো ধানের ফলন ভালো হলে সচ্ছলতা থাকে কৃষক পরিবারে। আর বোরো ফসলহানি ঘটলে বিপাকে পড়েন তারা। ধান না পেলে পরিবারের লোকজনকে নিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।

এ বছর হাওরপাড়ে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, তেমনটি আগে কখনো ঘটেনি। বাঁধ ভেঙে ফসলহানির প্রভাব পড়েছে প্রতিটি পরিবারে, যা শিগগিরই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। এই দুর্যোগে হাওরপাড়ের প্রতিটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।

কৃষকদের মতো জেলেরাও পড়েছেন বিপাকে। তাদের দিন কাটছে অর্ধাহার-অনাহারে। হাওরে বা নদীতে মাছ না পেয়ে জেলেদের এখন ঘরে বসেই দিন কাটাতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় ঈদের আনন্দ যেন হাওরবাসীর স্বপ্নের মতো। ঈদ উপলক্ষে সরকারি সাহায্য দেয়ার কথা বললেও কোনো সাহায্য পায়নি বলে অভিযোগ করেন হাওরবাসী।

এদিকে মৎস্যজীবীরা কেউ কেউ পেটের তাগিদে হয়েছেন দিনমজুর বা রিকশাচালক। তারা সরকারি কোনো প্রকারের সাহায্য পাচ্ছেন না।

জেলেরা জানান, নদীতে গেলে মাছ পান না তারা। ঘরে ছেলেমেয়ের খাবার ও সংসারের খরচাপাতি নিয়ে মহাবিপদে আছেন। একটি বছর কিভাবে সংসারের খরচ জোগান দেবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না তারা। তাদের জেলে কার্ড থাকলেও এ পর্যন্ত কোনো সরকারি সাহায্য পাননি। ৪৮ হাজার জেলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৮ হাজার জেলে পেয়েছেন ডিজিএফ কার্ড। আর বাকি জেলেরা কোনো সহায়তা পাবেন কি না তা তারা নিজেরাও জানেন না।

কুতুবপুর গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কর্জ (ঋণ) করে টাকা এনে ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন কাপড় কিনেছি। যে বছর বোরো মৌসুমে ভালো ধান হয় সে বছর আনন্দ বেশি হয়। গ্রামের হাটবাজার থেকে পরিবারের সদস্যদের জন্য কেনা হয় নতুন জামা-কাপড়। এ বছর ঘরে ধান নেই, তাই আনন্দও নেই।

রাজপুর গ্রামের আছিয়া বেগম বলেন, ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। আমরা বড়রা বুঝি, কিন্তু বাচ্চারা তো বোঝে না। বার বার ঈদের কাপড়ের জন্য বায়না ধরছে।

জেলার সিংহভাগ লোক কৃষিজীবী। তাই ঈদ আনন্দ থেকে বঞ্চিত জেলার অধিকাংশ মানুষ। তাদের পাশে বলতে গেলে কেউ নেই। ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে গ্রামে গ্রামে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা গেলেও তা খুবই অপ্রতুল।

ফসলহানির শিকার মানুষের কান্না বাতাসে শুধুই হাহাকার ছড়ায়। সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে, অনিশ্চয়তার অন্ধকারে তাদের দিনরাত একাকার। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ধামপাড়া গ্রামের কৃষাণি আমেনা বেগম বলেন, খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকাই আমাদের একমাত্র স্বপ্ন। এ বছর অতিরিক্ত কোনো চাহিদা নেই। আমাদের একটাই চাহিদা, আমরা যেনো খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতে পারি।
সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের গ্রামগুলোতে নতুন কাপড়, নতুন জামা কেনা তো দূরের কথা, সামান্য পিঠা, পায়েস, সেমাই কেনার অর্থও জোগাড় করতে পারেনি পরিবারের। হাওরপাড়ের গ্রামগুলোতে কোনো কোনো মা সন্তানের সান্ত্বনার জন্য সামর্থবানদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরান কাপড় সংগ্রহ করছেন।

করচার হাওর পাড়ের উপজেলা বিশ্বম্ভরপুর। উপজেলা সদরের লাগোয়া গ্রামের নামও বিশ্বম্ভরপুর, এর পাশেই রাধানগর গ্রাম। দুই গ্রামে ১৫০ পরিবারের বাস। ১৫০ পরিবারের বেশিরভাগেই প্রান্তিক কিংবা বর্গা চাষি। মধ্যবিত্ত এবং বড় কৃষকও রয়েছেন কয়েকজন।

এ গ্রামের কৃষকরা বললেন, এবার কেবল এই দুই গ্রাম নয়, পুরো হাওরবাসী’র একই অবস্থা। ধনী কিংবা প্রান্তিক কৃষক নয়, সকলেই এবার ফসল হারিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত। চৈত্র মাসে হাওর ডুবায় এবার সকলের ধানের গোলা একইভাবে শূন্য। একমুঠো ধানও নেই কৃষকের। কেউ গরু বা গৃহপালিত পশু বিক্রি’র টাকায় চাল কিনছেন। কেউবা ভিজিএফ প্রাপ্তির কল্যাণে বা হাওরে মাছ ধরে বিক্রি করে ওএমএস’র চাল কিনে কোনোভাবে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছেন। ঈদের আনন্দও নেই হাওরজুড়ে।

ঈদের কেনা কাটা করেছেন কী-না? প্রশ্ন করতেই বিশ্বম্ভরপুর গ্রামের মনরুজা বেগম ও তার শাশুড়ি একসঙ্গে চোখের পানি ফেলতে থাকলেন। মনরুজা বললেন, ‘চাইর (চার) বাচ্চা, বাচ্চাদের বাবার চোখে সমস্যা, নিজে জালা খেত থাকি জালা লইয়া হাওরে গেছি, রোয়াত (রূপণে) সাহায্য করছি। ১১ কেয়ার জমিন করছিলাম, একগুটা ধানও পাইছি না। ঈদে বাইচ্চাইনতের (ছেলে-মেয়েদের) বায়দি (দিকে) চাইলে (থাকলে) কত কষ্ট লাগে বুঝানি যাইতো নায় (বুঝানো যাবে না)।’

মনরুজা’র মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী হনুফা বেগম বললো,ইবারতো ধান অইছে না। বাবাও অসুস্থ ঈদের কাপড় কেমনে দিবা?’

একই গ্রামের রেহেনা বেগম জানালেন, ৯ কেয়ার (৩ একর) জমি পানিতে ডুবেছে। ঝড়ে ঘর ভাঙছে, সৌর বিদ্যুতের প্যানেল ভেঙেছে। এখন অন্যের বাড়ি গিয়া কাজও পাওয়া যায় না। ছেলে-মেয়েদের ঈদের কাপড় দিতে পারি নাই।

হাওরপাড়ের বাজারগুলোতেও কেনা কাটায় ছিল না ঈদের আমেজ। বিশ্বম্ভরপুর বাজারের নিপামনি গার্মেন্টসের মালিক মো. সাঈদ মিয়া বলেন, আমার ১৮ বছরের ব্যবসা, ঈদের মুহূর্তে এতো কম বেচা-কেনা এর আগে কখনো দেখা হয়নি। আমরা বসে বসেই কাটাচ্ছি।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ বলেন, বয়স ৫০ প্রায়, এমন নিরানন্দের ঈদ আগে দেখি নাই। ফসলহারা মানুষের মধ্যে চাপা কান্না বিরাজ করছে। ঈদ মানেই নতুন কাপড় চোপড়ের সমারোহ। কাপড় কেনাতো বাদই দিলাম, ঈদের দিনের জন্য সামান্য সেমাই কেনার টাকাও অনেকের কাছে নেই।

এসএস

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh