• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
logo

নকশায় ভুল, নির্মাণে দায়সারা ভাব

মিথুন চৌধুরী

  ১৭ মার্চ ২০১৭, ২৩:২৫

দায়সারাভাবে নির্মাণ হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার। প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটির সবশেষ নির্মাণ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় দাঁড়ায় ১৫২ কোটি টাকা।

প্রকল্প শুরুর সময় মোট ব্যয় ধরা হয় ৭৭৩ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী, কিলোমিটার প্রতি নির্মাণ ব্যয় ছিল ৯৭ কোটি টাকা। তবে ২০১১ সালে নির্মাণ শুরু হওয়া প্রকল্প ২০১৭ সালেও আলোর মুখ দেখেনি। সবশেষ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নির্মাণ সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনো বাকি রয়েছে ৩০ ভাগ কাজ। অথচ প্রকল্পটি ২০১৪ সালে শেষ হবার কথা ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অজ্ঞতা, নকশায় ভুল, পরিকল্পনার অভাব, নির্মাণের আগে গবেষণায় ত্রুটির ফলে নির্মাণ ব্যয় ও সময় বেড়ে গেছে। এতে বেড়েছে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবার কোনো সম্ভাবনা নেই।

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের সাত রাস্তা-মগবাজার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনের অংশ চালু হয়েছে গেলো বছরের ৩০ মার্চ। আর ইস্কাটন-মগবাজার ওয়্যারলেস পর্যন্ত অংশ চালু হয় গেলো ১৫ সেপ্টেম্বর।

এদিকে, মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের নকশায় ভুল রয়েছে। ভুল নকশাতেই নির্মাণ হচ্ছে ফ্লাইওভারটি। মূলত ডানহাতি গাড়ির জন্য নির্মাণ হচ্ছে বামহাতি স্টিয়ারিংয়ের এ ফ্লাইওভার। যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানির করা নকশা অনুযায়ী ফ্লাইওভারটির কাজ হচ্ছে। সে দেশের গাড়িগুলো বামহাতি স্টিয়ারিংয়ে চালিত হওয়ায় সব রাস্তাই বামহাতি লেনে বানানো। কিন্তু বাংলাদেশে সব ধরনের মোটরযান ডান হাতে চালিত। সে দেশের রাস্তার আদলে করা নকশায় ফ্লাইওভার করায় বিপত্তি ঘটেছে। ফ্লাইওভারের কাঠামোয় ত্রুটির বিষয়টি বেশকিছু দিন আগেই চিহ্নিত করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞরা। এতে নানা সমস্যা সৃষ্টি হবার আশঙ্কা থাকলেও এখন আর ত্রুটি সংশোধন সম্ভব নয়। ত্রুটি সারাতে গেলে ভাঙতে হবে ৬০টি পিলার। যা কার্যত অসম্ভব। এতে সময় যেমন লাগবে, ব্যয়ও বাড়বে। সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলা জনভোগান্তিও দীর্ঘায়িত হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, নকশা ভুলের কারণে শান্তিনগর ছাড়া অন্য কোনো স্থানে ডানে মোড় নেয়ার সুযোগ থাকবে না। ৬০ কিলোমিটারের কম গতিতে ফ্লাইওভারে ওঠায় ঝুঁকি থাকবে। বিশেষত মালবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকবে বেশি। কারণ বেশিরভাগ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের ফিটনেসে সমস্যা আছে। এগুলোর গতিও অনেক কম। ফলে ফ্লাইওভারে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ওঠা নিষিদ্ধ করা হতে পারে। এছাড়া তিন তলাবিশিষ্ট ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও মগবাজার, বিশ্বরোড ইন্টার-সেকশন ও টঙ্গী ডাইভারশন রোডে ওঠার কোনো র‌্যাম্প রাখা হয়নি। এতে ফ্লাইওভারে যানবাহনের সংখ্যা কমে যাবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় স্বল্পমূল্যে নির্মাণসামগ্রী ও শ্রম ব্যয় কম হলেও দেশে ফ্লাইওভার নির্মাণের খরচ বেশি। যা দক্ষিণ এশিয়ার উন্নত দেশ চীন ও মালোশিয়ার চেয়েও বেশি। যেখানে বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় দাঁড়ায় ১৩৫ থেকে ১৫২ কোটি টাকা। সেখানে ভারতে ১০০ কোটি, পাকিস্তানে ৭০ কোটি, মালোশিয়া ও চীনে উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়।

দীর্ঘদিন চলা ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের কারণে এমনিতেই ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী, তার ওপর নতুন করে রাস্তা খোঁড়ার কারণে বিপর্যয় নেমে এসেছে। পাশাপাশি বেড়েছে মৃত্যুঝুঁকি। এ সড়ক ব্যবহারকারী লাখ লাখ নগরবাসীকে দীর্ঘ যানজটে পড়তে হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে বিপুল কর্মঘণ্টা।

সরেজমিন রাজারবাগ, মালিবাগ মোড়, শান্তিনগর, মৌচাক, মালিবাগ রেলগেট, এফডিসি মোড় ঘুরে দেখা গেছে, একদিকে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ, অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। রাস্তা দিয়ে চলাচলের উপায় নেই। কোথাও চলছে ফ্লাইওভারের স্লাবের কাজ, কোথাও আই গ্রাডার, বিম, ঢালাইয়ের কাজ।

নির্মাণ শ্রমিকরা জানিয়েছেন, যেভাবে কাজ চলছে তাতে তা নির্মাণে আরো কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।

ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করা বাস চালকরা জানান, ফ্লাইওভারের কাজ চলাতে সড়কের নিচে থাকা বিভিন্ন ড্রেন ও স্যুয়ারেজের লাইনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টির পানি জমে থাকে ও স্যুয়ারেজের ময়লা পানি সড়কের ওপর ভেসে ওঠে। কাদা পানিতে চলতে গিয়ে কিছুক্ষণ পর পর রিকশা, মোটরসাইকেল, অটোরিকশার মতো ছোট গাড়ি নষ্ট হয়ে আটকে পড়ছে।

মানুষের যাতায়াত সহজ করতেই ২০১১ সালে একনেকে মগবাজার-মৌচাক সাড়ে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৪ সালের মধ্যে ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হবার কথা ছিল। শুরুতে নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেশ তৎপর হলেও তাদেরই ধীর গতির কারণে ২০১৭ সালেও ৩০ ভাগ কাজ এখনো বাকী রয়ে গেছে। তবে ২০১৫ সালে ৩০ মার্চ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের একটি অংশ। দেশের দীর্ঘতম এই ফ্লাইওভারের রমনা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত দু’ কিলোমিটার অংশের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।

স্থপতি ইকবাল হাবিব জানান, জবাবদিহিতার বাইরে গিয়ে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ সামগ্রিকভাবে মঙ্গল বয়ে আনবে না। নকশার ত্রুটি মহাখালী ফ্লাইওভারের ক্ষেত্রেও ছিল। আমাদের গাড়িচালকরা কোন দিকে বসেন, অথবা আমরা জাপান-যুক্তরাষ্ট্র নাকি ব্রিটিশ- কোনো সিস্টেমে চলবো, তা বিবেচনা করা ছাড়াই এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব বিবেচনা না করার ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ গণশুনানি ছাড়াই এ ধরনের বড় অবকাঠামো নির্মাণ। আর গণশুনানি হয় না বলেই এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের সময়ও জনদুর্ভোগের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয় না।

তিনি আরো বলেন, মহাখালী ফ্লাইওভার নির্মাণের ফলে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সচল ডাইভারশন তৈরি করা যায়নি। মহাখালী ফ্লাইওভারের কার্যকারিতা বাড়াতে তেজগাঁও শিল্প এলাকার দিকে একটা উইং দরকার ছিল, এটাও করা যায়নি। মহাখালীর মতো মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারও এক প্রকার অকার্যকর করে নির্মাণ করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার মুঠো ফোনে চেষ্টা করা হয়। তবে তাদের কাছ থেকে তেমন সাড়া মেলেনি।

এ দুর্ভোগ কতদিন পোহাতে হবে? [ভিডিও]

আতঙ্কের নাম মগবাজার ফ্লাইওভার

এমসি/ডিএইচ

মন্তব্য করুন

daraz
  • অপরাধ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh