• ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
logo

মীর কাসেমের উত্থান-পতন

অনলাইন ডেস্ক
  ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২০:৪০

মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া মীর কাসেম আলী জামায়াতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক দেশের অন্যতম বিলিয়নিয়ারকে জামায়াত-শিবিরের অর্থের প্রধান জোগানদাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১৯৫২ সালে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে মীর কাসেম আলীর জন্ম। তার পিতা তৈয়ব আলী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন। চার ভাইয়ের মধ্যে মীর কাসেম দ্বিতীয়। এলাকার মানুষ তাকে মিন্টু নামেই চেনেন। পিতার চাকরির সুবাদে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন চট্টগ্রামে। ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যয়নকালে জড়িয়ে পড়েন জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে। পরবর্তীতে এ সংগঠনের চট্টগ্রাম সভাপতি হন।

একাত্তরের ভূমিকা:

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নেয় জামায়াত। রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারির পর জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছাত্রসংঘ নেতাদের নিজ নিজ জেলায় আলবদর বাহিনীর প্রধান করা হয়। মীর কাসেম আলী হন চট্টগ্রাম জেলার প্রধান।

খান সাহেব হিসেবে পরিচিত মীর কাসেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ’৭১ এর ২ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে তার নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধী সমাবেশ আয়োজন করা হয়। সভাপতি হিসেবে তিনি তখন ভাষণে বলেন, গ্রামগঞ্জে প্রতিটি এলাকায় খুঁজে খুঁজে পাকিস্তানবিরোধীদের শেষ চিহ্নটি মুছে ফেলতে হবে।

তার বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ হচ্ছে, তিনি সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়ি ‘মহামায়া ভবন দখল করে টর্চার সেল বানান। ডালিম হোটেল নামে পরিচিত ওই টর্চার সেলে এনে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হতো।

স্বাধীন বাংলাদেশে মীর কাসেম আলী :

স্বাধীনতার পর ঢাকায় আসেন মীর কাসেম। কিন্তু কিছুদিন পরেই মুক্তিযোদ্ধাদের রোষানলে পড়ার ভয়ে চলে যান লন্ডনে। সেখান থেকে সৌদি আরব। সৌদিতে থাকাকালীন দেশটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তার সুসম্পর্ক হয়। পরবর্তীতে ৭৫’ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে ফিরে আসেন মীর কাসেম।

তার নেতৃত্বেই ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ছাত্রসংঘ নাম পরিবর্তন করে ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে সংগঠনটি। মীর কাসেম হন শিবিরের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি। এরপর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে ১৯৮০ সালে তিনি রাবেতা আল ইসলামীর এ দেশীয় পরিচালক হন।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর টাকায় ধারাবাহিকভাবে গড়ে তোলেন ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস। জামায়াত ও শিবিরের আয়ের এবং কর্মসংস্থানের বড় উৎস হয়ে দাঁড়ায় এসব প্রতিষ্ঠান।

ব্যাংক, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, গণমাধ্যম ও শিক্ষা—সব খাতেই ছিল তার দাপুটে বিচরণ ।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রাবেতা আল ইসলামীর বাংলাদেশ পরিচালক, ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ইবনে সিনা ট্রাস্ট (প্রশাসন) ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালসের বোর্ড অব ডিরেক্টরের সদস্যও ছিলেন এ জামায়াত নেতা।

এ ট্রাস্টের আটটি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ও ইমেজিং সেন্টার, ১টি মেডিকেল কলেজ, ১টি নার্সিং কলেজ ও একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক স্কুল ও কলেজ এবং দিগন্ত পেপার মিলের মালিক কাসেম আলীই। এছাড়া ফুয়াদ আল খতিব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট (এআইটি) ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।

দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলী। এর অধীনে রয়েছে দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকা আর দিগন্ত টেলিভিশন।

মীর কাসেম আলীর ব্যক্তিগত বাণিজিক গ্রুপ ‘কেয়ারী'। তিনি কেয়ারি হাউজিং ও ইডেন শিপিং লাইন্সের চেয়ারম্যান। নামের আগে ‘কেয়ারী’—এ রকম ১০টি কোম্পানির পরিচালক মীর কাসেম। এগুলো হলো কেয়ারী লিমিটেড, কেয়ারী পোলট্রি হ্যাচারি অ্যান্ড প্রসেস, কেয়ারী স্প্রিং, কেয়ারী শান, কেয়ারী ট্যুরস অ্যান্ড সার্ভিসেস, কেয়ারী তাজ, কেয়ারী কালার সেন্টার, কেয়ারী ঝর্ণা, কেয়ারী রিয়েল এস্টেট ও কেয়ারী টেলিকম লিমিটেড।

কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে যেতে মীর কাসেমের একক মালিকানাধীন বিলাসবহুল পাঁচটি প্রমোদতরি। কেয়ারী ক্রুইজ, কেয়ারী ডাইন, কেয়ারী সিন্দবাদ, কেয়ারী কর্ণফুলী ও কেয়ারী তরঙ্গ। এছড়া কেয়ারী গ্রুপের সহস্রাধিক অ্যাপার্টমেন্ট ও বিপণিবিতান রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে।

বিচার বাধাগ্রস্থ করতে মীর কাসেমের পদক্ষেপ:

মানবতাবিরোধী বিচারের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে মীর কাসেম আলী ২০১০ সালের ১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের কনসালট্যান্সি ফার্ম কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে চুক্তি করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ ও লবিং করাই ওই চুক্তির লক্ষ্য।

কনসালট্যান্সি ফার্মটি মীর কাসেম আলীর পক্ষে আমেরিকান কংগ্রেস, সিনেট সদস্য এবং ইউএস প্রশাসনের প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে।

তারই লবিংয়ে হাউস অব কমন্সের শক্তিশালী একটি লবিস্ট গ্রুপ কাজ শুরু করে। তারা যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

মীর কাসেম আলীর ভাই মীর মাসুম আলী ও জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নাকীবুর রহমান নিজামীর তত্ত্বাবধানে ‘অর্গানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’ এবং ‘হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’চালায় নানা প্রচারণা। ‘ক্লোয়াক্রম অ্যাডভাইজর’ও ‘কে গ্লোবাল’নামে দু’টি লবিং প্রতিষ্ঠানও সাব-কনট্রাক্ট এর ভিত্তিতে কাজ শুরু করে তাদের সঙ্গে।

বিচারের মুখোমুখি মীর কাসেম:

শত চেষ্টায়ও শেষরক্ষা হয়নি জামায়াতের প্রভাবশালী এই ব্যবসায়ী নেতার। ২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাসেমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিন বিকেলেই মতিঝিলে দৈনিক নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে তাকে গেপ্তার করে।

১৯ জুন মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মীর কাশেমের জামিন আবেদন খারিজ হয়।

২০১৩ সালের ৬ মে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেন তদন্ত সংস্থা। এজন্য মীর কাশেমকে দু’দফা সেফ হোমে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত সংস্থা।

২০১৩ সালের ১৬ মে প্রসিকিউটর ১৪টি অভিযোগে মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন। ২৬ মে এ অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয় ২১ আগস্ট।

এরপর চলে রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের সাক্ষ্য, প্রমাণ ও যুক্তি উপস্থাপন শেষে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর রায় ঘোষণা হয়। এতে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ মোট আটজনকে হত্যার দায়ে এ আলবদর নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ৩০শে নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন মীর কাসেম।

গেল ৮ মার্চ ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখে জসিমসহ ছয়জনকে হত্যার দায়ে তার বিরুদ্ধে রায় বহাল রাখেন সুপ্রিম আপিল বিভাগ।

এরপর ৬ই জুন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ১৯শে জুন আবেদন করেন মীর কাসেম আলী।

গেল ৩০ আগস্ট রিভিউ আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড রহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত। এরপর বাকি ছিল শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়া।

শুক্রবার মীর কাসেম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা করবেন না বলে জানান। ওইদিনই প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়।

শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা হয় এই আল-বদর নেতার। এর মাধ্যমে সমাপ্ত হল রাজাকার মীর কাসেম আলী অধ্যায়।

মন্তব্য করুন

daraz
  • অপরাধ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh