• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

মানুষকে ভালোবেসে সব ছেড়েছেন আইভী

সিয়াম সারোয়ার জামিল

  ২২ ডিসেম্বর ২০১৬, ২৩:৪৬

পড়াশুনা করেছিলেন চিকিৎসাবিদ্যায়। মানবসেবা করার ব্রত নিয়ে ঘুরেছেন রোগীদের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। কিন্তু ভাবেননি একদিন নগর প্রধানের আসন অলঙ্কৃত করবেন, ত্যাগ করবেন নিজের প্রিয় পেশা। সংসারেও মন দিতে পারলেন না নিজের মতো। তার স্বপ্ন কেবলই নারায়ণগঞ্জকে ঘিরে। দীর্ঘ একযুগ ধরে নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধি থেকেও এতোটুকু জনপ্রিয়তা কমেনি। প্রায় দ্বিগুণ ভোটে বিপক্ষ দলের প্রার্থীকে পরাজিত করে দেখিয়ে দিলেন নিজের ক্ষমতা, নিজের অস্তিত্ব। পৌরসভার চেয়ারম্যান থেকে দ্বিতীয়বারের মতো সিটি করপোরেশনের মেয়র। তিনি ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভী।

১৯৭৪, নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচন। শ্রমিকনেতা আলী আহম্মদ চুনকা প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দলের সমর্থন পেয়েছিলেন খোকা মহিউদ্দিন। চুনকা বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলে তিনি শুধু তাকে দোয়া করে দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রার্থী বদলাননি। বিপুল ভোটে সেদিন চুনকা জয়ী হয়েছিলেন। কেটে গেছে ৪১ বছর। গড়িয়েছে শীতলক্ষ্যার বহু জল। বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা এখন হয়েছে সিটি করপোরেশন। বদলেছে বংশ পরম্পরাও, চুনকা থেকে দায়িত্বে কাধে নিয়েছেন আইভী। চুনকার বুনে যাওয়া বীজ একযুগ ধরে নারায়ণগঞ্জের মায়ের ভূমিকায়।

দীর্ঘ এ পথচলা তার মসৃণ ছিল না। প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে রাজপথে। কথার যুদ্ধ, কৌশলের যুদ্ধ, উন্নয়নের যুদ্ধ। তারপরও এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। আবারও মেয়র হয়ে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করারই শপথ নিলেন। বিজয় উৎসর্গ করলেন বঙ্গবন্ধু ও দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। নাওয়া-খাওয়া ভুলে অগণিত মানুষের সমস্যার পাহাড় নিয়ে সমাধান খুঁজে বেড়াবেন। পেছনে রেখেছেন এক অলৌকিক উত্থানের গল্প- যা বাস্তব করেছেন চুনকার আদর্শে গড়া তারই মেয়ে। সময়ে ফেরে জিতে নিয়েছেন নারায়ণগঞ্জবাসীর মন।

যেভাবে রাজনীতি শুরু
১৯৮৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। ভোররাতে মারা গেছেন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান আলী আহম্মদ চুনকা। আইভী তখন কেবল উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী, ৫ ভাই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। চুনকার মৃত্যুতে পরিবারের পাশাপাশি শূন্যতা সৃষ্টি হলো নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনেও। আইভী মনস্থ করলেন, পিতার দেখানো পথেই চলবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় ফেরার পর, ১৯৯২ সালে। মিটফোর্ড হাসপাতালে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার সময় ওই বছরই নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি।

ততোদিনে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের ভেতরকার দ্বন্দ্বও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এরই রেশ ধরে আইভীর এলাকার যুবলীগের নেতা আলম খুন হন, চারদিন পর খুন হন সোহেল। আইভী রাজনীতির এই কদর্য রূপের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। দ্বিধায় পড়ে যান। বলছিলেন, ‘আমার বাবার সঙ্গেও দ্বন্দ্ব ছিল কারও কারও, কিন্তু তা ছিল আদর্শিক। রক্তপাতের রাজনীতি তখন ছিল না। লেখাপড়া শিখে আমি হত্যাকাণ্ডের রাজনীতি করবো?’ মন সায় দিলো না। স্বামী কাজী আহসান হায়াতের সঙ্গে চলে গেলেন নিউজিল্যান্ড।

বিদেশ গিয়ে পড়ালেখা শুরু করলেন আবার, কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। দেশের জন্য কাঁদছিল তার মন। দোটানায় কেটে গেল অনেক বছর। জন্ম নিলো প্রথম সন্তান কাজী সাদমান হায়াৎ। নিউজিল্যান্ডে ইমিউনোলজি অ্যান্ড ব্লাড ট্রান্সফিউশনের ওপর স্নাতকোত্তর লেখাপড়ায় মন দিলেন আইভী। সন্তানের দেখাশোনা, পড়ালেখা এই নিয়ে সময় কেটে যাচ্ছিল। লেখাপড়া প্রায় শেষের দিকে; কোল আলো করে এলো দ্বিতীয় সন্তান কাজী সারদিল হায়াৎ। শুধু ইনটার্ন করলেই চার বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিটা পাবেন আইভী। এরই মধ্যে একদিন বাড়ি থেকে ছোটভাই আলী রজার ফোন, ‘আপা, নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা হয়েছে, পরশু মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। যদি নির্বাচন করতে চাও, এখনই চলে আসো।’ এভাবেই শুরু।

বাবার কাছেই রাজনীতির হাতেখড়ি
বাবা আলী আহম্মদ চুনকা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি। স্বাধীনতার পর দু’-দু’বার নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে আইভীর কানে রাজনীতির টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসতো। বাবা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তেন, আর মেয়েকে বলতেন গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো কেটে রাখার জন্য। শুধু যে নেতাকর্মীরাই তার বাড়িতে অতিথি হয়ে আসতেন তা-ই নয়, প্রতিদিন দুপুরে দুঃখী, খেটে খাওয়া মজুর- সবাইকে নিয়ে খেতে বসতেন আলী আহম্মদ চুনকা। রাতেও তাই। আইভীর মা মমতাজ বেগম হাসিমুখে, নীরবে প্রতিদিন জনা পঞ্চাশেক মানুষের রান্নাবান্নার আয়োজন করেন। অন্যকোনো দিকে তাকানোর সময় নেই তার। ওই জীবনেই ঘটল ছন্দপতন। বাবার লাশের পাশে মা ও ৪ ভাইবোনের মতো পাথর হয়ে গিয়েছিলেন সেলিনা হায়াৎ। দিনটি এখনও তাকে শোকে আচ্ছন্ন করে। সেই দিনটিই তাকে বাবার দেখানো পথে চলার সাহস যোগায়।

এক নজরে আইভী
১৯৬৬ : ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর জন্ম।
১৯৭৯ : ট্যালেন্টপুলে পান জুনিয়র স্কলারশিপ।
১৯৮২ : মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় স্টার মার্কসহ উত্তীর্ণ হন।
১৯৮৫ : রাশিয়ান সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষাগ্রহণের জন্য ওডেসা পিরাগোব মেডিকেল ইনস্টিটিউটে ভর্তি।
১৯৯২ : কৃতিত্বের সঙ্গে ডিগ্রি লাভ। একই বছর ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে ইন্টার্নি সম্পন্ন করেন।
১৯৯৪ : নারায়ণগঞ্জ ২০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে অনারারি চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন।
২০০৩ : নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন।
২০১১ : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র।
২০১৬ : উপমন্ত্রীর মর্যাদায় আইভী। এশিয়ার প্রভাবশালী নারী মেয়রদের তালিকায় নাম। দলীয় প্রতীকে (নৌকা) প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচিত।

এসজে/ এস

মন্তব্য করুন

daraz
  • বাংলাদেশ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh