• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

সবক্ষেত্রে বঞ্চিত নারীরা (ভিডিও)

মিথুন চৌধুরী

  ০১ মে ২০১৭, ০০:০৫

কৃষিকাজ থেকে শুরু করে নির্মাণ সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে পুরুষের পাশাপাশি বহু নারীর অক্লান্ত শ্রম ও সাধনা রয়েছে। শুধু তাই নয় দেশের সর্বচ্চো আয়ের উৎস পোশাকখাতে নারীদের অবদান অস্বীকার্য। সংসার ও সন্তান পালনের পাশাপাশি এসব নারীরা সভ্যতা নির্মাণে অংশগ্রহণ করলেও পুরুষের সমমর্যাদা থেকে বরাবরই বঞ্চিত নারীর শ্রম অধিকার।

১৮ শতকের আগে ভারত বর্ষে নারীরা নিপীড়িত হতেন নানান ভাবে। সতীদাহ থেকে শুরু করে কাজের অবমূল্যায়ণ নিত্যদিন সঙ্গী ছিল নারীদের। পরিবর্তন আসে বাংলাদেশের প্রথিতযশা নারীবাদী ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামালসহ আরো কয়েকজনের হাত ধরে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের নারীরা পড়ালেখায় ও শ্রম বাজরে পুরুষের শামিল হন। তবে আজীবন নারীরা ঘর-বাড়ির কাজটা ধামা চাপা পড়ে থাকে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রম জরিপ অনুয়ায়ী, দেশে বর্তমানে শ্রমশক্তির মধ্যে ৩ কোটি ৯৫ লাখ পুরুষ ও এক কোটি ৭২ লাখ নারী। এরমধ্যে অনানুষ্ঠানিক কাজে যুক্ত আছেন প্রায় চার কোটি ৭০ লাখ। প্রায় ৮৭ শতাংশ শ্রমশক্তি অনানুষ্ঠানিক কাজ করে থাকেন। বাকি ১৩ শতাংশ শ্রমশক্তি আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কাজ করে থাকেন। দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখের কিছু বেশি। বর্তমানে পোশাক শিল্পে প্রায় ৪২ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করে। যার ৮০ শতাংশ নারী।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(১) ধারায় নারী কোটা ১০ শতাংশ দিয়ে নারীদের অধিকার সুস্পষ্ট করা হয়। এরপর থেকে নারীদের উন্নায়নে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের জন্য সরকার ঘোষিত এ কোটা পদ্ধতিও অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয় না।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ধারাবাহিকভাবে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে দেশের মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০০২-০৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ২৬ দশমিক ১ শতাংশ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে হয় ২৯ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১১-১২ অর্থবছরে হয় ৩৯.১ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৬ সালের হিসেবে তা ৪০ শতাংশের বেশি।

এদিকে শ্রমজীবী নারীরা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে আছেন। জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে এটা একটা প্রতিবন্ধক, মর্যাদাবান জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার পথেও অন্তরায়। তাই বিভিন্ন জাতীয় নীতিতে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বৈষম্য বিশেষ কমছে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, কিন্তু পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁর আয় বাড়ছে না। সরকারি ও কিছু করপোরেট খাত বাদে নারী শ্রমিক ও নারী চাকরিজীবীদের মজুরি বা বেতন পুরুষের তুলনায় কম।

এছাড়া নির্মাণশিল্প, কৃষিকাজ, গৃহস্থালি কর্মে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হয়। এমনকি যে পোশাকশিল্পের সিংহভাগ শ্রমিক নারী, সেখানেও পুরুষের তুলনায় নারী কর্মীদেরকম মজুরি দেয়া হয়। শ্রমজীবী নারীদেরও হয়ত প্রায়ই সহকর্মীদের কটাক্ষ, গঞ্জনাসহ নানা অসৌজন্যমূলক আচরণের সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ কর্মক্ষেত্র নারীবান্ধব নয়। যৌন হয়রানির ঘটনা ছাড়াও পুরুষ সহকর্মীদের মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শ্রমজীবী-কর্মজীবী নারীদের নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে ১৬০ দেশে প্রায় ৯০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী শ্রমিকও রয়েছেন।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে বিদেশে নারীদের কর্মসংস্থান শুরু। ১৯৯১ সালে মাত্র ২ হাজার ১৮৯ জন নারী বিদেশে গিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা প্রথমবারের মতো বছরে ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। আর ২০১৫ সালে ১ লাখ ৩ হাজার ৭১৮ জন কর্মী বিদেশ গেছেন। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৫ লাখ ৬৪ হাজার ৭৫৬ জন নারী বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছেন।

তবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি শ্রমজীবি নারীরা যৌন অত্যাচার, মানসিক অত্যাচার, বেতন-ভাতা না দিয়ে শারিরিক অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন নিত্যদিন। জর্ডানে, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রতিমাসে প্রবাসী নারীদের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোরর্ডে চিঠি পাঠাচ্ছেন তারা। পাশাপাশি বোর্ডের কাছে প্রতিনিয়ত প্রবাসী নারীদের ফিরিয়ে আনতে আবেদন করছেন একাধিক পরিবার।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড সুত্র জানিয়েছে, এ বছর বাংলাদেশি দালালদের প্রতারণার ফাঁদে পড়া ৭৫৭ জন নারী শ্রমিক সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছেন। যাদের মধ্যে ৫০২ জনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে আশ্রয় নেন ৭৪ জন যাদের ৩৪ জনকে দেশে আনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

শ্রমজীবি নারী বলেন, নিম্নতম মজুরি, কাজের সময়সীমাসহ অন্য কোন সুযোগ-সুবিধার কোন নির্দিষ্ট বিধিবিধান নেই। চাকরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা নেই তাদের। মালিকপক্ষ যেভাবে নির্ধারণ করেন সেভাবেই মজুরি নির্ণয় হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী শ্রমিকদের কাজের কোনো সময়সীমা নির্দিষ্ট না থাকায় ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় নামমাত্র মজুরিতে।

এছাড়া মালিক বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অবহেলা বা বৈরী মনোভাব, প্রচলিত শ্রম আইনের দুর্বলতা এবং ট্রেড ইউনিয়নের অনুপস্থিতি অথবা দৃঢ় অবস্থান নিতে না পারার কারনে শ্রম আইনের সব সুযোগ-সুবিধা থেকে নারী শ্রমিকরা বঞ্চিত হন।

এ বিষয়ে জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি বলেন, ঘরে বাইরে নারীরা সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। কর্মজীবী নারীদের প্রতিনিয়ত পুরুষ সমাজ, মৌলবাদ, অসম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে ঠিকে থাকতে হয়। সরকার আমাদের জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন নতুন পথ সৃষ্টি করে দিয়েছে।

শ্রমজীবি নারী নিয়ে বিজনেজ ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) সিইও ফেরদোউস আরা বেগম বলেন, ‘আমাদের শ্রমজীবী জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ নারী, যার মধ্যে ৭৭ শতাংশ শ্রমজীবী নারী গ্রামে বসবাস করেন। মূলধারার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে এসব গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে অর্থনীতির দৃঢ়ভিত্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ৯০ শতাংশ নারী শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে অংশ নিচ্ছে। আয়বর্ধক কর্মসংস্থান হওয়া সবচাইতে প্রয়োজন। কৃষি, শিল্প সেবাখাত অর্থনীতির মূল তিনটি ক্ষেত্রে নারী সবচেয়ে বেশি অংশ নিয়ে থাকে। তাই একে আয়বর্ধক করার প্রয়োজন। প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির সুযোগ নিতে হলে নারীর জন্য প্রযুক্তি খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মানসিকতার পরিবর্তনও জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, নারীর জন্য পছন্দের বিষয়টি বেছে নেয়ার সুযোগ থাকা উচিত। আমাদের দেশে মজুরীবিহীন শ্রমিক অর্ধেকের মতো। ৫০ শতাংশ পারিবারিক শ্রমিকের মধ্যে কতজন ভালো কাজ করছেন কতজন নীতি নির্ধারক আছেন এই বিষয়গুলো দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

এমসি/জেএইচ

মন্তব্য করুন

daraz
  • বাংলাদেশ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh