• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

আসছেন বিদ্যার দেবী

মিথুন চৌধুরী

  ৩১ জানুয়ারি ২০১৭, ২৩:৩৩

রাত পোহালে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর আগমণ। প্রতিবছর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে তিনি আসেন। জ্ঞান, বিদ্যা, সংস্কৃতি ও শুদ্ধতার দেবী তিনি। সৌম্যাবয়ব, শুভ্র বসন, হংস-সম্বলিত, পুস্তক ও বীণাধারিণী এ দেবীর আগমনকে ঘিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নিয়েছেন নানা উদ্যোগ।

এরই মধ্যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বিদ্যা, জ্ঞান, সঙ্গীত ও কলাধিষ্ঠাত্রীকে বরণ করতে উদ্যোগ নিয়েছেন।

সাধারণত সরস্বতী দেবীকে পূজা করে হিন্দুরা। তবে সব বাঙালির কাছে ‘বিদ্যা’ নামক শব্দটির প্রতীক এ সরস্বতী। সনাতন ধর্মে প্রাচীন ঋষিরা ব্রহ্মের অনন্ত শক্তির অংশকে একেকজন দেব-দেবীরূপে কল্পনা করেছেন। তেমনিভাবে ব্রহ্মের যে শক্তি আমাদের বিদ্যা শিক্ষাদান করেন তাকে সরস্বতী দেবী নামে পূজা-অর্চনা করা হয়।

শাস্ত্রে দেখা যায়, চতুর্ভুজা ব্রহ্মার মুখ থেকে আবির্ভূতা শুভ্রবর্ণা বীণাধারিণী চন্দ্রের শোভাযুক্তা দেবীই হলেন সরস্বতী। সরস্বতী দেবীর ধ্যান, প্রণামমন্ত্র ও স্তবমালা থেকে সামগ্রিক রূপটি হলো-এ দেবী সরস্বতী শুভ্রবর্ণা শ্বেত পদ্মাসনা, শ্রী হস্তে লেখনী, পুস্তক ও বীণা। তিনি শুভ্রবস্ত্রাবৃতা হংসরূপ বাহনে উপবিষ্ট বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্তাদি বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

পুরাণে সরস্বতী দেবীর উদ্ভব নিয়ে নানা প্রসঙ্গ আছে। ঋগবেদের দশম মণ্ডলে ঋষি মধুছন্দা গায়ত্রী ছন্দে সরস্বতী দেবীকে বন্দনা করেছেন গতিময় জীবন প্রত্যাশা করে। সংস্কৃত ‘সরস’ হল পূর্ণতাপ্রদাত্রী বা জ্যোতির্ময়ী অথবা ঐশর্যময়ী। আবার ‘সরস’ অর্থ জল বা জীবনের প্রশান্তি। উভয় অর্থেই (সরস+বতী) সরস্বতী আলোকিত জীবনময়তার প্রতীক।

শাস্ত্রে বিভিন্নরূপে সরস্বতী দেবীর পূজার কথা বর্ণিত আছে। হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদে নদীরূপে, যজ্ঞ কর্মাদিতে প্রজ্ঞাদাত্রীরূপে, ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ কর্ণৎভবা বাগাধিষ্ঠাত্রীরূপে, শ্রীহরির ভাষারূপে, মৎস্যপুরাণে নৃত্য-গীতাদির সিদ্ধিদাত্রীরূপে সরস্বতীর কথা বর্ণিত আছে।

সরস্বতী দেবীর স্বরূপ সম্পর্কে সরস্বতী স্তোত্রে বর্ণিত আছে, ‘শ্বেত পদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষশোভিতা/শ্বেতাম্বর ধরা নিত্যেমবেত গন্ধানু লেপনা/মানসে রমতাং নিত্যং হংসেব হংস বাহিনী/বাচং দদাতি বিপুলাং যা চ দেবী সরস্বতী।’ সরস্বতী শ্বেত পদ্মের ওপর উপবিষ্টা। সাধকদের মতে, দেহে ছয়টি পদ আছে। বিশুদ্ধ পদে আরোহণ করলে সারস্বত জ্ঞান লাভ হয়। সরস্বতীকে পদ্মাসীনা দেখিয়ে দেহস্থ প্রাণবায়ুকে উত্তোলন করার কৌশল নির্দেশ করা হয়েছে।

তিনি শুভ্রবর্ণা। তার এ শুভ্রবর্ণ শুচিতা, শুভ্রতা, শুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক; যা আমাদের মনকে শুচি, শুভ্র ও শুদ্ধ রাখার নির্দেশ দিচ্ছে। কারণ মন শুদ্ধি না হলে চিত্ত শুদ্ধি হয় না আর চিত্ত শুদ্ধি ছাড়া জ্ঞান লাভ করা যায় না। সরস্বতী দেবী হংসবাহনা। হংসের একটি বিচিত্রতা আছে। হংসকে দুধ ও জলের মিশ্রণ খেতে দিলে তিনি অনায়াসে জল রেখে সারবস্তু দুধ গ্রহণ করেন। সার ও অসার মিশ্রিত এ জগৎ সংসারে মানুষ যেন সারবস্তু গ্রহণ করে এ নির্দেশই হংসবাহনতায় প্রকাশিত। দেবীর হাতের পুস্তক জ্ঞানচর্চার প্রতীক। জ্ঞানের মতো পবিত্র এ জগতে আর কিছুই নেই। এ জ্ঞান সব যোগের পরিপক্ব ফল। সংযতেন্দ্রিয় ও তৎপর হয়ে তত্ত্ব জ্ঞানে শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি এ জ্ঞানলাভ করেন এবং অচিরেই তিনি পরাশাস্তিপ্রাপ্ত হন। সরস্বতী মায়ের হাতের বীণা সঙ্গীতবিদ্যার প্রতীক। মনের ভাব প্রকাশ হয় ভাষায় আর প্রাণের ভাব প্রকাশ পায় সুরে। সুর মানুষকে বিমোহিত করে। প্রাণে আনন্দের সঞ্চার ঘটায়। সুরের লহরি সবাই শুনতে চায়, কিন্তু বেসুর কেউ শুনতে চায় না। দেবীর হাতের বীণা বেসুর সৃষ্টিকারী নয়। এ যে প্রাণের বৈরাগ্য সৃষ্টিকারী ছন্দময় সুর। সেই বীণা তারে সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি এই সপ্তস্বর বাঁধা আছে। এদের প্রথম দুটি বর্ণ ‘স’ এবং ‘র’ যোগে দেবীর নামের আদ্যাক্ষর সূচিত হয় ‘গ’ এবং ‘ম’ যোগে ঊর্ধ্ব গমন করা বোঝায়। ‘প’ পবিত্রতার পরিচয় বহন করে এবং ‘ধ’ অর্থে ধারণ ও ‘ন’ অর্থে আনন্দকে বোঝায়।

সরস্বতী পূজা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান শ্রী শ্রী সরস্বতী পূজা উপলক্ষে দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, দেশে বিদ্যমান সম্প্রীতির এ সুমহান ঐতিহ্যকে আরো সুদৃঢ় করতে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখতে হবে। ‘জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বাণী অর্চনার এ আবহ অম্লান হোক- এ কামনা করে তিনি বলেন, জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হয়ে দেশের প্রতিটি মানুষ অসাম্প্রদায়িকতা, অজ্ঞানতার অন্ধকার, কূপমণ্ডকতা আর অকল্যাণকর সব বাধা পেরিয়ে একটি উন্নত সমাজ গঠনে এগিয়ে আসবে-এটাই সকলের প্রত্যাশা।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে দেবী সরস্বতীর পূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের সকলকে জ্ঞানার্জনে ব্রতী হয়ে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে রয়েছে সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা। আবহমানকাল ধরে এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষ মিলেমিশে একত্রে বসবাস করে আসছেন। তারা নির্বিঘ্নে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করছেন।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের মন্দির ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পূজা ছাড়াও অন্য অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান, প্রসাদ বিতরণ, ধর্মীয় আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সন্ধ্যা আরতি, আলোকসজ্জা প্রভৃতি। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ হলে মহাসাড়ম্বরে বিদ্যা ও আরাধনার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর পূজার আয়োজন করা হয়েছে।

এমসি/এসজে

মন্তব্য করুন

daraz
  • বাংলাদেশ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh